Man's Search for Meaning Bangla-ম্যান্স সার্চ ফর মিনিং জীবন বদলে দেওয়া Inspiring বইয়ের বাংলা অনুবাদ 2023

Man's Search for Meaning Bangla-ম্যান্স সার্চ ফর মিনিং জীবন বদলে দেওয়াInspiring বইয়ের বাংলা অনুবাদ 2023

Man’s Search for Meaning Bangla translation by Romzanul Islam Probin. Man’s Search for Meaning is one of the best-selling books in the world written by Austrian neurologist, psychiatrist, and philosopher Victor Emil Frankl. The translation includes the Logotherapy part as well.

অনুবাদকের মুখবন্ধ

প্রায় এক দশকেরও অধিক সময় ধরে আমি ইংরেজি ভাষায় লিখিত বই সমূহ সংগ্রহ করতে ও গোগ্রাসে পড়তে থাকি। দর্শন আর সাহিত্যে আমার যথেষ্ট আগ্রহ থাকলেও একজন অনুসন্ধিৎসু পাঠক হিসেবে আমার আগ্রহ অনুবাদ অবধি বিস্তার লাভ করে। এই পথচলায় আমি বহু যুগান্তকারী, গবেষণামূলক, উদ্দীপনামূলক ও আত্ম-উন্নয়নমূলক বইয়ের মুখোমুখি হয়। Man’s Search for Meaning তার মধ্যে নিঃসন্দেহে একটি।

দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধের পরে প্রকাশিত হওয়া বইটির সাথে আমার সাক্ষাৎ বেশ দেরি করেই হয় বটে! তবে বইটি হাতে পেয়ে কয়েকদিনের মধ্যে সমাপ্ত করার পর দু’য়েকদিন নিস্তব্ধ ছিলাম। নিস্তব্ধ ছিলাম ভিক্টর ফ্রাঙ্কলের জীবন আর জীবনের অর্থ নিয়ে বিষদ বিবরণের মুখোমুখি হয়ে। হরেক ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্যেও যে জীবনের অর্থ খুঁজে পাওয়া যায় কিম্বা জীবনের মর্যাদা সমুন্নত রাখা যায় তা তিনি বইটিতে নিজের জীবনে ঘটে যাওয়া অসহনীয় যন্ত্রণাদায়ক মুহূর্তগুলিকে বিখ্যাত বেশ কয়েকজন মানুষের উদ্ধৃতি দিয়ে নিজের উপস্থাপন করেছেন।

আমি প্রায় বলে থাকি যে দু’টি বই (শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের পার্থিব ও কাজী নজরুল ইসলামের মৃত্যুক্ষুধা) আমাকে রীতিমতো বাকরুদ্ধ করে রেখেছিল তার মধ্যে Man’s Search for Meaning বইটিও সংযুক্ত করা যায়। জীবনের অর্থ সন্ধানে ভিক্টর ফ্রাঙ্কলের উদ্ভাবিত তত্ত্ব লগোথেরাপি যেকারো জীবন বদলে দেওয়ার সামর্থ্য রাখে।

আশা রাখি বইটি জীবন সম্পর্কে মানুষের ধারণার আমূল পরিবর্তন সাধিত করবে। বই-ই হোক মানুষের সৃষ্টিশীলতার পাথেয়।   

ভূমিকা: Man’s Search for Meaning Bangla

ভিক্টর ফ্রাঙ্কলের Man’s Search for Meaning বইটি আমাদের সময়ের বিখ্যাত বইগুলির মধ্যে একটি। সাধারণত, যদি কোনও বইয়ে এমন কোনো অংশ যাতে থাকে কোনো মানুষের জীবন বদলে দেওয়ার মতো ক্ষমতা তাহলে বইটি বারংবার পড়ার ও নিজের বইয়ের তাকে জায়গা করে নেওয়ার অধিকার প্রতিপাদন করে। বইটিতে এরকম বেশ কয়েকটি অংশ রয়েছে।

সর্বাগ্রে এটি একটি বেঁচে থাকার বিষয়ে বই। অনেক জার্মান এবং পূর্ব ইউরোপীয় ইহুদি যারা কেবল নিজেদেরকে সুরক্ষিত মনে করেছিল, ফ্র্যাঙ্কল তাদের মতো একজন যাকে নাৎসি বন্দী এবং উচ্ছেদ শিবিরের অন্তর্জালে ফেলে দেওয়া হয়েছিল। বাইবেলের কথা “অগ্নি হইতে উদ্ধৃত অর্ধদগ্ধ কাষ্ঠস্বরূপ” এর মতো তিনি বেঁচে গিয়েছিলেন। তারপরও বইটি তার বেঁচে থাকার যন্ত্রণা, কষ্টভোগ ও ক্ষয়ক্ষতির চেয়েও তার বেঁচে থাকার শক্তির উৎস সম্পর্কে একটি বিবরণ। বইটিতে ফ্রাঙ্কল জার্মান দার্শনিক ফ্র্যড্রিক নিটসের উদ্ধৃতি He who has a Why to live for can bear almost any How অর্থাৎ যার ‘কেন’ বেঁচে থাকতে হবে তার কারণ রয়েছে সে প্রায় যে কোন ‘উপায়ই’ সহ্য করতে সক্ষম। তিনি শানিতভাবে  বর্ণনা করেছেন যে, কারাবন্দীদের যারা জীবনের উপর আশা ছেড়ে দিয়েছিলো, যারা হারিয়েছিল ভবিষ্যতের সব আশা-প্রত্যাশা আর তারাই অনিবার্যভাবে মারা গিয়েছিল। খাবার আর ঔষধ-পত্রের সংকটের চেয়েও তারা মারা গেছে আশা-প্রত্যাশা আর বেঁচে থাকার জন্য কোন কিছু না থাকার দরুন। অপর দিকে, ফ্র্যাঙ্কল যুদ্ধের পর তার স্ত্রীকে দেখতে পাওয়ার চিন্তাকে জাগ্রত  আর যুদ্ধের পর অশউইৎয শিবির থেকে লব্ধ অভিজ্ঞতার উপর মনস্তাত্ত্বিক বিষয়ে শিক্ষা প্রদানের স্বপ্নে দেখার মধ্য দিয়েই তিনি নিজেকে বাঁচিয়ে রেখেছিলেন। স্পষ্টতই যে বন্দীরা বেপরোয়া-ভাবে বেঁচে থাকতে চেয়েছিল তারা মারা গিয়েছিল, কেউ ব্যাধিয় আর কেউ কেউ  শব-চুল্লিতে। তবুও, ফ্রাঙ্কল ‘কেন অনেকেই মারা গিয়েছে’ সে প্রশ্নে বিচলিত হওয়ার চেয়ে ‘কেনো কেউ বেঁচে থেকেছে’ সে প্রশ্নে বিচলিত ছিলেন। 

অশউইৎয (Auschwitz) শিবিরে তাঁর ভয়াবহ অভিজ্ঞতা ইতিমধ্যেই তার অন্যতম মূল ধারণাকে আরও শক্তিশালী করে তুলে। জীবন মানে মূলত আনন্দের সন্ধান  করা নয়, যেমন সিগমুন্ড ফ্রয়েড বিশ্বাস করেছেন, বা আলফ্রেড অ্যাডলারের মতে ক্ষমতা বা প্রতিপত্তির সন্ধানও নয়, বরং তার অর্থের সন্ধান করা। কারও জীবনে মহান বা মহৎ কাজ হলো তার জীবনের অর্থ সন্ধান করা। জীবনের সে অর্থের পেছনে ফ্র্যাঙ্কল তিনটি সম্ভাব্য উৎস লক্ষ্য করেন: কর্ম (কারো জন্য অর্থবহ কোন কিছু করা), ভালবাসা ( কারো প্রতি প্রতি যত্নশীল  হওয়া, যেমনটা ফ্রাঙ্কল অশউইৎয শিবিরে কঠিন সময়ের মাঝেও তার স্ত্রীর ছবিটি আঁকড়ে ধরে রেখেছিলেন), এবং কঠিন সময়ে মনোবল। যন্ত্রনাভোগ ও যন্ত্রণা নিতান্তই অর্থহীন; তবে যন্ত্রণার প্রতি আমারা কিরূপ সাড়া দিয়ে থাকি তার উপরই নির্ভর করে এর অর্থ। এক পর্যায়ে তিনি লিখেন যে, “একজন মানুষ সাহসী, মর্যাদাপূর্ণ এবং নিঃস্বার্থ থাকতে পারে বা আত্মরক্ষার তিক্ত লড়াইয়ে সে তার মানবিক মর্যাদাকে ভুলে গিয়ে পশুতেও রূপান্তরিত হবে পারে।” তিনি স্বীকার করেন যে নাৎসি বন্দীদের খুব কম লোকই মর্যাদাপূর্ণ এবং নিঃস্বার্থ থাকতে পেরেছে, “তারপরও মানুষের আভ্যন্তরীণ শক্তি যে  তাকে তার বাহ্যিক পরিণতির ঊর্ধ্বে উপস্থাপন করতে পারে তা প্রমাণ করার জন্য তেমনি একটি মাত্র উদাহরণই যথেষ্ট”।

পরিশেষে, ফ্রাঙ্কলের সবচেয়ে স্থায়ী অন্তর্দৃষ্টি, যা আমি প্রায়শই আমার নিজের জীবন ও চিকিৎসা পরামর্শ বা কাউন্সেলিং পরিস্থিতিতে অসংখ্যবার পেশ করেছি: আপনার নিয়ন্ত্রণের বাইরের শক্তি হয়তো আপনার সবকিছুই কেড়ে নিতে পারে কেবল একটি জিনিস ব্যতীত, আর তা হলো কোন পরিস্থিতিতে আপনি কিভাবে সাড়া দিবেন তা নির্বাচন করার স্বাধীনতা। আপনার জীবনে যা কিছু ঘটে আপনি নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন না, কিন্তু আপনার জীবনে যা ঘটে যায় তার প্রতি আপনার অনুভূতিকে আপনি নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন।

আমেরিকান নাট্যকার আর্থার মিলের Incident of Vichy নাটকের এক দৃশ্যে দেখা যায় যে উচ্চ-মধ্য-শ্রেণীর একজন পেশাজীবীকে তার শহরটি ধকল করা নাৎসি কর্তৃপক্ষের সামনে উপস্থিত হয়ে তার বিশ্ববিদ্যালয় প্রশংসাপত্র, বিখ্যাত ব্যক্তিদের সকল পরিচয়পত্র প্রদর্শন করতে দেখা যায়। তাতে নাৎসি কর্তৃপক্ষ জিজ্ঞেস করেন, এর সবকিছুই কি তোমার? তিনি মাথা নেড়ে বললেন হ্যাঁ। নাৎসি কর্তৃপক্ষ তখন সবকিছু ময়লার ঝুড়িতে নিক্ষেপ করে বলেন ‘চমৎকার, তোমার এখন কিছুই নেই’।

লোকটি, যার আত্মসম্মান সর্বদা অন্যের শ্রদ্ধার উপর নির্ভরশীল ছিল, আবেগগতভাবে বিপর্যস্ত হয়। ফ্রাঙ্কলের বিতর্ক হলো যে যতক্ষণ না আমাদের কোনো পরিস্থিতিতে আমরা কিভাবে প্রতিক্রিয়া জানাব তা নির্বাচন করার স্বাধীনতা বজায় থাকে ততক্ষণ কেউ আমাদের কাছ থেকে সর্বস্ব ছিনিয়ে নিতে পারে না।

আমার নিজস্ব মণ্ডলীর অভিজ্ঞতা আমাকে ফ্রাঙ্কেলের অন্তর্দৃষ্টির সত্যতা প্রমাণ করেছে। আমি এমন সব সফল ব্যবসায়ীদের চিনতাম যারা অবসর নেওয়ার পর পর-ই জীবনের সমস্ত উৎসাহ-উদ্দীপনা হারিয়ে ফেলে। তাদের কাজই তাদের জীবনকে অর্থবহ করে তুলে। প্রায়শই তাদের কাজই তাদের জীবনকে অর্থ প্রদান করে আর কাজহীন অবসরে তারা দিনের পর দিন হতাশায় বসে দিনযাপন করে। আমি এমনও লোকদের চিনি যারা চূড়ান্তভাবে সবচেয়ে ভয়াবহ যন্ত্রণা ও পরিস্থিতির মধ্যদিয়ে যাওয়ার চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করেছিলেন যতক্ষণ তারা বিশ্বাস করেছিল যে তাদের দুঃখকষ্টের মধ্যে কোন অর্থ রয়েছে। হতে পারে তা কোনো পারিবারিক মাইলফলক যে তারা দীর্ঘদিন বেঁচে থাকতে চেয়েছিল বা তাদের দুঃখকষ্ট পর্যবেক্ষণের পর ডাক্তারদের সন্ধান পাওয়ার নিরাময়ের সম্ভাবনাকে জানিয়ে দিতে তাদের বেঁচে থাকার ‘কারণ’ই তাদের ‘কিভাবে’ বাঁচতে হয় তার সক্ষমতা দান করেছে।

আর ফ্রাঙ্কলের অভিজ্ঞতার সাথে আমার নিজের অভিজ্ঞতা প্রতিধ্বনিত হয়  অন্যভাবে। যেমনটি আমার লিখা When Bad Things Happen to Good People বইয়ের চিন্তা-ধারা সমূহ শক্তি ও বিশ্বাসযোগ্যতা অর্জন করতে সমর্থ হয়, তা কারণ আমাদের ছেলের অসুস্থতা ও মৃত্যুকে অনুধাবন করতে আমাদের সংগ্রামকে কেন্দ্র করে পেশ করা হয়েছিল, তেমনি অর্থবহ জীবনের প্রতি ধাবিত করে অন্তরাত্মার সুস্থতার জন্য ফ্রাঙ্কলের logotherapy বা লগোথেরাপি বা মর্ম-চিকিৎসা মতবাদ অশউইৎয বন্দী শিবিরের যন্ত্রণাময় পরিস্থিতি ব্যতিরেকে  বিশ্বাসযোগ্যতা অর্জন করে। প্রথম অংশটি ব্যতীত বইটির শেষার্ধটি হবে খুব কমই অর্থবহ।

আর ফ্রাঙ্কলের অভিজ্ঞতার সাথে আমার নিজের অভিজ্ঞতা প্রতিধ্বনিত হয়  অন্যভাবে। যেমনটি আমার লিখা When Bad Things Happen to Good People বইয়ের চিন্তা-ধারা সমূহ শক্তি ও বিশ্বাসযোগ্যতা অর্জন করতে সমর্থ হয় কারণ আমাদের ছেলের অসুস্থতা ও মৃত্যুকে অনুধাবন করতে আমাদের সংগ্রামকে কেন্দ্র করে পেশ করা হয়েছিল, তেমনি অর্থবহ জীবনের প্রতি ধাবিত করে অন্তরাত্তার সুস্থতার জন্য ফ্রাঙ্কলের logotherapy বা লগোথেরাপি বা মর্মচিকিৎসা মতবাদ অশউইটয বন্ধি শিবিরের যন্ত্রনাময় পরিস্থিতি ব্যতিরেখে  বিশ্বাসযোগ্যতা অর্জন করে। প্রথম অংশটি ব্যতিত বইটির শেষার্ধটি হবে খুব কমই অর্থবহ।

