বলা হয়ে থাকে যে মন্দতাকে সফল হতে দেওয়ার জন্য
যা প্রয়োজন তা হলো ভাল লোকদের চুপ থাকা। আর ভালো মানুষেরা যখন কথা বলে তখন এর উল্টোটাই
ঘটে, তখন মন্দতার পরাজয় হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অন্ধকার দিনগুলিতে বুলগেরিয়াতে তা
জীবন্তরূপে চিত্রিত হয়েছিল।
১৯৪১ সালের আনুষ্ঠানিক চুক্তির মাধ্যমে জার্মানির
সাথে বুলগেরিয়া এক মিত্র দেশে রূপান্তরিত হয়। এই চুক্তিটি বুলগেরিয়ার ভেতরে জার্মান
সামরিক ঘাঁটিস্থাপনের সুযোগ করে দেয়, আর দু’দেশের মধ্যে বিরোধপূর্ণ জমি
বুলগেরিয়াকে জার্মানি ফিরিয়ে দেয়। বুলগেরিয়ান সরকারের যে-সব সদস্যরা ইহুদিরে বিরুদ্ধে
হিটলারের “চুড়ান্ত সমাধান” বাস্তবায়ন করতে চেয়েছিল তারা
ফিরে পাওয়া ভূমি থেকে তাদের প্রথম ধাপে জার্মানির কনসেন্ট্রেশন শিবিরে প্রেরণ করার
পরিকল্পনা আরম্ভ করেছিলেন।
পেশেভ নামের একজন সংসদ সদস্য যখন এই পরিকল্পনার
কথা শুনেন তখন তিনি অন্যান্য প্রতিনিধিদের একত্রিত করে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কার্যালয়ে
যাত্রা করেন এবং এ পরিকল্পনার ব্যাখ্যা চান। পেশেভ এবং অন্যান্যরা তাকে আদেশটি বাতিল
করার জন্য চাপ দেন। আর তা তিনি বাতিলও করেছিলেন।
যদিও সমস্ত অঞ্চলে সময়মতো টেলিগ্রাম পৌঁছাতে
পারেনি। যার কারণে বুলগেরিয়ার দ্বিতীয় বৃহত্তর শহর প্লভডিভে, ইহুদিদের ভোরে ভোরে আটক
করে বেশিরভাগকে স্থানীয় স্কুল হলে আটকে রেখে জার্মানির উদ্দেশ্যে নির্বাসন ট্রেনের
জন্য অপেক্ষা করছিল। এখানে মেট্রোপলিটন কিরিল নামের স্থানীয় গির্জার প্রধান তৎক্ষণাৎ
বিষয়টি কাজ শুরু করেন। তিনি ইহুদিদের বহন করে নিয়ে যাওয়া প্রথম ট্রেনের সামনে রেললাইনের
উপর শুয়ে থাকার হুমকি দিয়ে রাজার কাছে একটি প্রতিবাদের টেলিগ্রাম প্রেরণ করেছিলেন।
এরপর তিনি স্কুলে যান যেখানে পুলিশ তাকে প্রবেশে
বাধা দেয়। তিনি নিজেকে আর সরকারের কোনো আইন মানতে বাধ্য নয় বলে এবং যিশু খ্রিষ্টের
সেবক হিসাবে তার বিবেক অনুযায়ী কাজ করবেন ঘোষণা দিয়ে কিরিল বেড়া টপকে সেখানে জড়ো হওয়া
ইহুদিদের প্রতিশ্রুতি দেন যে, “আপনারা যেখানেই যান না কেন, আমিও সেখানে যাব।
কিছুক্ষণ পর ইহুদিদের নির্বাসন না পাঠানো খবর
আসে পরে প্লভডিনে আর তারা সবাই তাদের বাড়িতে ফিরে যায়। এদিকে স্থানীয় এমপি পেশেভকে
পার্লামেন্টের ভাইস প্রেসিডেন্ট পদ থেকে বহিষ্কার করা হয়।
তাদের প্রথম প্রচেষ্টায় ব্যর্থ হয়ে জার্মান
পুলিশ গেস্টাপো রাজাকে ইহুদিদের শহর সমূহ থেকে বিতাড়িত করে বুলগেরিয়ার আদুরে পাঠিয়ে