আমার কাছে খুব গুরুত্বপূর্ণ মনে হয় যে বিখ্যাত মনোবিজ্ঞানী ড. গর্ডন আলপোর্ট  Man’s Search for Meaning এর ১৯৬২ সংস্করণের ভূমিকাটি লিখেছিলেন, আর একজন ধর্মযাজকই এই পুনঃ-সংস্করণের ভূমিকাটি লিখেছেন। আমরা অনুধাবন করতে সমর্থ হয়েছি যে নিগূঢ়ভাবে এটি একটি ধর্মীয় বই। যে, জীবন যে অর্থবহ এবং আমাদের পরিস্থিতি সত্ত্বেও আমাদের জীবনকে যে অর্থ-পূর্ণভাবে দেখা দরকার তার দিকে বইটি বিশেষ জোর দেয়।  যে জীবনের চূড়ান্ত উদ্দেশ্য রয়েছে। আর এর আসল সংস্করণে, পরিশিষ্ট যুক্ত হওয়ার পূর্বে, ভূমিকাটি বিংশ শতাব্দীর সবচেয়ে অধিক লিখিত ধর্মীয় ব্যাখ্যা দিয়ে সমাপ্ত হয়

আমার কাছে খুব গুরুত্বপূর্ণ মনে হয় যে বিখ্যাত মনোবিজ্ঞানী ড. গর্ডন আলপোর্ট  Man’s Search for Meaning এর ১৯৬২ সংস্করণের ভূমিকাটি লিখেছিলেন, আর একজন ধর্মযাজকই এই পুনঃ-সংস্করণের ভূমিকাটি লিখেছেন। আমরা অনুধাবন করতে সমর্থ হয়েছি যে নিগূঢ়ভাবে এটি একটি ধর্মীয় বই। যে, জীবন যে অর্থবহ এবং আমাদের পরিস্থিতি সত্ত্বেও আমাদের জীবনকে যে অর্থ-পূর্ণভাবে দেখা দরকার তার দিকে বইটি বিশেষ জোর দেয়।  যে জীবনের চূড়ান্ত উদ্দেশ্য রয়েছে। আর এর আসল সংস্করণে, পরিশিষ্ট যুক্ত হওয়ার পূর্বে, ভূমিকাটি বিংশ শতাব্দীর সবচেয়ে অধিক লিখিত ধর্মীয় ব্যাখ্যা দিয়ে সমাপ্ত হয়

আমার কাছে খুব গুরুত্বপূর্ণ মনে হয় যে বিখ্যাত মনোবিজ্ঞানী ড. গর্ডন আলপোর্ট  Man’s Search for Meaning এর ১৯৬২ সংস্করণের ভূমিকাটি লিখেছিলেন, আর একজন ধর্মযাজকই এই পুনঃ-সংস্করণের ভূমিকাটি লিখেছেন। আমরা অনুধাবন করতে সমর্থ হয়েছি যে নিগূঢ়ভাবে এটি একটি ধর্মীয় বই। যে, জীবন যে অর্থবহ এবং আমাদের পরিস্থিতি সত্ত্বেও আমাদের জীবনকে যে অর্থ-পূর্ণভাবে দেখা দরকার তার দিকে বইটি বিশেষ জোর দেয়।  যে জীবনের চূড়ান্ত উদ্দেশ্য রয়েছে। আর এর আসল সংস্করণে, পরিশিষ্ট যুক্ত হওয়ার পূর্বে, ভূমিকাটি বিংশ শতাব্দীর সবচেয়ে অধিক লিখিত ধর্মীয় ব্যাখ্যা দিয়ে সমাপ্ত হয়:

আমাদের প্রজন্ম বাস্তবাদী, কারণ আমরা মানুষের প্রকৃত রূপ জেনেছি।
সর্বোপরি, মানুষই হলো সেই সত্তা যে অশউইটয এর গ্যাস চেম্বার উদ্ভাবন করেছে;
তথাপি, সমুন্নত শীরে প্রভুর প্রার্থনা বা শ্যামা ইসরাইল মুখে
যারা সেই গ্যাস চেম্বারে প্রবেশ করেছে তারাও সে একই সত্তা।

হ্যারল্ড এস. কুশের
বিশিষ্ট আমেরিকান রেবাই

১৯৯২ সংস্করণে লেখকের ভূমিকা

আজ পর্যন্ত অন্যান্য ২১টি ভাষার প্রকাশনা সহ বইটির শ খানেক প্রকাশনা হয়েছে ইংরেজি ভাষায়। আর কেবল ইংরেজি সংস্করণই ৩০ লক্ষ্য সংখ্যা বিক্রি হয়েছে।

এগুলি শুকনো তথ্য, এবং এ কারণেই সম্ভবত আমেরিকান সংবাদপত্র এবং বিশেষত আমেরিকান টিভি স্টেশনের সাংবাদিকরা তাদের ঘনঘন সাক্ষাতকারে , এই তথ্য তালিকাভূ্ক্তির পর বিস্মিত হয়ে শুরু করেন: “ড. ফ্র্যাঙ্কল, আপনার বইটি একটি সত্যিকারের বেস্টসেলারে পরিণত হয়েছে – এই সাফল্য সম্পর্কে আপনার অনুভূতি কি? এতে আমি প্রতিক্রিয়া করে বলি যে প্রথমত: আমি আমার বইয়ের বেস্টসেলার অবস্থানকে আমি কোনো কৃতিত্ব আর অর্জন বলে মনে করি না, বরং মনে করি এটি একটি আমাদের সময়ের দুঃখ-যন্ত্রণার একটি বহিঃপ্রকাশ: যার শিরোনামই জীবনের অর্থের প্রশ্নের সাথে মুখোমুখে হওয়ার প্রতিশ্রুতি দেয় এমন একটি বই হাজার হাজার মানুষের কাছে পৌঁছে যায়, তাহলে বুঝতে হবে প্রশ্নটি খুবই জরুরী।

বস্তুত, অন্য কিছু হয়তো বইটির প্রভাব বিস্তার লাভের কারণ: বইটির দ্বিতীয় অংশের তাত্ত্বিক অংশটি ( সংক্ষেপে লগোথেরাপি) বইটির প্রথম অংশের আত্মজীবনীমূলক বর্ণনা (বন্দী শিবিরের অভিজ্ঞতা) থেকে কারো সম্ভাব্য শিক্ষায় পরিণত হয়, যেমনটি লক্ষ্য করা যায়, যেখানে  দ্বিতীয় অংশটি আমার তত্ত্বের অস্তিত্ত্বগত বৈধতার কারণ হিসেবে কাজ করে। তাই, উভয় অংশই পরস্পরের বিশ্বস্ততার সমর্থক।

১৯৪৫ সালে যখন আমি বইটি লিখেছিলাম তার কিছুই আমার মাথায় ছিলনা। আর পরপর ৯দিনেই বইটি লিখে শেষ করি ও বেনামে বা নাম-হীনভাবে প্রকাশ করার জন্য দৃঢ় সংকল্পবদ্ধ থাকি। বস্তুত, জার্মান ভাষার মূল সংস্করণে আমার নাম নেই, যদিও শেষ মুহূর্তে বইটির প্রাথমিক প্রকাশনার পূর্বে আমার বন্ধু-বান্ধব যারা বইটির শিরোনাম পৃষ্ঠার আমার নাম ছাপিয়ে প্রকাশ করার জন্য জোরাজুরি করছিল তাদের কাছে ধরাশায়ী হয়ে পড়ি। প্রথম দিকে যদিও পরম প্রত্যয়ের নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ একটি সাহিত্য কর্ম হিসেবে এটি লিখা হয়েছিল যে বইটি কখনো লেখকের জন্য সাহিত্য পরিচিতি বয়ে আনবে না। আমি শুধু চেয়েছিলাম একটি মূর্ত উদাহরণের মাধ্যমে পাঠকদের কাছে উপস্থাপন করতে যে, যে কোনো পরিস্থিতিতেও জীবনে সম্ভাব্য অর্থ বজায় থাকে, হোক তা কোনো সবচেয়ে যন্ত্রণাদায়ক পরিস্থিতি। আর আমি ভেবেছিলাম যদি সেই অর্থকে বন্দী শিবিরের মতো কোনো অবস্থায় উপস্থাপন করা যায় তাহলে হয়তো আমার বইটির কথা মানুষ শুনবে। তাই আমি যে পরিস্থিতির মধ্যদিয়ে গিয়েছি তা লিখে রাখার দায়বদ্ধতা অনুভব করলাম কারণ আমি ভেবেছিলাম যারা জীবনে হতাশার মধ্যদিয়ে জীবন-যাপন করছে তাদের কাছে হয়তো উপকারে আসবে।  

আর তাই এটি আমার কাছে আশ্চর্যজনক এবং লক্ষণীয় উভয়ই এই জন্য যে—আমার লিখা কয়েক ডজন বইয়ের মাঝে— এই বইটি যা আমি বেনামে প্রকাশ করার ইচ্ছা পোষণ করেছিলাম যাতে এটি কখনই লেখকের পক্ষে কোনও খ্যাতি বয়ে না আনতে পারে,আর সেটিই হয়ে গেলে একটি সফল বই। বার বার আমি তাই ইউরোপ এবং আমেরিকায় আমার শিক্ষার্থীদের বারংবার উপদের দেয় : যে “সাফল্যের দিকে লক্ষ্য রেখো না—যতই তুমি এর দিকে লক্ষ্য রাখবে ও এটিকে লক্ষ্যবস্তু হিসেবে পরিণত করবে, ততই তোমরা লক্ষ্যভ্রষ্ট হবে। কারণ সুখের ন্যায়, সাফল্যকে অনুসরণ করা যায় না; সাফল্যকে আহরণ করা চাই আর এটি কেবল তার চেয়ে বেশি কারণের প্রতি নিজের চেয়ে মহৎ কোনো কাজে উৎসর্গের অনিচ্ছাকৃত পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়া বা নিজের চেয়ে মহৎ কোনো ব্যক্তির নিকট আত্মসমর্পণের অপ্রত্যাশিত ফল বা উপজাত হিসেবে ঘটে।  সুখ অবশ্যই আসবে, আর সাফল্যের ক্ষেত্রেও একই হয়ে থাকে: উদ্বিগ্ন না হয়ে এটিকে সংঘটিত হতে দিতে হবে। আমি চাই আপনার বিবেক আপনাকে যা করতে আদেশ করে তার দিকে লক্ষ্য রাখুন এবং যতদূর সম্ভব সর্বোচ্চটা দিয়ে তা চালিয়ে যান। তারপর আপনি দেখবেন শেষ পর্যন্ত, আমি বলেছি শেষ পর্যন্ত, সফলতা আপনাকে অনুসরণ করছে কারণ আপনি সফলতা সম্পর্কে ভুলে গেছেন”।

পাঠকেরা সম্ভবত জিজ্ঞেস করতে পারে হিটলার অস্ট্রিয়া দখল করার পর আমার ভাগ্যে যা এসে পড়েছিল তা থেকে কেনো আমি পালিয়ে যেতে চেষ্টা করিনি। নিচের কাহিনী স্মরণ করার মাধ্যমে সে প্রশ্নের উত্তর দেই। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ভিয়েনায় আমেরিকান দূতাবাস থেকে অভিবাসন ভিসা গ্রহণ করার জন্য আমি একটি আমন্ত্রণ পাই। শীঘ্রই আমাকে অস্ট্রিয়া ত্যাগে অনুমতি দেওয়া হবে প্রত্যাশায় আমার বৃদ্ধ বাবা-মা অতি-উৎফুল্ল হয়েছিলেন। যদিও হঠাৎ আমি ইতস্তত: হই। একটি প্রশ্ন আমাকে দারুণভাবে প্রভাবিত করে: আমি কি আসলেই আমার বাবা-মাকে একা করে তাদের পরিণতির মুখোমুখি করে চলে যেতে পারি, যাদের কিছু আগে বা পরে বন্দী শিবির বা তথাকথিত নির্মূল শিবিরে পাঠিয়ে দেওয়া হবে ? একটি উর্বর ভূমি যেখানে আমি আমার অনেক বই লিখতে পারতাম সেখানে গিয়ে কি আমার উদ্ভাবন, লগোথেরাথির লালন করার উচিৎ? অথবা আমার কি উচিৎ একজন প্রকৃত সন্তান হিসেবে আমার কর্তব্যের দিকে মনোনিবেশ করা, যে সন্তান তার বাবা-মাকে সুরক্ষা করতে যাই প্রয়োজন তাই করতে প্রস্তুত? বিভিন্নভাবে আমি সমস্যাটি নিয়ে চিন্তা করেও কোনো সমাধানে পৌঁছাতে পারিনি; এ ধরনের দ্বিধাগ্রস্থতাই কাউকে যেমন কথায় আছে ‘স্বর্গ থেকে আসা ইঙ্গিত’ পাওয়ার প্রত্যাশা করতে বাধ্য করে।

আর ঠিক তখনই আমি লক্ষ্য করলাম ঘরের এক টেবিলে একটি মার্বেল পড়ে আছে। আমার বাবার কাছে মার্বলটি সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন ন্যাশনাল সোশালিস্টরা যেখানে ভিয়েনা-বাসী সবচেয়ে বৃহৎ সিনাগগ পুড়িয়ে ফেলেছিল সেখানেই তিনি মার্বেলটি খুঁজে পেয়েছেন। তিনি তা কুড়িয়ে বাসায় নিয়ে আসলেন কারণ সেটি ছিল মূসার কাছে দেওয়া মহান দশ আজ্ঞা খুদায় করা ফলকের একটি অংশ। স্বর্ণাক্ষরে তাতে একটি ইব্রিয় ভাষার বর্ণ খুদায় করা ছিল: আমার বাবা আমাকে বলেন যে সে বর্ণটি ছিল দশ আজ্ঞার এক আজ্ঞা। আগ্রহের সাথে আমি জানতে চাইলাম “কোন আজ্ঞাটি”? “তোমাদের মা-বাবাকে সম্মান করে চলবে। তাতে প্রতিজ্ঞাত দেশে তোমরা অনেক দিন বেঁচে থাকবে”। সেই মুহূর্তেই আমি দেশে আমার আমার বাবা-মার সাথে থেকে যেতে সিদ্ধান্ত নিলাম আর আমেরিকার ভিসা অতিক্রান্ত হতে দিলাম।

ভিক্টর ই. ফ্রাঙ্কল
ভিয়েনা, ১৯৯২

বন্দী শিবিরে আমার অভিজ্ঞতা

এই বইটি শিবিরে ঘটে যাওয়া সমস্ত প্রকৃত ঘটনার বর্ণনা বলে দাবি করে না। তবে এটি একটি লাখ লাখ মানুষ বার বার যে অভিজ্ঞতার শিকার হয়েছিল তার একটি ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার বর্ণনা। এটি একটি হাজার হাজার বন্দীদের মধ্য থেকে বেঁচে থাকা একজন মানুষের শিবিরের অভ্যন্তরীণ কাহিনী। আর এই কাহিনীটি শিবিরে ঘটে যাওয়া মহা ভয়াবহতা সম্পর্কেও নয়, যার সম্পর্কে অনেক কিছু লিখা হলেও খুব কমই মানুষ আমলে নিয়েছে। তাই এই কাহিনীটি আসলে শিবিরে ঘটে যাওয়া অনেক ছোট ছোট ঘটনার বিবরণ। অন্য অর্থে, একটি বন্দী শিবিরের দৈন্দিন জীবন-যাপন সাধারণ বন্ধীদের মনে কিভাবে প্রতিফলিত হয়েছিল সে প্রশ্নে উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করবে।

এখানে বর্ণিত অনেক ঘটনা বড় বড় ও বিখ্যাত শিবিরে ঘটেনি। তবে ছোট ছোট শিবিরগুলিতেই সবচেয়ে বেশি ইহুদি নিধনের ঘটনা ঘটেছিল। এটি কোনো মহান বীর বা শহীদদের যন্ত্রণা ও মৃত্যুর কাহিনী নয়, নয় কোনো বিশিষ্ট ক্যাপুদের বর্ণনা। ক্যাপুরাও ছিল আমাদের মতো কয়েদি। কিন্তু তারা জার্মান কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে বিশেষ সুবিধা নিয়ে তাদের বিশ্বস্ত লোক হিসেবে কাজ করতো। কয়েদি হিসেবে তারা ছিলো সুপরিচিত। তাই বইটি কক্ষতাশালী মানুষের দুর্ভোগের সাথে তেমন সম্পৃক্ত নয়। তবে বইটি দুর্ভোগ আর নিঃসংতার বলি হওয়া অপরিচিত ও তালিকাহীন বহুসংখ্যক মানুষের ত্যাগ, নির্যাতন আর মৃত্যুর সাথে সম্পৃক্ত। এই অপরিচিত ও তালিকাহীন সাধারণ বন্দীরা জামার হাতায় আলাদা কোনো চিহ্ন বহন করেনি। আর যাদের ক্যাপুরা সত্যিকার অর্থে অনেক ঘৃণা করতো। এই সাধারণ বন্দীদের যখন খাবারের স্বল্পতা দেখা দিত বা কিছুই থাকতো না, তখন ক্যাপুদের ক্ষুধার্ত হয়নি। সত্যি বলতে অনেক ক্যাপুদের অবস্থা এমন ভালো ছিল যে, যা তাদের সারাজীবনে কখনও ছিল না। অনেক সময় সাধাণ বন্দীদের প্রতি তারা SS বা (চুটচাফল) জার্মান কর্তৃপক্ষের কারারক্ষীদের চেয়েও নিষ্ঠুর ছিল। SS বাহিনীর লোকদের চেয়ে নিষ্ঠুরভাবে তারা বন্দীদের মার-ধর করতো। এসব ক্যাপুদের বন্দীদের মাঝ থেকে থেকে এইরকম পরিস্থিতিতে উপযোগী ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন লোকদের বেছে নেয়া হতো। আর ক্যাপুরা যদি জার্মান কর্তৃপক্ষের প্রত্যাশানুযায়ী তাদের বাধ্য না থাকতো, তাহলে সাথে সাথে তাদের পদবীর অবনতি ঘটতো। তাই তারা খুব অল্প সময়ের মধ্যেই অনেকটা SS’র লোক ও শিবির পরিচালকদের মতো হয়ে উঠতো। আর তদেরও একই মনস্তাত্ত্বিক বা মানসিক উপাদানে বিচার করা হতো।  

একজন বাইরের কারো পক্ষে শিবির-জীবন সম্পর্কে ভুল ধারণা পোষণ করা সহজ। তার ধারণা হতে পারে অনুভূতি আর করুণা মিশানো। কারণ বন্দীদের মাঝে বিদ্যমান বেঁচে থাকার কঠোর সংগ্রাম সম্পর্কে তার ধারণা নেই। আর তাদের কাছে দৈনন্দিন জীবনে এই নিরলস সংগ্রাম ছিল প্রতিদিনের খাবারের জন্য। নিজের জীবনের জন্য, নিজের স্বার্থে বা একজন ভাল বন্ধুর সার্থে সংগ্রাম।

*****

বন্দীদের বহন করে নিয়ে যায় এমন একটি গাড়ির কথা ধরা যাক। গাড়িটির নির্দিষ্ট কিছু বন্দীকে এক শিবির থেকে অন্য শিবিরে বহন করে নিয়ে যাওয়ার আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন হয়ছিল। তবে মোটামুটিভাবে গাড়িটি কোথায় যাবে তা অনুমান করতে পেরেছিলাম। হয়তো বন্দীদের নিয়ে গাড়িটি কোনো এক গ্যাস চেম্বারে যাবে তাদের পুড়িয়ে মারার জন্য। কাজ করতে পারে না এমন অসুস্থ বা দুর্বল কয়েদিদের বাছাই করে গ্যাস চেম্বার আর শব-চুল্লি রয়েছে এমন একটি বড় শিবিরে পাঠিয়ে দেওয়া হতো। এই বাছাই করার সময় কয়েদিরা একে অন্যে বিরুদ্ধে বা দলে দলে বিচ্ছিন্নভাবে মারামারি করতো। মারামারি করার পেছেনে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বিষয় ছিল যেন সেই বাছাই করা মানুষের তালিকা থেকে তার নিজের নাম ও তার বন্ধুর নামটি বাদ পড়ে যায়। তবুও সবাই জানতো যে তালিকা থেকে কাউকে বাদ দিতে হলে তার জায়গায় অন্য কাউকে খুজে বের করতে হবে।

প্রতিটি গাড়িতে করে এক নির্দিষ্ট সংখ্যক বন্দীকে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। কোন গাড়িটি তাদের নিয়ে যাবে সেটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিলনা কারণ বন্দীদের সবাইকে কোনো একটি সংখ্যা ব্যতীত কোনো কিছুই মনে করা হতো না। শিবিরে প্রবেশের সময় (অন্তত অশউইৎয শিবিরে তাই করা হতো) নথিপত্র সহ তার কাছে থাকা সবকিছু বন্দীদের কেড়ে নিয়ে ফেলা হলো। সেইজন্যে প্রক্যেকেরই কোনো না কোনো কাল্পনিক নাম বা পেশা দাবি করার সুযোগ ছিল। আর বিভিন্ন অযুহাতে অনেকেই সত্যিকারের নাম বা পেশা লুকিয়ে কাল্পনি নাম বা পেশার কথা বলেছিল। শিবির কর্তৃপক্ষ শুধু বন্দীদের নাম্বার বা সংখ্যায় আগ্রহী ছিল। প্রায়শই: তাদের এই নাম্বারটি তাদের চামড়ায় উল্কি করে ও ট্রাউজার, জ্যাকেট বা কোটের নির্দিষ্ট কোন স্থানে সেলাই করে দেওয়া হতো। কোনো কারা রক্ষী কারো বিরুদ্ধে অভিযোগ করতে চাইলে সে শুধুই কয়েদির গায়ের বা কাপড়ে সেলাই করা নাম্বারটি দিকে তাকাতো। সে কখনও তার নাম জিজ্ঞেস করতো না। আর আমরা কতোই না সে তাকিয়ে থাকাকে ভয় পেতাম!

রওনা হওয়ার পথে পরিবহন বহরে ফিরে আসি। বহরের সে গাড়ির ভেতরে নীতি-নৈতিকতা নিয়ে ভাবার সময় বা ইচ্ছা কোনটাই সেখানে ছিল না। সবাই শুধু তার জন্য বাড়িতে অপেক্ষায় থাকা পরিবার ও বন্ধু-বান্ধবদের জন্য নিজেকে বাঁচিয়ে রাখার চিন্তায় মগ্ন। তাই কোনও সংকোচ ছাড়াই একে অন্যের জন্য গাড়িতে জায়গার ব্যবস্থা করে দিতো।

আমি যেমন আগেই বলেছি যে ক্যাপো বাছায়ের প্রক্রিয়াটি ছিল একটি নেগেটিভ বা নেতিবাচক প্রক্রিয়া। সবচেয়ে নির্দয়-নিষ্ঠুর বন্দীদের মাঝ থেকে একাজের জন্য তাদের বেছে নেওয়া হতো। যদিও তাতে কিছু কিছু স্বস্তিকর ব্যতিক্রমও ছিল। কিন্তু SS সদস্যদের দ্বারা পরিচালিত যাচাই-বাছাই প্রক্রিয়া ছাড়াও বন্দীদের মাঝে একধরনের আত্ম-নির্বাচনী পদ্ধতিও চালু ছিল সেখানে। বছরের পর বছর এক শিবির থেকে অন্য শিবিরে ঘুরে ঘুরে জীবন সংগ্রামে যারা সব ধরনের সংকোচ-বোধ হারিয়ে ফেলেছিল, কেবলমাত্র সেসস্ত বন্দীরাই নিজেদের বাঁচিয়ে রাখতে সক্ষম হয়েছিল। ন্যায় বা অন্যায় উপায়ে এমনকি জোর খাটিয়ে, চুরি আর বন্ধুদের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করে হলেও তারা নিজেদের বাঁচিয়ে রাখতে প্রস্তুত ছিল। আমরা যারা অনেক ভাগ্যবান, সম্ভাবনা বা অলৌকিক সাহায্যের কারণে সেখান থেকে ফিরে আসতে পেরেছিলাম, আমরা জানি যে আমাদের উত্তমটি ফিরে আসেনি।

বন্দী শিবির সম্পর্কে অনেক বাস্তব বিবরণের দলিল ইতিমধ্যে লেখা হয়েছে। এখানে তা যদি তা কারও ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার অংশ হয়ে থাকে তাহলে তা গুরুত্বপূর্ণ বলে বিবেচিত হবে। আর এই অভিজ্ঞতার প্রকৃত বৈশিষ্ট্য নিয়ে আমি পরবর্তীতে আলোচনা করবো। আমরা যারা এক সাথে শিবিরে বন্দী ছিলাম, তা তাদের বর্তমান প্রেক্ষাপটের আলোকে তাকে বোধগম্য করে তোলার চেষ্টা করবে। আর আলোচনাটি যারা কখনও কোনো শিবিরে যায়নি তাদের যে অল্প সংখ্যক মানুষ বেচে গিয়েছিল তাদের সম্পর্কে জানতে সাহায্য করবে। বুঝতে সাহায্য করবে শিবির থেকে মুক্ত হওয়ার পর তাদের জীবন-যাপন কতো কঠিন হয়ে উঠেছে। সাবেক এই বন্দীরা প্রায়শই বলে থাকে যে, “শিবিরের অভিজ্ঞতা সম্পর্কে কথা বলতে আমাদের ভালো লাগে না। কারণ যারা শিবিরে জীবন-যাপন করেছে তাদের কাছে সে অভিজ্ঞতার কোনো ব্যাখ্যা প্রয়োজন হয় না। আর, তখন আমাদের কি পরিস্থিতি ছিল এবং আমরা এখন কি পরিস্থিতি আছি তা কেউ বুঝতে পারবেন না”।

বিষয়টি নিষ্ঠার সাথে উপস্থাপন করা খুবই কঠিন, যেহেতু তার জন্য মনোবিজ্ঞানের মতে নির্দিষ্ট এক বৈজ্ঞানিক detachment বা নিরাসক্তি’র প্রয়োজন রয়েছে। কিন্তু, কয়েদী হয়েও কি একজন মানুষ তার প্রয়োজনীয় detachment বা আবেগ-কেন্দ্রিক পরিস্থিতি মোকাবিলার কৌশল বা নিরাসক্তি অর্জন করতে পারে? একজন বহিরাগত মানুষ নিরাসক্তি মেনে নিতে পারে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে এই নিরাসক্তি’কে মূল্যায়ন করার যোগ্যতা তার নাই। শিবিরে বন্দী থাকা মানুষটির তার যথাযথ মূল্যায়ন করতে সমর্থ। তার বিচার বস্তুনিষ্ঠ নাও হতে পারে; তার মূল্যায়ন হতে পারে অসঙ্গতিপূর্ণ। এটি একটি অবশ্যম্ভাবী বিষয়। এক্ষেত্রে তার জন্য আমাদের অবশ্যই নিরপেক্ষ হওয়া উচিৎ আর এধরনের বইয়ে এটাই প্রকৃত সমস্যা। মাঝে মাঝে আমাদের খুব অন্তরঙ্গ কিছু অভিজ্ঞতা সম্পর্কে কথা বলার সাহস থাকা দরকার। আমি শুধু আমার কয়েদী নাম্বারটি ব্যবহার করে বেনামে এই বই লিখতে মনস্থির করেছিলাম। কিন্তু পাণ্ডুলিপি সমাপ্ত হওয়ার পর আমি লক্ষ্য করে দেখলাম যে বেনামে প্রকাশের ফলে বইটি এর অর্ধেক মূল্য হারাবে। তাই ভাবলাম যে, আমার বিশ্বাস সম্পর্কে খোলাখুলি-ভাবে কথা বলার জন্য আমার সৎসাহস সঞ্চার প্রয়োজন। সেইজন্যে, আমার ভালো না লাগা সত্ত্বেও মানুষের কাছে শিবির জীবনের আমার ব্যক্তিগত মুহূর্তগুলি তুলে ধরতে রাজি হলাম।

এই বইয়ের বিষয়বস্তু থেকে প্রয়োজনীয় ধারনা লালন করার কাজ আমি পাঠকের কাছে ন্যস্ত করছি। বইয়ের বিষয়বস্তু সমূহ হয়তো কয়েদীদের বন্দী জীবনের মানসিক অবস্থা সম্পর্কে ধারণা দেওয়ার বেলায় অবদান রাখতে পারে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরে কয়েদিদের মানসিক অবস্থা নিয়ে অনুসন্ধান করা হয়েছিল। তাতে  আমাদের মাঝে “barbed wire sickness” বা “কাঁটাতার ব্যাধি” নামক একধরনের মানসিক রোগের লক্ষণ পাওয়া গিয়েছিল। ফরাসি মনোবিজ্ঞানী গিস্টাব ল্যাবুঁর বিখ্যাত উক্তি উদ্ধৃত দিয়ে আমি বলতে পারি যে, “psychopathology of the masses”, বা ‘গণ-মানুষের মনোরোগবিদ্যা’ সম্পর্কে আমাদের জ্ঞানকে সমৃদ্ধ করার জন্য আমরা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কাছে ঋণী। কারণ যুদ্ধের কারণে সৃষ্টি হয় স্নায়ু যুদ্ধ, আর তাতে সৃষ্টি হয় বন্দী শিবির”।