দেওয়ার জন্য আইন প্রণয়নের চাপ দেয়। তারা ধরেই নিয়েছিল যে তা হয়ত দেশটিতে ইহুদিবিদ্বেষকে
উসকে দেবে এবং ইহুদিরে নির্বাসনকে ত্বরান্বিত করবে। আর সেই মুহূর্তেই এগিয়ে আসেন বুলগেরিয়ান
অর্থোডক্স চার্চের প্রধান মেট্রোপলিটন স্টেফান। তিনি তার গির্জার সিনোডের একটি সমাবেশের
আহ্বান করেন যা সর্বসম্মতিক্রমে ইহুদিদের গ্রামাঞ্চলে স্থানান্তরের আদেশের নিন্দা করে।
যেভাবেই হোক সরকার এটিকে কোনো জাতীয় উদ্যাপনের
দিনে বাস্তবায়ন করার লক্ষ্যে নির্বাসন পরিকল্পনায় এগিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা করে, এই আশায়
যে নির্বাসন প্রক্রিয়াটি দিনের উৎসবের মধ্যে কারো নজরে পড়বে না। স্টেফানের কাছে এর কিছুই গ্রাহ্য হয়নি। জাতীয় গির্জার
একজন প্রধান হিসেবে দিনটি উদযাপনে পুরোহিতের দায়িত্ব পালন করা তারই কাজ ছিল। সে দিন
যখন ক্যাথেড্রালের সিঁড়িতে কথা বলার জন্য দাঁড়িয়েছিলেন তখন তার সামনে ছিল বিশাল জনতা
আর তার পেছনে ছিল প্রধানমন্ত্রীসহ সরকারের সদস্যরা। তারপর তিনি ইহুদিদের নিপীড়নের
বিরুদ্ধে তীব্র নিন্দা করে এবং সরকারকে নাৎসিদের প্রভাবকে প্রতিহত করার আহ্বান জানিয়ে
তার প্রস্তুত করা ভাষণটি উপস্থাপন করলেন। স্টেফানের
পর প্রধানমন্ত্রী দাঁড়ান তার নিন্দা করার জন্য আর বলেন তাকে রাজনৈতিক বিষয়ে হস্তক্ষেপ
বন্ধ করার আহ্বান জানান।
দেশের গ্রামঞ্চলগুলিতে নির্বাসন অগ্রসর হচ্ছিল
বটে, তবে স্টেফান তার অবস্থানে ছিলেন অনড়। গ্রেপ্তার হওয়ার হুমকির মুখে তিনি আগ্রহী
সমস্ত ইহুদিদের খ্রিষ্ট ধর্মে দীক্ষিত হওয়ার প্রস্তাব দেন, যার অর্থ তাদের জার্মানিতে
নির্বাসিত হতে হবে না। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ১৯৪৩ সালের ১ জানুয়ারীর পরে জারি করা সমস্ত
দীক্ষিত হওয়ার সার্টিফিকেটকে স্বীকৃতি দিতে অস্বীকার করে এবং বুলগেরিয়ার সোফিয়া শহরের
সকল চার্চ বন্ধ করে দেওয়ার আদেশ দেন।
স্টেফান সরকারকে অবহিত করেন যে তার অধীনে সকল
চার্চ সরকারের এই আদেশকে উপেক্ষা করবে এবং জার্মানিতে ইহুদিদের জন্য যে পরিণতির অপেক্ষা
করছে তা ব্যাখ্যা করে তার সমস্ত প্যারিশ যাজকদের কাছে একটি সার্কুলার প্রেরণ করেন।
জনগণের বিরূপ প্রতিক্রিয়ার ভয়ে সরকার পিছু হটে। যুদ্ধ শেষ না হওয়া পর্যন্ত চার্চগুলি
খোলা থাকে আর ইহুদিদের বুলগেরিয়ায় থাকার অনুমতি দেওয়া হয়।, কারণ ভাল বিবেকবান মানুষেরা
মন্দতার মুখোমুখি হয়ে নীরব থাকতে অস্বীকার করেছিল বলে হাজার হাজার মানুষের জীবন রক্ষা
করা প্রাণে বেঁচে গিয়েছিল।