এই কাহিনীটি সাধারণ এক বন্দী হিসেবে শিবিরে আমার অভিজ্ঞতার কথা বলে। তারপরও উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো যে শেষের কয়েক সপ্তাহ ব্যতীত, আমি নিজে একজন মনোরোগ বিশেষজ্ঞ হওয়া সত্ত্বেও শিবিরে আমি একজন মনোরোগ বিশেষজ্ঞ বা এমনকি  মনঃচিকিৎসক  হিসেবে নিয়োগ পায়নি। ভাগ্যক্রমে আমার সহকর্মীদের কেউ কেউ নষ্ট কাগজের টুকরো থেকে তৈরি ব্যান্ডেজ প্রয়োগ করার প্রাথমিক-চিকিৎসা পদে নিয়োগ পেয়েছিলেন। কিন্তু আমার নাম্বার ছিল ১১৯,১০৪, আর অধিকাংশ সময় আমি খনন কাজ এবং রেল লাইন বসানোর কাজ করতাম। এক সময় আমার কাজ ছিল জলের নল বসানোর জন্য সড়কের নিচে একা একা সুড়ঙ্গ খনন করার। এই কাজে আমার দক্ষতার জন্য ১৯৪৪ সালের বড়দিনের ঠিক আগে আমাকে পুরস্কৃত করা হয়েছিল। পুরস্কার হিসেবে আমাকে একটি তথাকথিত ‘প্রিমিয়াম কুপন’ দেওয়া হয়েছিল। যে নির্মাণ সংস্থার কাছে আমাদের সত্যিকার অর্থে দাস হিসেবে বিক্রি করা হয়েছিল, সে সংস্থাটি কুপনগুলি প্রকাশ করেছিল। সংস্থাটি শিবির কর্তৃপক্ষকে প্রত্যেক কয়েদীর জন্য প্রতিদিন একটি নির্দিষ্ট মূল্য পরিশোধ করেছিল। প্রতিটি কুপনের জন্য সংস্থাটিকে পনের ফেনিগ বা পয়সা খরচ করতে হয়েছিল। একটি কুপন দিয়ে ছয়টি সিগারেট বিনিময় করা যেতো, যদিও কয়েক সপ্তাহ পর অনেক সময় তাদের মেয়াদ শেষ হয়ে যেতো। আমি বারোটি সিগারেট পরিমাণ মূল্যের একটি টোকেনের গর্বিত মালিক হয়ে গিয়েছিলাম পুরস্কারটি পাওয়ার পর। তবে তার চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে বিষয়টি তা হলো, বারোটি সিগারেটের বিনিময়ে বারোটি সুপ ক্রয় করা যেতো, আর অনাহারে থাকা মানুষদের জন্য বারোটি সুপ অনাহার থেকে মুক্তির উপায়।

সিগারেট খাওয়ার সুযোগটি আসলে ক্যাপোদের জন্যই সংরক্ষিত ছিল। তাদের জন্য নিশ্চিত সাপ্তাহিক কুপনের বরাদ্দ থাকতো। গুদাম বা কোনো কর্মশিবিরের দলনেতা হিসাবে কাজে নিয়োজিত কয়েদিরাও বিপজ্জনক কাজ করার বিনিময়ে কয়েকটি সিগারেট পেতো। তারপর যারা বেঁচে থাকার সব ইচ্ছা হারিয়ে জীবনের শেষ দিনগুলি “উপভোগ” করতে চেয়েছিল তাদের জন্য সিগারেট খাওয়া ছিল একমাত্র ব্যতিক্রম। সুতরাং, আমরা যখন কোন সহকর্মীকে তার নিজের সিগারেট ফুকতে দেখতাম, তখন আমরা বুঝে নিতাম যে ধৈর্য ধারণ করার জন্য শক্তির প্রতি সে বিশ্বাস হারিয়ে-ফেলেছে। আর নিজের শক্তির প্রতি সে বিশ্বাস একবার চলে গেলে বেঁচে থাকার ইচ্ছা ফিরে আসে খুব কম।

অনেক কয়েদির মানসিক অবস্থা পর্যবেক্ষণ করে এবং তাদের অভিজ্ঞতা থেকে প্রাপ্ত একত্রিত করা বিশালাকারের তথ্যভাণ্ডার গবেষণা করলে শিবির জীবনের প্রতি কয়েদিদের মানসিক প্রতিক্রিয়ার তিনটি স্তর লক্ষ্য করা যায়: (ক) শিবিরে তার আগমনের পরের সময়, (খ) একজন কয়েদীর শিবির জীবনের সাথে ভালভাবে খাইখাইয়ে নেওয়ার সময় (গ) এবং শিবির থেকে তার মুক্তি ও মুক্তির পরের সময়।

কয়েদীদের shock বা প্রচণ্ড মানসিক ধাক্কা হলো প্রথম স্তরের একটি লক্ষণ। অনেক সময় এই মানসিক shock কয়েদীদের শিবিরে আগমনের আগে থেকেই থাকতো। উদাহরণ হিসেবে শিবিরে প্রবেশের সময় আমার নিজের অবস্থার কথা বলতে পারি।

একটি ট্রেন পনের শ কয়েদি নিয়ে কয়েক দিন কয়েক রাত ধরে ভ্রমণ করছিল। প্রতিটি বগিতে আশিজন করে মানুষ ছিল। সবাইকে তাদের অবশিষ্ট মাল-পত্রের লাগেজ ব্যাগের উপর শুয়ে পড়তে হয়েছিল। বগিসমূহ এতই ভর্তি ছিল যে শুধুমাত্র জানালার উপরের অংশ দিয়ে-ই ভোরের ধূসর আলো ভেতরে আসছিল। সবাই ধারণা করেছিল ট্রেনটি হয়তো কোনো যুদ্ধোপকরণ তৈরির কারখানার দিকে যাচ্ছে, যেখানে আমাদের জোর করে শ্রমে নিয়োগ করা হবে। আমরা বুঝতে পারিনি যে, সাইলেসিয়া না গিয়ে আমরা ইতিমধ্যেই পোল্যান্ড চলে এসেছি। ইঞ্জিনের হুইসলের ভূতুড়ে শব্দ শুনে মনে হচ্ছিল যেন তা অশুভ বোঝা নিয়ে ধ্বংসযজ্ঞের দিকে ধাবিত হওয়ার কারণে সমবেদনার সাথে সাহায্যের জন্য চিৎকার করছে। প্রধান এক স্টেশনের কাছে আসতেই ট্রেনটি লাইন পরিবর্তন করলো। হঠাৎ উদ্বিগ্ন যাত্রীদের সারিতে চিৎকার-চেঁচামেচি শুরু হলো, “সংকেত দেখা যাচ্ছে, ঐ-তো অশউইৎয শিবির!” সে মুহূর্তে সবার হৃদয়ের কম্পন এক মুহূর্তের জন্য থেমে যায়। অশউইৎয শিবির ছিল সকলপ্রকার ভয়াবহতার এক নাম, যেখানে ছিল গ্যাস চেম্বার,শব-চুল্লি, ও হত্যাকাণ্ড। ধীরে ধীরে, অনেকটা ইতস্ততভাবে এগিয়ে চলছে ট্রেনটি, মনে হচ্ছিল যেন ট্রেনটি যাত্রীদের অশউইৎয এর ভয়ানক অনুমান থেকে যতদূর সম্ভব দুরে রাখতে চাচ্ছে।

আসন্ন ভোরের সাথে সাথে শিবিরের বিশাল আকৃতি পরিষ্কার হয়ে উঠে। দীর্ঘ প্রন্তরজুড়া সারি সারি কাঁটাতারের বেড়া; নিরাপত্তা দুর্গ; সার্চলাইট; জরা-জীর্ণ মানুষের দীর্ঘ সারি, সবকিছুই। ধুসর ভোরের ধূসরতা সোজা নির্জন সড়কে বেয়ে বয়ে গেছে, কি জানি কোন গন্তব্যের পানে। কিছু বিচ্ছিন্ন চিৎকার আর বাঁশির আদেশ ছিল। তাদের কোনও অর্থই আমরা বুঝিনি তখন। আমার কল্পনায় আমি দেখতে পেলাম ফাঁসির মঞ্চ সমূহ, যেখানে ঝুলছে মানুষ। আমি ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পড়লামভ। ভয় পাওয়াটা ছিল স্বাভাবিক ব্যাপার, তবে ক্রমে ক্রমে, পদে পদে আমাদের শিবিরের ভীবৎস ও সীমাহীন ভয়াবহতার সাথে অভ্যস্ত হয়ে উঠতে হবে।

আমরা ষ্টেশনের ভেতরে ঢুকলাম। কারারক্ষিদের হুঙ্কার করা আদেশের কারণে প্রাথমিক নীরবতার বিগ্ন ঘটে। তখন থেকে, পুরো শিবির-জুড়ে বার বার আমাদের সেই রুক্ষ, কঠোর কণ্ঠস্বর শুনতে হয়েছিল। তাদের শব্দ ছিল অনেকটা কোন মৃত্যুদন্ডপ্রাপ্ত ভুক্তভোগীর শেষ চিৎকারের মতো। তবে তাতে একধরনের ভিন্নতাও বিদ্যমান। তাদের সেই চিৎকার ছিল মানুষকে উত্ত্যক্ত করার উগ্রতা মাখানো। শুনে মনে হতো তা যেন বার বার খুনের স্বীকার হওয়া একজন মানুষের মুখ থেকে বের হওয়া চিৎকার। ট্রেনটি থামতেই কোচের দরজাগুলি সজোরে খুলে দেওয়া হলো আর একদল কয়েদি সৈনিক ঝড়ের বেগে ভেতরে ডুকে পড়লো। তাদের গায়ে ছিল ডোরাকাটা উর্দি, মাথা ছিল কামানো, কিন্তু তারা দেখতে ছিল বেশ হৃষ্টপুষ্ট। তারা সবাই কিছুটা রসিকতার ছলে সম্ভাব্য সব ইউরোপীয় ভাষায় কথা বলছিল যা সে মুহূর্তে উদ্ভট শোনাচ্ছিল। তুচ্ছ কোনো বস্তুকে আঁকড়ে ধরা ডুবন্ত কোনো মানুষের মতো আমার সহজাত আশাবাদ এমন এক বেপরোয়া পরিস্থিতিতেও একটি ভাবনায় আটকে গেলো। ভাবলাম এই কয়েদিরা তো দেখতে মোটামুটি ভাল, তাদের দেখলে মনে হয় তারা খুব হাসি-খুশির মধ্যে আছে। কে জানে বাবা? আমারও হয়তো তাদের আনন্দদায়ক পরিস্থিতিকে ভাগ করে নেওয়ার কোনো ব্যবস্থা হবে।

মনোচিকিৎসায় “delusion of reprieve” বা স্বস্তি বিভ্রম নামে একটি মানসিক অবস্থা রয়েছে। কোনো অপরাধে অভিযুক্ত ব্যক্তি তার মৃত্যুদণ্ডের আগ মুহূর্তে ভেবে বিভ্রান্ত হয় যে, মৃত্যুদণ্ডের একেবারে শেষ মুহূর্তে হয়তো তার দণ্ডাদেশ স্থগিত করা হতে পারে। আমরাও টুকরো টুকরো আশাকে আঁকড়ে ধরেছিলাম আর বিশ্বাস করেছিলাম যে শেষ পর্যন্ত হয়তো অশউইৎয শিবির তেমনটা মন্দ হবেনা। সেইসব কয়েদিদের লাল গাল আর গোলাকার চেহারা সমূহ আমাদের কাছে এক উদ্দীপনার কারণ হয়ে উঠে। আমরা তখনও জানতাম না যে তারা ছিল বিশেষভাবে নির্বাচিত কয়েদিদের নিয়ে গঠিত একটি বিশেষ সৈন্য দল। তারা বছরের পর বছর দিনের পর দিন স্টেশনগুলিতে নতুন গাড়ি করে বহন করে নিয়ে আসা বন্দীদের গ্রহণকারী দল হিসেবে কাজ করছিলো। দলটি নতুন আগন্তুকদের এবং, দুষ্প্রাপ্য সামগ্রী আর কয়েদিদের দ্বারা গোপনে পাচার করে নিয়ে আসা গহনাগাঁটি সহ তাদের লাগেজের দায়িত্ব গ্রহণ করে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষ বছরগুলিতে সম্ভবত ইউরোপের এই অঞ্চলটার অশউইৎয ছিল এক অদ্ভুত জায়গা। সেখানে স্বর্ণ ও রোপা, প্লাটিনাম আর হীরার বিরাট খনি থাকতে পারে এখানে। শুধু বিশাল এই খনিতে নয়, বরং SS এর দখলেও থাকতে পারে অনেক মূল্যবান পাথর।

সম্ভবত দুই’শ মানুষ ধারণের জন্য নির্মিত একটি ছাউনিতে ঠাসাঠাসি করে পনের শ বন্দীকে জমায়েত করা হলো। আমরা ছিলাম শীতার্ত আর ক্ষুধার্ত, আর শুয়ে থাকা তো দূরের কথা উবু হয়ে বসে থাকার জন্যও সেখানে পর্যাপ্ত জায়গা ছিল না। চার দিনের মধ্যে পাঁচ আউন্স পরিমাণের একটুকরো রুটিই ছিল আমাদের একমাত্র খাবার। ছাউনিটির দায়িত্বে থাকা পুরনো কয়েদিদের সাথে অভ্যর্থনাকারী দলের এক সদস্যের সাথে প্লাটিনাম আর হীরার তৈরি একটি টাই-পিনকে কেন্দ্র করে দর কষাকষি করতে শুনতে পেলাম। কেনা-বেচার বেশিরভাগ লাভই অবশেষে ( schnapps) শ্ন্যাপ্স নামের এক ধরনের মদ কিনতে চলে যাবে। একটি ‘আনন্দঘন সন্ধ্যা’র জন্য প্রয়োজনীয় মানসম্পন্ন শ্ন্যাপ্স ক্রয় করতে কত হাজার জার্মান মুদ্রার প্রয়োজন হয়েছিল তা আমি আর মনে করতে পারছিনা। তবে আমি জানি যে বহুদিনের পুরনো কয়েদিদের শ্ন্যাপ্স মদের প্রয়োজন হতো। এরকম পরিস্থিতিতে মদের মাধ্যমে নিজেদের একটু উদ্দীপ্ত তোলার জন্য তাদের কে দোষারোপ করবে? সেখানে আবার এমনও একদল কয়েদি ছিল যাদের SS কর্তৃপক্ষ সীমাহীন পরিমাণে নেশাজাতীয় পানীয় সরবরাহ করতো। এই কয়েদিরা ছিলো গ্যাস চেম্বার আর শব-চুল্লিতে নিযুক্ত লোক। আর তারা জানতো যে একদিন পালা বদল হয়ে তারা তাদের কাজ থেকে অব্যাহতি পাবে। আর তাদের উপর চাপিয়ে দেয়া জল্লাদের ভূমিকা ত্যাগ করে নিজেদের হতে হবে অন্য জল্লাদের শিকার।

আমাদের গাড়ির প্রায় সবাই এই বিভ্রান্তিতে ছিল যে অবশেষে হয়তো তাদের শাস্তি মৌকুফ করা হবে ও সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে। আর এখন যে দৃশ্য দেখছি তার গোপন অর্থ আমরা বুঝতে করতে পারছিনা। একজন উচ্চপদস্থ SS কর্মকর্তার সামনে দিয়ে দ্রুত হেটে যাওয়ার জন্য ট্রেনের ভেতরে লাগেজ রেখে আমাদের দুই সারিতে দাঁড়াতে বলা হলো—এক পাশে মহিলা, অন্যপাশে পুরুষ। আশ্চর্যজনকভাবে, আমার পিটে বহন করার ব্যাগটি আমি পরিহিত কোটের নিচে লুকিয়ে রাখার সাহস করেছিলাম। একজন একজন করে আমার সারির সবাই কর্মকর্তাটির সামনে দিয়ে হেটে গেলো। আমি বুঝতে পারলাম যে আমার ব্যাগটি কর্মকর্তার নজরে পড়লে আমার বিপদ হবে। আমার পূর্বের অভিজ্ঞতা থেকেই আমি তা অনুমান করতে পেরেছিলাম। স্বাভাবিকভাবে, আমি নিজেকে সোজা রেখে কর্মকর্তার দিকে এগিয়ে গেলাম যেন সে আমার কোটের ভেতরে ভারি বোঝাটি লক্ষ্য করতে না পারে। তারপর আমি তার মুখোমুখি হলাম। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন উর্দিতে তিনি দেখতে ছিলেন এক লম্বা-চওড়া কৃশকায় মানব। আমরা যারা দীর্ঘ যাত্রার পর অগোছালো আর মলিন হয়ে পড়েছিলাম তাদের সাক্ষাতে কর্মকর্তার কি বৈপরীত্য! তিনি বাম হাত দিয়ে তার ডান কনুইয়ে ঠেস দিয়ে এক উদাসীন স্বাচ্ছন্দময় মনোভাব ধারণ করলেন। তাঁর ডান হাত ছিল উপরে উঠানো আর সেই হাতের আঙ্গুল দিয়ে অলস-ভাবে তিনি ডান বা বাম দিকে ইশারা করলেন। একজন মানুষের যখন-তখন ডানে-বামে আঙুলের ইশারা করার সেই হালকা গতিবিধির পেছনে লুকানো অশুভ অর্থ সম্পর্কে আমাদের কারও সামান্যতম ধারনাও ছিল না। কিন্তু খুব কমই তিনি বাম দিকে ইশারা করলেন।

আমার পালা আসলো। কেউ একজন আমাকে ফিসফিস করে বললো যে ডান পাশে পাঠিয়ে দেওয়ার অর্থ হলো কাজ। আর বাম পাশের সারি হলো কাজ করতে অক্ষম এমন অসুস্থদের জন্য, যাদের পরে বিশেষ এক শিবিরে পাঠিয়ে দেওয়া হবে। আমি কেবল অপেক্ষা করছিলাম যেন সবকিছু নিজের গতিতে চলে। আমার পেছনে বহন করার ব্যাগটি যা আমি কোটের নিচে লুকিয়ে রেখেছি তার ভারে আমার বাম পাশটা একটু কাত হয়ে যাচ্ছিল। কিন্তু আমি সোজা হয়ে হাটার চেষ্টা করলাম। SS কর্মকর্তাটি আমার দিকে তাকালেন, একটু ইতস্তত মনে হলো, তার হাতদুটো আমার কাদের উপর রাখলেন। আমি স্মার্ট দেখানোর কঠোর চেষ্টা করলাম, আর ধীরে ধীরে তিনি আমার কাঁদ ঘোরালেন যতক্ষণ না আমি ডান মুখি হই, আর আমি সে দিকে ঘুরলাম। তার হাতের আঙ্গুল দিয়ে এদিক-ওদিক খেলা করার অর্থ সে দিন সন্ধ্যায় আমার পরিষ্কার হয়েছিল। তার মানে তা ছিল প্রথম বাছাই, যাকে আমরা আমাদের অস্তিত্ব আর অস্তিত্বহীনতার পক্ষে প্রথম রায় বলতে পারি। আমাদের গাড়ির অধিকাংশ, নব্বই শতাংশ, লোকের কাছে এর মানে ছিল মৃত্যু। কারণ যারা বামপাশের সারিতে ছিল পরবর্তী কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই তাদের দণ্ডাদেশ কার্যকর করা হবে। যাদের বাম পাশের সারিতে পাঠানো হয়েছিল তাদের স্টেশন থেকে নিয়ে সোজা শব-চুল্লির দিকে যাত্রা করা হলো। ওখানে কাজ করা একজন কয়েদি আমাকে বলে যে শব-চুল্লির ভবনের দরজাগুলিতে ‘স্নানাগার’ শব্দটি লিখা হয়েছে ইউরোপের কয়েকটি ভাষায়। ভবনটিতে প্রবেশের পরপরই পুড়ানো আগে প্রত্যেক বন্দীকে একটি করে সাবান দেওয়া হতো, আর তারপর…তারপর কি হয় তা বর্ণনা করা আমার প্রয়োজন আছে বলে মনে করিনা। এই ভয়াবহতা সম্পর্কে বহু কাহিনী লিখা হয়েছে।

আমাদের নিয়ে আসা ট্রেনটির যে কয়জন লোক বেঁচে গিয়েছিল তারা সেই সন্ধ্যায় যাদের অন্য স্থানে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল তার সত্যতা খুঁজে পাই। কিছু সময় ধরে সেখানে বাস করা কয়েদিদের কাছে আমি জানতে চাইলাম আমার সহকর্মী ও বন্ধু পি. কে কোথায় পাঠানো হয়েছে।

“তাকে কি বাম পাশের সারিতে পাঠানো হয়েছিল”? তিনি জিজ্ঞেস করলেন

“হ্যাঁ”, আমি উত্তর দিলাম।

“তাহলে আপনি তাকে ওখানে দেখতে পাবেন”, আমাকে বলা হলো।

“কোথায়”?

কয়েক’শ গজ দূরে অবস্থিত একটি চিমনির দিকে ইশারা করলো একটি হাত। চিমনিটি থেকে একটি অগ্নিশিখার স্তম্ব পোল্যান্ডের ধূসর আকাশে উড়িয়ে দিলো। আর তা ধোয়ার মতো এক অশুভ মেঘে হারিয়ে গেল। “সেখানেই আপনার বন্ধু, স্বর্গে ভেসে বেড়াচ্ছে”, লোকটি উত্তর দিলেন। তবুও যতক্ষণ না আমাকে সহজ ভাষায় ব্যাখ্যা করা হলো ততক্ষণ আমি তার সত্যতা বুঝতে পারিনি। কিন্তু আমি এখানে আমার যা বলার দরকার নেই তাই বলছি। মনস্তাত্ত্বিক বা মানসিক দৃষ্টিকোণ থেকে স্টেশনে ভোর হওয়ার পর থেকে আমাদের শিবিরে প্রথম রাতের বিশ্রাম পর্যন্ত আমাদের সামনে সুদীর্ঘ পথ অতিক্রম করার ছিল।

SS রক্ষীদের পাহারায় ষ্টেশন থেকে আমাদের তাড়া করা হলো। বৈদ্যুতিক কাঁটাতারের বেড়া পার হয়ে শিবিরের মধ্য দিয়ে গোসল করার ঘাঁটিতে পৌছালাম আমরা। আমরা যারা প্রথম যাচাই-বাছাইয়ের ধাপ অতিক্রম করেছিলাম তাদের জন্য এটাই ছিল প্রকৃত স্নানাগার বা গোসলখানা। আমাদের স্বস্তি বিভ্রম (Illusion of reprive) পুনরায় সত্যি হলো। SS লোকদের প্রায় মুগ্ধকর মনে হলো। শীঘ্রই আমরা তার কারণ খুঁজে পেলাম। যতক্ষণ তারা আমাদের হাতে দামি ঘড়ি দেখতে পেলো আর তা তাদের হাতে তুলে দেয়ার জন্য সদিচ্ছা-প্রণোদিত সুরে আমাদের প্ররোচিত করতে পারলো ততক্ষণ তারা আমাদের সাথে ভাল আচরণ করেছিল। যেভাবেই হোক, আমরা ভাবতাম, আমারা কি আমাদের সব ধর-সম্পদ তাদের হাতে তুলে দেয়নি, আর কেনই বা অপেক্ষাকৃত ভাল আচরণ করা লোকটি আমাদের ঘড়িটি পাবে না? একদিন সম্ভবত বিনিময়ে সেও কোনো ভাল কাজ করবে আমাদের জন্যে।

উপকক্ষ/অতিথি কক্ষের মতো দেখতে জীবাণুমুক্তকরণ বুথের পাশে একটি ছাউনিতে আমরা অপেক্ষা করছিলাম। কিছু লোক এসে মেঝেতে একটি কম্বল পেতে দিলো। কম্বলের উপর আমাদের সব সহায়সম্পদ, যেমন সকল ঘড়ি আর অলংকার সামগ্রী তাতে নিক্ষেপ করতে হয়েছিল। আমাদের মাঝে অনেক সরল মনা কয়েদিরা জিজ্ঞেস করলো বিয়ের-আংটি, পদক বা শুভকামনার কোনো বস্তু তাদের সাথে রাখতে হবে কিনা। এতে তারা অভিজ্ঞ কয়েদিদের কাছে হাসি-ঠাট্টার পাত্র হয়ে উঠে। আমাদের কাছ থেকে যে সবকিছুই কেড়ে নেয়া হবে কেউই তখন তা উপলব্ধি করতে পারিনি ।

তখন পুরাতন এক কয়েদি, যে আমাদের জিনিসপত্র সংগ্রহ করছিলো তার উপর আমি ভরসা করতে চেষ্টা করলাম। চুপিসারে তার কাছে এসে আমার কোটের ভেতরের পকেটে রাখা পাকানো কাগজের দিকে ইশারা করে বললাম, “দেখুন এটি একটি বৈজ্ঞানিক বইয়ের পাণ্ডুলিপি। আমি জানি আপনি কি বলবেন। আপনি বলবেন যে, জীবন নিয়ে বেঁচে থাকার কারণে আমার কৃতজ্ঞ হওয়া উচিৎ। আর বলবেন শুধু তাই আমি আমার নিয়তির কাছে প্রত্যাশা করতে পারি। যেকোনো মূল্যে আমাকে এই পাণ্ডুলিপিটি বাঁচিয়ে রাখতে হবে। কারণ তাতে আমার সারা জীবনের পরিশ্রম রয়েছে। ব্যাপারটা কি আপনি বুঝতে পারেন?”

হ্যাঁ, তিনি বুঝতে শুরু করছিলেন। আস্তে আস্তে একটি বিকৃত হাসি তার মুখমণ্ডলে ছড়িয়ে পড়তে লাগলো। হাসিটাকে প্রথমে মনে হল করুণাময়। তারপর সে হাসিকে মনে হলো আনন্দের হাসি। তারপর তিনি ব্যঙ্গাত্মক, অপমানকর-ভাবে হাসতে থাকলেন। কিছুক্ষণ হাসার পর তিনি গর্জন করে বলে উঠলেন “Shit”! শিবিরের কয়েদিদের শব্দভাণ্ডারে এটি একটি সর্বদা ব্যবহৃত শব্দ।

আমার ফ্যাকাসে আর আতঙ্কিত মুখ নিয়ে অপেক্ষমাণ সহযাত্রীদের মধ্যে হঠাৎ এক আলোড়ন সৃষ্টি হলো। তারা অসহায়ভাবে বিতর্ক করছে। আবারও, আমরা কারা রক্ষীদের কড়া চিৎকার করা আদেশ শুনতে পেলাম। চড়-ঘুষি দিয়ে আমাদের নিকটবর্তী গোসলখানার ভেতরে নিয়ে যাওয়া হলো। আমরা সেখানে একজন SS কর্মীকে আমাদের জন্য অপেক্ষা করতে দেখলাম। পৌঁছে সেখানে আমরা তার চারপাশে জড়ো হলাম। তারপর তিনি বললেন, “আমি তোমাদের দুই মিনিট সময় দেব আর আমি আমার ঘড়ি অনুসারে দেয়া হবে। এই দুই মিনিটের মধ্যে তোমরা পুরোপুরিভাবে উলঙ্গ হয়ে যার যা আছে তা তোমরা যেখানে দাঁড়িয়ে আছো সেখানে ফেলে দেবে। তোমাদের জুতো, বেল্ট বা কটিবন্ধন এবং সম্ভবত হলে ট্রাস (রোগীর পরিধানের জন্য তুলা ভর্তি নরম বন্ধনী) ছাড়া কোনো কিছু তোমরা সঙ্গে নিতে পারবেনা। আমি গণনা শুরু করছি – এখনই! “

তাড়াহুড়ো করে খুলতে গিয়ে লোকজন তাদের জামা-কাপড় ছিঁড়ে ফেলল। সময় কমে আসার  সাথে সাথে তারা ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে উঠে আর অমার্জিত-ভাবে তাদের অন্তর্বাস, বেল্ট ও জুতোর ফিতা টানাটানি করতে শুরু করে দেয়। তারপরে আমরা প্রথম বারের মতো চাবুকের শব্দ শুনতে পেলাম। কাউকে নগ্ন শরীরে চামড়ার চাবুক দিয়ে পেটানো হচ্ছে।

পরে কামানোর জন্য আমাদের সবাইকে একত্রে অন্য একটি কক্ষে ঢুকানো হলো। সেখানে কেবল আমাদের মাথার চুল ছাটা হয়েছিল এমন নয়, বরং আমাদের পুরো শরীরে কোথাও একটি লোমও বাকি রাখেনি। তারপর গোসলখানায়, যেখানে পুনরায় আমাদের সারিবদ্ধ করা হয়। চুল-দাড়ি-লোম কামানোর পর একে অপরকে চিনতে আমাদের খুবই কষ্ট হয়েছিল। তবে বেশ স্বস্তির বিষয় ছিলো যে কেউ কেউ লক্ষ্য করলো যে গোসলখানার সেচনী থেকে আসলেই জল পড়ছে। স্নানের জন্য অপেক্ষায় থাকা অবস্থায় আমাদের শরীরকে আমরা প্রকৃত অর্থে বুঝতে পারি। আমরা বুঝতে পারি যে, আমাদের নগ্ন শরীর ব্যতীত আমাদের আর কিছুই নেই। যার উপর আমাদের অধিকার আছে তা হলো আক্ষরিক অর্থে আমাদের নগ্ন জীবন। আমাদের জীবনে বস্তুগত সম্পর্ক হিসেবে আমাদের জন্য আর কি অবশিষ্ট রইল? আমার বেলা যে দুটি বস্তু আমার জন্য অবশিষ্ট ছিল তা হল আমার চশমা ও একটি বেল্ট।

পরবর্তীতে অবশ্য একটি রুটির জন্য চশমাটি বিনিময় করতে হয়েছিল। যাদের কাছে রোগীর পরিধানের জন্য তুলা ভরতি নরম বন্ধনী বা ট্রাস ছিল, তাদের ভাগ্যে একটু বেশী আনন্দ ছিল। সন্ধ্যায় আমাদের ছাউনির দায়িত্বে থাকা একজন বয়স্ক কয়েদি একটি বক্তব্য দিয়ে আমাদের স্বাগত জানান। সেই বক্তব্যে তিনি বীম বা কড়িকাঠের দিকে ইশারা করে প্রতিজ্ঞা করে বলেন যে, কেউ যদি ট্রাসের ভেতর কোনো অর্থ বা মূল্যবান সোনা-রোপা সেলাই করে লুকিয়ে রাখে তাহলে তিনি ব্যক্তিগতভাবে তাকে বীম থেকে ঝুলিয়ে ফাঁসি দেবেন। গর্বের সাথে তিনি উল্লেখ করেন যে শিবিরের একজন পুরনো বাসিন্দা হিসেবে আইন তাকে তা করার অধিকার দিয়েছে।

আমাদের জুতো যেখানে সম্পৃক্ত, ব্যাপারগুলি এত সহজ ছিল না কারণ অনেককে জুতোও খুলে দিতে হয়েছিল। আমাদের জুতো রাখার কথা থাকলেও, যাদের মোটামুটি মার্জিত জুতো ছিল অবশেষে তাও তাদের ছেড়ে দিতে হয়েছিল। আর তার বিনিময়ে তাদের এমন জুতো দেওয়া হয়েছিল যা তাদের পায়ের সাথে মিলত না। যেসব নতুন কয়েদিরা পুরাতন কয়েদিদের দেওয়া স্পষ্টতই ভাল পরামর্শ অনুসরণ করেছিল এবং নাশকতা লুকাতে জ্যাক-বুটের উপরটা কেটে ছোট করে কাটা প্রান্তে সাবান লেপে দিত তারাই ছিল প্রকৃত যন্ত্রণার কারণ। SS এর লোকেরা মনে হয় শুধু তার জন্যই অপেক্ষা করেছিল। এই অপরাধে অপরাধী সবাইকে পার্শ্ববর্তী ছোট একটি কক্ষে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল।  আর কিছুক্ষণ পর আমরা আবার চাবুক মারার এবং অত্যাচারিত পুরুষদের চিৎকার শুনতে পাই। এবার তা বেশ কিছুক্ষণ স্থায়ী হয়।

এইভাবে, আমাদের মাঝে যারা তখনও স্বস্তি ভ্রমকে (Illusion of reprieve) আঁকড়ে ধরে রেখেছিল তারা একে একে সবাই ধ্বংস হয়ে গেলো। এবং তারপরে, বেশ অপ্রত্যাশিতভাবে, আমাদের বেশিরভাগই এক ভয়ানক রকমের রসিকতা দ্বারা ধরাশায়ী হয়ে পড়লো। আমরা জানতাম যে হাস্যকর এক নগ্ন জীবন ছাড়া আমাদের হারানোর কিছু নেই। গোসলখানার স্প্রে চালু করে হলে আমরা একে অন্যের সম্পর্কে মজা করার জন্য খুব চেষ্টা করলাম। বলা চলে যে স্প্রে থেকে  ঠিকই প্রকৃত জল প্রবাহিত হয়েছিল!

সেই অদ্ভুত রকমের রসিকতা ছাড়াও আরেক সংবেদন-শক্তি আমাদের জব্দ করে: জানার কৌতূহল। নির্দিষ্ট কোনো অজানা পরিবেশের প্রতি মৌলিক প্রতিক্রিয়া হিসাবে আমি এর আগেও এই ধরনের কৌতূহল অনুভব করেছিলাম। এক সময় পাহাড়ে উঠতে গিয়ে দুর্ঘটনা কবলিত হয়ে আমার জীবন বিপদগ্রস্ত ও বিপন্ন হয়ে পড়েছিল। সেই কঠিন মুহূর্তেও কৌতূহল নামের এই সংবেদনশক্তিকে (sensation) আমি ভীষণভাবে অনুভব করেছিলাম। এ বিপদ থেকে আমি জীবিত অবস্থায় ফিরে আসব কি না, ফাটা মাথার খুলি বা অন্য কোনো আঘাত বয়ে নিয়ে আমাকে বেচে থাকতে, এসবের কৌতূহল আমাকে ঘিরে ধরেছিল ।

কিভাবে জানি মনকে এর পরিবেশের চারপাশ থেকে বিচ্ছিন্ন করে, আমার শীতল এই কৌতূহল অশউইৎয শিবিরেও প্রাধান্য পেয়েছিল। এই কৌতূহলকে এক ধরনের বস্তুনিষ্ঠতা হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছিল। সেই সময় কোনো ব্যক্তি কৌতূহল নামের এই মানসিক অবস্থাকে আত্মরক্ষার উপায় হিসেবে এর অনুশীলন করতো। যেমন ধরুন, গোসলের পর ভিজা অবস্থায় পড়ন্ত শরতের হিমেল আবহাওয়ায় খোলা বাতাসে আমাদের সম্পূর্ণ নগ্ন অবস্থায় দাঁড়িয়ে থাকার ফলে পরে আমাদের কি হতে তা জানার জন্য আমরা ব্যাকুল ছিলাম। পরবর্তী কয়েক দিনের মধ্যে আমাদের কৌতূহল বিস্ময়ে পরিণত হলো; আশ্চর্যের ব্যাপার হলো ঠাণ্ডা বাতাসে দাড়িয়ে থাকতেও আমাদের ঠাণ্ডা লাগেনি।

শিবিরে নতুন আগতদের নিয়তি বিভিন্ন রকমের বিস্ময়ে ভরা ছিল। আমাদের মধ্যে চিকিৎসকরাই সর্ব প্রথম বুঝতে পেরেছিলাম যে, “আমাদের পাঠ্যপুস্তক মিথ্যা কথা বলে!” পাঠ্যপুস্তকের কোথাও কোথায় বলা হয়েছে যে, মানুষ ঘুম ছাড়া নির্দিষ্ট একটি সময়ের বেশি ঠিকে থাকতে পারে না। কথাটি ঠিক নয়! আমাকে শেখানো হয়েছিল যে কিছু কিছু জিনিস আমি ইচ্ছা করলেও করতে পারবো না। যেমন ধরুন আমরা প্রায় বলে থাকি, “এটা না হলে আমি ঘুমাতে পারব না, বা এটা-ওটার সাথে আমি বাঁচতে পারবো না। যেখানে অশউইৎয শিবিরে প্রথম রাতে আমরা তিন-স্তর বিশিষ্ট একটি বিছানায় ঘুমিয়েছিলাম। প্রতিটি স্তর ছিল প্রায় সাড়ে ছয় থেকে আট ফুট। বিছিয়ে দেওয়া তক্তার উপর প্রতি স্তরে নয়জন করে মানুষ ঘুমাত। প্রতি নয়জন বন্দীকে দুটি কম্বল ভাগাভাগি করে থাকতে হতো। আমরা কেবলই পাশ/কাঁত হয়ে শুতে পারতাম। তীব্র শীতের কারণে জনাকীর্ণ পরিবেশ আর একে অপরের সাথে গাদাগাদি করে শোয়ার মাঝে কিছু সুবিধাও ছিল। বিছানায় জুতো নিয়ে উঠার নিষেধ থাকলেও, কাদায় আবৃত থাকার পরও কেউ কেউ গোপনে তা বালিশ হিসাবে ব্যবহার করতো। অন্যথায়, তাকে প্রায় মচকে যাওয়া হাতের বাঁকের উপর মাথা রাখতে হতো। আর তবুও বিস্মৃতি নিয়ে ঘুম আসে আর নিয়ে আসে কয়েক ঘণ্টা স্বস্তি ।

আমরা কতটা কষ্ট সহ্য করতে করতে পেরেছিলাম সে সম্পর্কে আমি কয়েকটি বিস্ময়কর ঘটনার কথা উল্লেখ করতে চাই। প্রতিদিন দাঁত মাজা আমাদের পক্ষে সম্ভব ছিলনা। তারপরও প্রকট ভিটামিনের অভাব থাকা সত্ত্বেও আমাদের দাঁতের মাড়ি ছিল আগের চেয়ে স্বাস্থ্যকর। বছরের পর বছর ধরে আমাদের একই শার্ট পরতে হয়েছিল, যতদিন না শার্ট হিসেবে এর সমস্ত উপস্থিতি বিলীন হয়েছে। পানির পাইপে বরফ জমে যাওয়ার কারণে কয়েক দিন ধরে গোসল করতে না পারলেও হাতে ঘা হয়নি। হিম-দংশ বা বরফের আঘাতে তা না হয়ে থাকলে মাটিতে কাজ করার দরুন ত্বকে ফোড়া বা পচন রোগ হয়নি। অথবা উদাহরণস্বরূপ ধরা যাক হালকা কোলাহলে সহজেই ঘুম ভেঙ্গে যায় এমন কোনো ব্যক্তির কথা। যে হয়তো পাশের ঘরে থেকে সামান্য তম নাকডাকার শব্দেও তিনি বিরক্ত হতেন। এখন সে তার কান থেকে মাত্র কয়েক ইঞ্চি দুরে জোরে জোরে নাক-ডাকা একজন সঙ্গীর গা ঘেঁসে শুয়ে আছে আর কোলাহলের মধ্যেও দিব্যি ঘুমাচ্ছে।

যারা ফিওদর দস্তোয়ভস্কি মানুষকে এমন এক সত্ত্বা হিসেবে সংজ্ঞায়িত করেন, যে যেকোনো কিছুতেই অভ্যস্ত হয়ে উঠতে পারে। কেউ যদি দস্তোয়ভস্কির এই উক্তির সত্যতা সম্পর্কে জানতে চান তার উত্তরে আমরা বলবো, “হ্যাঁ”।  একজন মানুষ যেকোনো কিছুতেই অভ্যস্ত হয়ে উঠেতে পারে। তবে কীভাবে অভ্যস্ত হয়ে উঠে তা আমাদের জিজ্ঞেস করবেন না”। কারণ তা জানার জন্য আমাদের মনস্তাত্ত্বিক গবেষণা আমাদের এখনো তত-দূর নিয়ে যায়নি। আমরা কয়েদিরাও সেই অবস্থানে পৌঁছাতে পারিনি। শিবিরে আমরা তখনও মনস্তাত্ত্বিক প্রতিক্রিয়ার প্রাথমিক স্তরে ছিলাম।

শিবিরে আমরা প্রায় প্রত্যেকেই আত্মহত্যার চিন্তাটি পোষণ করেছিলাম, যদিও কেবল অল্প সময়ের জন্য। নিরাশ পরিস্থিতি থেকে এরকম চিন্তার সৃষ্টি হয়। ক্রমাগতভাবে প্রতিদিন আর প্রতিক্ষণে মৃত্যুর বিপদ আমাদের উপর আবির্ভূত হচ্ছিল আর অনেকেই এই মৃত্যুর মুখোমুখিও হয়েছিলো। আমি যেমনটা আগেও বলেছি যে আমার ব্যক্তিগত প্রত্যয় থেকে শিবিরে আগমনের প্রথম সন্ধ্যায় আত্মহত্যা করার সহজ উপায় হিসেবে বিবেচিত বৈদ্যুতিক কাঁটাতারের বেড়ায় গিয়ে ধাক্কা বা ঝাপ না খাওয়ার প্রতিজ্ঞা করেছিলাম। “কাঁটাতারের বেড়ায় ঝাপ দিয়েছে” কথাটি ছিল বৈদ্যুতিক কাঁটাতারের স্পর্শ করে আত্মহত্যা করাকে ব্যাখ্যা করার জন্য এটি ছিল শিবিরে একটি প্রচলিত কথা। এই সিদ্ধান্ত নেওয়া আমার পক্ষে পুরোপুরি কঠিন ছিল না। কারণ আত্মহত্যা করার খুব কমই কারণ ছিল সেখানে। বস্তুনিষ্ঠ-ভাবে হিসেব করলে ও সম্ভাব্য সব সম্ভাবনার অঙ্ক কষলে দেখা যায় যে গড় বন্দীদের জীবনায়ু ছিল খুবই নগণ্য। কোনও আশ্বাসই একজন মানুষ সকল যাচাই-বাছাই থেকে রক্ষা পাওয়া মানুষের ক্ষুদ্র অংশের মধ্যে নিজেকে খুঁজে পাওয়ার প্রত্যাশা করতে পারতো না। প্রচণ্ড মানসিক ধাক্কা বা shock এর প্রথম স্তরে এসে অশউইৎয শিবিরের একজন কয়েদি মৃত্যুকে ভয় পায়নি। এমনকি প্রথম কয়েক দিন পর গ্যাস চেম্বারগুলির ভয়াবহতা তাকে বিচলিত করতে পারেনি। সে কারণে চেম্বারগুলি একজন মানুষকে পুড়িয়ে মেরে আত্মহত্যার কাজ থেকে বাঁচিয়ে রাখতো।

পরতীতে বন্ধুদের সাথে সাক্ষাৎকালে তারা আমাকে বলে যে, শিবিরে প্রবেশের প্রচণ্ড মানসিক ধাক্কা বা shock যে সমস্ত লোকদের প্রবলভাবে বিষণ্ণ করে তুলেছিল, আমি তাদের মধ্যে নাই। কারণ সে পরিস্থিতি আমাকে বিষণ্ণ করে তুলতে পারেনি। অশউইৎয শিবিরে আমাদের প্রথম রাতের পর সকালে যখন পরবর্তী ঘটনাটি ঘটে তখন আমি বেশ আন্তরিকতার সাথে শুধু মুচকি হেসেছিলাম। ‘ব্লক’ বা ছাউনি ত্যাগ না করার জন্য কঠোর নিষেধাজ্ঞা জারি হওয়া সত্যেও কয়েক সপ্তাহ আগে আসা আমার একজন মহকর্মী চুপিসারে আমাদের ছাউনিতে প্রবেশ করলেন। তিনি আমাদের শান্ত করতে এবং সান্ত্বনা দিতে ও আমাদের কয়েকটি কথা বলতে চেয়েছিলেন। তিনি এতটাই রোগা হয়ে গিয়েছিলেন যে প্রথমে আমরা তাকে চিনতে পারিনি। বেশ রসিকতা আর বেপরোয়া ভঙ্গিতে তিনি তাড়াহুড়ার সাথে আমাদের কয়েকটি উপদেশ দিলেন। তিনি বললেন, “ভয় পাবেন না! যাছাই-বাছাই প্রক্রিয়াকে ভয় করবেন না! ডাক্তারদের জন্য SS মেডিকেল প্রধান ডাঃ.এম’র দুর্বলতা (দয়া) আছে”। (তথ্যটি আসলে ভুল ছিল। আমার সহকর্মীটির সদয় বাণী ছিল বিভ্রান্তিকর। একজন প্রায় ষাট বছরের  ছাউনি ব্লকের কয়েদি ডাক্তার আমাকে বলেছিলেন কীভাবে তিনি ডাঃ এম. এর কাছে তার ছেলেটিকে গ্যাস চেম্বারে না পাঠিয়ে ছেড়ে দেওয়ার জন্য অনুরোধ করেছিলেন। তার অনুরোধ সত্ত্বেও ডাঃ.এম. অবলীলায় তা প্রত্যাখ্যান করে দিয়েছিলেন।)

“কিন্তু একটা জিনিস আমি আপনাকে অনুরোধ করি”,তিনি বলতে থাকলেন, “সম্ভব হলে প্রতিদিন দাড়ি কামাবেন, এমনকি তা যদি একটুকরো গ্লাস দিয়েও করতে হয় ..এমনকি আপনাকে তার জন্য তোমার রুটির শেষ টুকরোটাও যদি ত্যাগ হয় তবুও। তাতে আপনাকে আরও যুবক দেখাবে আর টসটসে স্বাস্থ্যবান দেখাবে আপনাকে। বেঁচে থাকতে চাইলে আপনার একটাই উপায় আছে। আর তা হলো কাজের জন্য সবল থাকা। যদি গোড়ালিতে ফোসকার কারণে খোঁড়াতে থাকেন আর যদি তা কোনো SS এর লোকের চোখে পড়ে, তাহলে আপনাকে আলাদা করে রাখবে আর পরের দিন নিশ্চিত আপনাকে গ্যাস দিয়ে মারা হবে। আপনি কি জানের একজন ‘মোসলেম’  বলতে আমরা কি বোঝাতে চাই? যাকে দেখতে একজন দুর্দশাগ্রস্ত, নিঃস্ব, অসুস্থ এবং ক্ষীণ, ও যে আর কঠোর শারীরিক পরিশ্রম করতে পারে না তাকেই একজন ‘মোসলেম’ বা ‘মোসেলমান’ বলা হয়। আজ হোক বা কাল, প্রত্যেক ‘মোসলেম’র ঠিকানা হলো গ্যাস চেম্বার। যা  সাধারণত তাড়াতাড়ি হয়ে থাকে। তাই প্রতিদিন শেভ করবেন, শক্ত হয়ে দাঁড়াবেন এবং চটপটে চলাফেরা করবেন। তারপর আপনাকে আর গ্যাসের ভয় করতে হবে না। আপনারা যারা এখানে দাঁড়িয়ে আছেন নিজেদের ব্যতীত আপনাদের গ্যাসের ভয় পাওয়ার প্রয়োজন নেই। কেবল চব্বিশ ঘণ্টা আগেও যদি আপনারা এসে থাকেন। মনে রাখবেন আপনারা নিজেরাই নিজেদের ভয়।” তারপর তিনি আমার দিকে ইশারা করলেন আর বললেন “আশা করি খোলাখুলি-ভাবে এসব কথা বলার কারণে আপনি কিছু মনে করেননি”। অন্যদের তিনি পুনরায় বললেন, “আপনাদের মাঝে শুধু তার জন্যই পরবর্তী বাছাইয়ে ভয় রয়েছে। তাই কোনো চিন্তা করবেন না”।

আমি আবারও মুসকি হাসলাম। এখন আমি নিশ্চিত যে সেদিন তিনি আমার জায়গায় হলে ঠিক একই জিনিসটাই করতেন।

*******

আমার মনে হয় জার্মান লেখক ইফ্রেম লেসিং একথা বলেছিলেন যে, “জীবনে এমন কিছু জিনিস রয়েছে যার জন্য আপনি যুক্তি হারাতে বাধ্য হন অথবা আপনার হারানোর কিছুই থাকেনা ”। অস্বাভাবিক পস্থিতির প্রতি অস্বাভাবিক সাড়া জীব জীবনে একটি স্বাভাবিক আচরণ। এমনকি আমরা মনোরোগ বিশেষজ্ঞরাও আশা করি যে পাগলাগারদে নিবেদিত এক অস্বাভাবিক পরিস্থিতির প্রতি একজন ব্যক্তির প্রতিক্রিয়া তার স্বাভাবিকতার মাত্রার অনুপাতে অস্বাভাবিক হোক। বন্দী শিবিরে অবস্থানের প্রতি একজন মানুষের প্রতিক্রিয়াও এক অস্বাভাবিক মানসিক অবস্থার প্রকাশ। কিন্তু বস্তুগত দিক থেকে বিচার করলে, এটি একটি স্বাভাবিক ও কোনো প্রদত্ত পরিস্থিতির প্রতি এক সাধারণ প্রতিক্রিয়া — যা নিয়ে পরে আলোচনা করা হবে। আমি যেমনটি বর্ণনা করেছি, কয়েদিদের এই প্রতিক্রিয়া সমূহ অল্প কিছু দিনের মধ্যেই পরিবর্তন হতে শুরু করলো। এর মধ্যে কয়েদিরা তাদের মানসিক অবস্থার প্রাথমিক ধাপ পার হয়ে দ্বিতীয় স্তরে পৌছে গেছে। দ্বিতীয় স্তরটি একটি তুলনামূলকভাবে মানসিক উদাসীনতার স্তর, সেখানে একজন কয়েদি একধরনের আবেগজনিত মৃত্যু (emotional death) লাভ করে।

ইতিমধ্যে বর্ণিত মানসিক প্রতিক্রিয়া ছাড়াও নতুন আগত কয়েদিদের নির্যাতনের সবচেয়ে যন্ত্রণাদায়ক আবেগের অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে। যে কারণে তার আবেগ হয়ে উঠে নিঃসাড় বা অনুভূতিহীন। শিবিরের প্রবেশের প্রথম প্রথম বাড়ি আর পরিবারে জন্য তার সীমাহীন আকাঙ্ক্ষা ছিল। সে আকাঙ্ক্ষা কখনও কখনও এতই তীব্র হয়ে উঠত যে এই তা তাকে গ্রাস করে বসতো। তারপর আসে ঘৃণা, অপমান; তার চারপাশের সকল কুৎসিত বাহ্যিক আকৃতির প্রতি তার ঘৃণা আর অপমান চলে আসে।

অধিকাংশ বন্দীদের নেকড়ার তৈরি একটি করে উর্দি বা ইউনিফর্ম দেওয়া হয়েছিল। তুলনামূলকভাবে যা এক কাকতাড়ুয়াকে সুন্দর মানাত। আমি লক্ষ্য করলাম শিবিরের ছাউনির মাঝখানে পড়ে আছে মল। একজন মানুষ যত বেশি তা পরিষ্কার করে ফেরার চেষ্টা করেছে তত বেশি তাকে এর সংস্পর্শে আসতে হয়েছে। ছৌচাগার পরিষ্কার এবং নর্দমা নিষ্কাশনের জন্য কাজের দলে আসা এক নতুন আগন্তুকের কাছে এর বিবরণ করাটা ছিল একটি প্রিয় প্রথা। সাধারণত, উঁচু-নিচু মাঠ দিয়ে বহন করে নিয়ে যাওয়ার সময় দু’য়েক ফোটা মল তার মুখে ছিটকে পড়ার কারণে সে বন্দীর মুখে যদি কোনো ঘৃণার চিহ্ন দেখা যেতো বা যদি সে মল মুছে ফেলার কোনো প্রচেষ্টা করতো তাহলে তার জন্য শাস্তি হিসেবে তাকে ক্যাপোদের কাছ থেকে বেতের বারি সহ্য করতে হতো। আর এইভাবে, পরিস্থিতির প্রতি স্বাভাবিক মানসিক প্রতিক্রিয়ার অপমান বোধকে বাড়িয়ে তুলতো।

প্রথম প্রথম একজন কয়েদি আরেক দলকে শাস্তি ভোগ করতে দেখলে তা থেকে সে তার মুখ ফিরিয়ে নিতো। সহ-বন্দীদের ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাদার মধ্যে কুচকাওয়াজ করতে দেখলে,এবং বেতের আঘাতে নিয়ন্ত্রিত তাদের চলাফেরার দৃশ্য দেখলে সে সহ্য করতে পারতো না। কয়েকদিন বা কয়েক সপ্তাহ পর অনেক জিনিসে পরিবর্তন আসে। দেখা যায় যে, খুব ভোরে অন্ধকার থাকা অবস্থায় তার বিশেষ সৈন্য দলের সাথে কুচকাওয়াজ করার জন্য সে ফটকের সামনে প্রস্তুত হয়ে আছে। হঠাৎ চিৎকার শুনতে পেয়ে সে যখন দেখে যে তার একজন সহ-বন্দী মাটিতে পড়ে রয়েছে। সে পুনরায় তার পায়ে দাঁড়াল, আর আবারও তাকে বেত দিয়ে আঘাত করা হলো–কেনো? কারণ তার জ্বর হয়েছিল। আর অসময়ে সে অসুস্থদের জন্য ব্যবহৃত হওয়া ঘরে গিয়ে তা জানিয়েছিলো। আর অসুস্থতার কারণে তার দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি পাওয়ার এই বেআইনি চেষ্টার জন্য তাকে শাস্তি দেওয়া হচ্ছে।

কিন্তু যে কয়েদি তার মানসিক প্রতিক্রিয়ার দ্বিতীয় স্তরের পদার্পণ করেছে, সে এরকম ভয়াবহতা দেখে আগের মতো আর চোখ ফিরিয়ে আনেনি। এর মধ্যে তার সব অনুভূতি ভোঁতা হয়ে গেছে, আর অবিচলভাবে সে সব নির্মমতা দেখে চলছে। আরও একটি উদাহরণ দেওয়া যাক: ধরা যাক একজন কয়েদি কোনো আঘাত বা ইডেমা বা জ্বরের কারণে দুই দিনের জন্য শিবিরের ভেতরে করা যায় এমন কোনো হালকা কাজের প্রত্যাশায় অসুস্থদের জন্য ব্যবহৃত হয় ঘরে (sick-bay) অপেক্ষা করছে। জোর করে ঘণ্টার পর ঘনটা সাবধানে দাঁড় করো রাখা এক বারো বছরের শিশুকে শিবিরে তার জন্য কোনো জুতো না থাকার দরুন খালি পায়ে বাইরে কাজ করতে বাধ্য করা হয়েছিল। শিশুটিকে যখন তাকে বহন করে ভেতরে নিয়ে আসা হলো তখনও মানসিক প্রতিক্রিয়ার দ্বিতীয় স্তরের পদার্পণ করা কয়েদি অবিচলভাবে দাঁড়িয়ে থেকেছিল। শিশুটির পায়ের আঙ্গুলগুলি তুষারাবৃত হয়ে গিয়েছিল। আর কর্তব্যরত ডাক্তার একে একে টুইজার দিয়ে কালো কালো পচনশীল অংশ সমূহ একের পর এক তুলে নিলেন। ঘৃণা, আতঙ্ক এবং করুণার মতো আবেগকে আমাদের মতো কয়েদি দর্শক সত্যিই আর অনুভব করতে পারেনি। কয়েক সপ্তাহের শিবির জীবনের পরে যন্ত্রণার শিকার মানুষ, মরে যাওয়া বা মৃত্যু তার কাছে এতই স্বাভাবিক হয়ে উঠে যে এসব ঘটনা তাকে আর বিচলিত করতে পারে না।

আমি কিছু দিন টাইফাস রোগীদের সাথে কাটিয়েছিলাম। টাইফাস রোগীদের উচ্চমাত্রার জ্বর আসতো আর প্রায় সময় রোগীরা প্রলাপ বকত, যাদের অনেকেরেই অবস্থা ছিল প্রায় যায় যায়। একজন রোগীর মৃত্যুর পর আমি কোনো ধরনের মনখারাপ না করে পরবর্তী ঘটনাটি লক্ষ্য করছিলাম। যে ঘটনাটি প্রতিবার কারও মৃত্যুর পর পুনরাবৃত্তি হচ্ছিল। আমি দেখলাম যে কারও মৃত্যুর পর কয়েকজন কয়েদি একে একে তখনও উষ্ণ দেহটির দিকে এগিয়ে গেলো। একজন তার আলুর নোংরা খাবারের অবশিষ্ট অংশটা কেড়ে নিলো। অন্য আরেকজন ভাবলো লাশের পাশে কাঠের জুতোগুলি তার জন্য সুবিধাজনক হবে। তাই সে নিজের জুতোর সাথে লাশের জুতোগুলি বিনিময় করে নিলো। তৃতীয়-জনও ঠিক তাই করলো। সে মৃত ব্যক্তির কোটটি নিয়ে নিলো, আর অন্যজন কিছু দড়ি আয়ত্ত করতে পেরে আনন্দিত ছিল।

এই সব আমি উদ্বেগ-হীনভাবে দেখেছিলাম। অবশেষে আমি “নার্স” কে মৃত দেহটি সরিয়ে ফেলতে বলেছিলাম। সিদ্ধান্ত নেওয়ার পর নার্সটি লাশটিকে নোংরা টাইফাস রোগীদের তক্তার বিছানার দুই সারির মাঝখানের ছোট করিডোর দিয়ে দুই পা ধরে টেনে টেনে দরজার দিকে উঁচুনিচু মাটির মেঝেতে নিয়ে যায়। বারংবার খাদ্য সংকটের কারণে আমরা খুবই ক্লান্ত ছিলাম বলে খোলা আকাশে দিকে চলে যাওয়া দু’টি সিঁড়ি বেয়ে উঠতে সবসময়ই আমাদের সমস্যা হতো। শিবিরে কয়েকমাস কাটার পর আমরা নিজেদের টেনে তুলার জন্য দরজার বাজু না ধরে সিঁড়িগুলি বেয়ে উঠতে পারতাম না। সিঁড়ি দু’টির উচ্চতা ছিল প্রায় ছয় ইঞ্চি।

মৃতদেহ সহ নার্সটি সিঁড়ি দু’টির কাছে আসলো। তারপর ক্লান্তিকর-ভাবে সে নিজেকে উপরে টেনে তুলে। তারপর প্রথমে লাশটির পা, তারপর শরীর এবং অবশেষে বিদঘুটে বকবক শব্দ করে লাশের মাথা সিঁড়ি দু’টির উপরে তুলে নিয়ে আসলো।

মেঝের পাশে ছাউনির বিপরীতে একমাত্র জানালার অদূরে আমার বাসস্থান ছিল। ঠাণ্ডা হাতে সুপের বাটিতে চুমুক দিতে দিতে আমি জানালার বাইরে তাকালাম। একটু আগে সরিয়ে নিয়ে যাওয়া লাশটি তখনও স্বচ্ছ দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। দু’ঘণ্টা আগেও আমি লোকটার সাথে কথা বলেছিলাম। এখন আমি সুপের বাটিতে চুমুক দিয়ে চলছি আর সে মৃত।

**********

আমার আবেগহীনতা (Apathy) যদি আমার পেশাগত আগ্রহের দিক থেকে আমাকে আকর্ষণ না করতো, তাহলে আমি এ ঘটনা মনে রাখতাম না কারণ তাতে খুব কমই অনুভূতি সম্পৃক্ত ছিল।

বেদনাবোধহীনতা বা অনুভূতিহীনতা (Apathy) হলো আবেগ আর অনুভূতিকে স্থূল বা ভোঁতা করে তোলার মনস্তাত্ত্বিক প্রতিক্রিয়া, যার লক্ষণ বন্দীদের মানসিক প্রতিক্রিয়ার দ্বিতীয় স্তরে প্রকাশ পায়। অবশেষে এই বেদনাবোধহীনতা বা অনুভূতিহীনতা তাকে প্রতিদিনের ও প্রতি মুহূর্তের প্রহারের প্রতি অসংবেদনশীল (insensitive) করে তুলতো। এই অসংবেদনশীলতাকে কাজে লাগিয়ে দ্রুত একজন বন্দী নিজেকে প্রয়োজনীয় প্রতিরক্ষামূলক খোলস দিয়ে পরিবেষ্টিত করে রাখতো।

খুব সামান্যতম উস্কানি বা অনেক সময় কোনো কারণ ছাড়াই প্রহার করার ঘটনা ঘটতো শিবিরে। যেমন ধরুন, কাজ করার স্থানে রুটি ভাগ করে দেওয়া হলো আর তার জন্য আমাদের লাইনে দাঁড়াতে হলো। একবার, আমার পেছনের লোকটি একপাশ দিয়ে একটু দুরে দাঁড়িয়েছিলো আর লাইনের সে ভারসাম্যহীনতা SS রক্ষীকে অসন্তুষ্ট করে। আমি তখনও জানতাম না আমার পেছনের সারিতে বা SS রক্ষীর মনে কি ঘটছিল। কিন্তু হঠাৎ দুইটা তীব্র বারি আমার মাথার উপর এসে পড়েছিল। আর কেবল তখনই রক্ষীটিকে দেখি আমার পাশে কারও উপর তার লাটি ব্যবহার করতে। এরকম মুহুর্তে শারীরিক যন্ত্রণার চেয়ে যে জিনিসটি সবচেয়ে কষ্ট দিতো তা হলো অন্যায়-অবিচারের দরুন সৃষ্ট মানসিক যন্ত্রণা, আর সকল অবিচারের যুক্তিহীনতা।

আশ্চর্যজনকভাবে, কোনো কোনো পরিস্থিতিতে যে আঘাতের কোনো চিহ্ন হয় না, সেই আঘাতটি চিহ্ন একে দেওয়া আঘাতের চেয়ে বেশি কষ্ট দিতো। তুষারঝড়ের সময় আমি একসময় এক রেল লাইনের উপর অপেক্ষা করছিলাম। বৈরি আবহাওয়া সত্ত্বেও আমাদের কাজের দলকে কাজ চালিয়ে যেতে হয়েছিল। নুড়ি পাথর দিয়ে রেল লাইনে আমি বেশ কঠোর পরিশ্রম করেছিলাম। কারণ শীতের মাঝে নিজেকে উত্তপ্ত রাখার জন্য কাজই ছিল একমাত্র উপায়। বেলচার উপর নির্ভর করে আমি দম নেওয়ার জন্য এক ‍মূহুর্তের জন্য কাজ থামিয়ে দিয়েছিলাম। দুর্ভাগ্যবশত: ঠিক সেই মুহূর্তেই প্রহরীটি ঘুরে দাঁড়িয়ে ভাবলেন আমি কাজে ফাঁকি দিচ্ছি। যে যন্ত্রণা সে তখন আমাকে দিয়েছিল তা কোনো অপমান বা আঘাতের যন্ত্রণা ছিলনা। তার সামনের দাঁড়িয়ে থাকা আকৃতিটি যা হয়তো তাকে অস্পষ্টভাবে কোনো মানুষের কথা স্মরণ করিয়েছিল সেই কৃশকায়, ক্ষীণদেহের মানুষটিকে কিছু বলার জন্য চিন্তা করা উপযুক্ত সে মনে করেনি। সে বরং খেলাচ্ছলে একটি পাথর কুড়িয়ে নিলো আর আমাদের দিকে ছুড়ে মারল। আমার কাছে তা মনো হলো যেন কোনো গৃহপালিত জন্তুর কাছে তার কাজ শেষ করার জন্য দৃষ্টি আকর্ষণের ডাক। পশুটি এমন এক সৃষ্টি যার সাথে আপনার এতই অমিল রয়েছে যে আপনি তাকে শাস্তি দেওয়ারও উপযুক্ত মনে করেন না।

প্রহারের ক্ষেত্রে সব চেয়ে যন্ত্রণাদায়ক অংশটি হলো এর সাথে সম্পৃক্ত অপমান। একসময় আমাদের বরফে ঢাকা পথের উপর কিছু লম্বা আর ভারি বিম (গার্ডার) বহন করে নিয়ে যেতে হয়েছিল। যদি কেউ একজন পিছলে পড়ে তাহলে সে কেবল নিজেকে নয় বরং বিমটি বহনরত অন্যান্য সবাইকেই বিপদে ফেলতো। জন্মগতভাবে আমার এক পুরনো বন্ধুর কোমর সঠিক স্থান থেকে বিচ্যুত ছিল। তা সত্ত্বেও সে কাজ করতে সমর্থ হওয়াই আনন্দিত ছিল। যেহেতু কোনো যাচাইয় বাছাই প্রক্রিয়ার পর শারীরিকভাবে অক্ষম সবাইকে অনেকটা নিশ্চিতভাবে গ্যাস চেম্বারে মৃত্যুতে পাঠিয়ে দেওয়া হতো। ভারি বিমটি বহন করার সময় সে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটছিল, আর মনে হচ্ছিল সে প্রায় পড়ে যাবে এবং অন্যদেরও তার সাথে টেনে নিয়ে যাবে। তখন যেহেতু আমি বিম বহনের কাজে ছিলাম না তাই আমি কাল-বিলম্ব না করে তার সাহায্যে লাফিয়ে উঠলাম। তৎক্ষণাৎ আমার পিঠে আঘাত করা হলো, কর্কশভাবে আমাদের গালিগালাজ করা হলো আর আমার অবস্থানে আমাকে ফিরে যেতে নির্দেশ দেওয়া হলো। ঠিক সেই একই প্রহরী যে কিছুক্ষণ আগে আমাকে পাথর চুড়ে মেরেছিল আর বিরক্ত হয়ে আমাদের বলেছিল যে আমরা “শুকর”দের মধ্যে সহমর্মিতা মনোভাবের অভাব রয়েছে।

আরেক সময়, বনের ভেতর ২⁰ ফারেনহাইট তাপমাত্রার মাঝে পানির পাইপ বসানোর জন্য আমি বরফ জমে শক্ত হয়ে যাওয়া মাটির উপরের অংশ খুঁড়ছিলাম। ততক্ষণে আমি শারীরিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়েছি। সঙ্গে ছিল নিটোল গোলাপি গালের এক শ্রমিক প্রধান। তার অবয়ব আমাকে অবশ্যই শূকরের মাথার কথা মনে করিয়ে দিয়েছিল। আমি লক্ষ্য করি সেই তীব্র শীতের মধ্যে সে হাতে সুন্দর উষ্ণতার জন্য হাত-মোজা পরেছিল। কিছুক্ষণ নীরবে সে আমাকে লক্ষ্য করে দেখলো। আমার মনে হলো আমার জন্য কোনো বিপদ ঘনিয়ে আসছে কারণ আমি ঠিক কতটুকু মাটি কুড়ে ছিলাম তা আমার সামনের স্তূপটিতে প্রতীয়মান।

তারপর সে আরম্ভ করল: “ শুকর, পুরোটা সময় আমি তোমাকে লক্ষ্য করছিলাম”! এখনি আমি তোমাকে কাজ করা শেখাব! অপেক্ষা কর, এমন এক সময় আসবে যখন দাঁত দিয়ে তোমাকে ময়লা খনন করতে হবে – পশুর মতো তোমার মরণ হবে! দুই দিনের মধ্যেই আমি তোমাকে শেষ করে দেব! তোমার জীবনে তুমি কখনও ছোট কাজ করনি মনে হচ্ছে। তুমি আগে কি করতে, শুকর? কোনো ব্যবসায়ী?”

আমি তার কথাকে পরোয়া করতাম না। কিন্তু তার প্রাণ নাশের হুমকি আমাকে গুরুতরভাবে নিতে হয়েছিল। তাই সোজা হয়ে সরাসরি তার চোখে চোখে তাকিয়ে বললাম, “আমি ছিলাম একজন ডাক্তার-একজন বিশেষজ্ঞ।” কি? ডাক্তার?  আমি নিশ্চিত তুমি মানুষের কাছ থেকে অনেক অর্থ হাতিয়েছ।” “তা ঠিক নয়, আমার অধিকাংশ কাজ আমি কোনো টাকা-পয়সা ছাড়াই, ক্লিনিকে গরীবদের জন্য করেছি।” কিন্তু ইতিমধ্যে আমার যথেষ্টই বলা হয়েছে। রাগে সে আমার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে আমাকে ধাক্কা মেরে ফেলে দিয়ে পাগলের মতো চিৎকার করতে থাকলো। সে কি চিৎকার করছিলো তা আমি আর মনে করতে পারছিনা।

এই তুচ্ছ কাহিনী দিয়ে আমি দেখাতে চেয়েছি যে আপাতদৃষ্টিতে একজন অসম্ভব ধৈর্যশীল কয়েদিকেও ক্ষোভ বা অবিচার বিক্ষুব্ধ করে তুলতে পারে। নিষ্ঠুরতা আর যন্ত্রণার বিরুদ্ধে ক্ষোভ নয় বরং এর সাথে জড়িয়ে থাকা অপমানের বিরুদ্ধে ক্ষোভ। সেসময় রক্ত আমার মাথায় উঠে যায় কারণ আমার জীবনের কাজ-কর্ম সম্পর্কে ধারনা নাই এমন এক ব্যক্তি আমার জীবনের মূল্যায়ন করছিল। সেদিনের সে ঘটনার পর আমি আমার সহ-বন্দীদের কাছে লোকটি সম্পর্কে মন্তব্য করে বলেছিল যে, “তাকে দেখতে এতই কুরুচিপূর্ণ আর নির্মম ছিল যে আমার হাসপাতালের বহিঃ-রোগী ওয়ার্ডের নার্স তাকে বিশ্রাম-কক্ষ বা ওয়েইটিং রুমেও ভর্তি করাতো না।”  মন্তব্যটি করার পর বাচ্চাদের এক ধরনের শান্তি পেয়েছিলাম বটে।

সৌভাগ্যবশত: আমার কাজের দলের ক্যাপোটি আমার বাধ্য ছিল। আমি তার ভালবাসার কাহিনী ও দাম্পত্য কলহের কথা মন দিয়ে শুনেছিলাম বলে তিনি আমাকে পছন্দ করতে শুরু করেন। আমাদের কাজের সময় তিনি তার মনে কথা উজাড় করে আমাদের বলতেন। আমি তার চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য নির্ণয় করতে ও বিনামূল্যে তাকে আমার মনোচিকিৎসামূলক (psychotherapeutic) উপদেশ দেওয়া ফলে তার উপর আমি এক মানসিক প্রভাব পেলতে সমর্থ হয়। তারপর থেতে তিনি আমার প্রতি কৃতজ্ঞ-বোধ প্রকাশ করতে শুরু করেন যা ইতিমধ্যে আমার কাছে অনেক মূল্যবান ছিল । এর আগে বেশ কয়েকবার তিনি দু’শো আশি জন লোক নিয়ে গঠিত আমাদের বিশেষ কর্মী-দলের প্রথম পাঁচটি সারির মধ্যে একটি সারিতে আমার জন্য তাঁর পাশে একটি জায়গা সংরক্ষণ করে রেখেছিলেন। সেই অনুগ্রহটি আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ ছিল। সে সময় অন্ধকার থাকা অবস্থায় ভোরে আমাদের লাইনে দাঁড়াতে হয়েছিল। আর দেরি করে ফেলার কারণে সবাই পেছনের সারিতে দাঁড়াতে ভয় পাচ্ছিল।

যদি কোনো অপ্রীতিকর এবং অপছন্দনীয় কাজের জন্য লোকের প্রয়োজন হয়, তাহলে একজন সিনিয়র ক্যাপু উপস্থিত হয়ে সাধারণত পিছনের সারি থেকে তার প্রয়োজনীয় লোক সংগ্রহ করতো। এই লোকদের অপরিচিত প্রহরীদের অধীনে বিশেষ ভয়ঙ্কর ধরনের কাজের উদ্দেশ্যে রওয়ানা করতে হয়। মাঝেমধ্যে সিনিয়র ক্যাপোই প্রথম পাঁচ সারি থেকে লোক বাছাই করে নিতো, যারা চালাকি করতে চেষ্টা করতো তাদের পাকড়াও করার জন্য। সব আপত্তি আর অনুরোধ কয়েকটি সুনির্দিষ্ট লাথি দ্বারা শান্ত করে দেওয়া হতো, এবং চিৎকার আর কিল-ঘুসি দিয়ে বাছাই করা ভুক্তভোগীদের তাড়িয়ে এক সভাস্থলে নিয়ে যাওয়া হতো।

তবে, যতক্ষণ না আমার ক্যাপো তার হৃদয় উজাড় করে কাহিনী বলার দরকার মনে করতো, ততক্ষণ আমি এসব কাজকর্ম থেকে রেহাই পেতাম। তার পাশে আমার সম্মানের স্থান নিশ্চিত ছিল। তার মাঝে আরও একটি সুবিধা ছিল। প্রায় সব সহ-বন্দীদের মতোই আমিও একবার ইডেমা রোগে ভুগছিলাম। আমার পা’দুটা ভীষণভাবে ফুলে যাওয়ার কারণে উপরের চামড়া এতই শক্তভাবে প্রসারিত হয়ে পড়েছিল যে আমি খুব কমই হাঁটু বাঁকা করতে পারতাম। আমার ফুলে যাওয়া পা’র সাথে জুতা যুতসই রাখতে আমাকে জুতোর ফিতা খোলা রাখতে হতো। মোজা থেকে থাকলেও তার জন্য তাতে কোনো জায়গা ছিলনা। তাই আমার পায়ের আংশিকটা সবসময় ভেজা আর জুতো থাকতো বরফে ভর্তি। এটি অবশ্য বরফের আঘাতজনিত যন্ত্রণা ও ঠাণ্ডাজনিত ক্ষত সৃষ্টি করতো। প্রতিটি পদক্ষেপ হয়ে উঠে প্রকৃত অত্যাচার। বরফে ঢাকা মাঠে আমাদের কুচকাওয়াজের সময় জুতোয় বরফ ডুকে শক্ত গুচ্ছ ধারণ করতো। বারবার লোকজন পা পিছলে পড়ে গেলে পেছনের লোকজন হুমড়ি খেয়ে তাদের উপর এসে পড়তো। তাতে সারিটি এক মুহূর্তের জন্যে থেমে যেতো। আর প্রহরীদের একজন দ্রুত পদক্ষেপ নিয়ে মানুষগুলোর উপর কাজ করতো আর তার রাইফেলের গোরা দিয়ে তাদের দ্রুত উঠে দাঁড়ানোর বাধ্য করাতো। যত বেশি আপনি সারির সামনে থাকবেন, থামিয়ে আপনাকে ততো কম বিরক্ত করা হতো। আর পায়ে ব্যথা নিয়ে দৌড়ে ক্ষতি হওয়া সময় পুষিয়ে দিতে হবে না। আমি আমার ক্যাপুর একজন সম্মানিত চিকিৎস্য হতে বা “হিজ অনার দ্য ক্যাপু” হিসেবে নিযুক্ত হয়ে খুবই খুশি হয়েছিলাম। তার কারণে সমান-তালে কুচকাওয়াজ করার জন্য আমার জায়গা হতো প্রথম সারিতে।

আমার চিকিৎসা সেবার জন্য বাড়তি মজুরী হিসেবে আমাদের কাজের স্থানে মধ্যাহ্নভোজনের সময় সুপের ব্যাপারে আমি নিশ্চিত থাকতে পারতাম। সুপ পরিবেশনের সময় আমার পালা আমার পালা আসতেই তিনি সুপ পরিবেশনের বড় চামচটা চৌবাচ্চার তলায় ডুবিয়ে কিছু মটর তুলে নিয়ে আসতেন আমার জন্য। এক সময়ের এক আর্মি অফিসার এই ক্যাপু কাজের দলের মাঝিকে, যার সাথে আমি ঝগড়া করেছিলাম, সাহস করে ফিসফিসয়ে বলেছিলেন যে তিনি আমাকে একজন অস্বাভাবিক ভাল কর্মী হিসেবে জানেন। সেই ক্যাপোকে আমার শিবির জীবনে তেমন কোনো কাজে না আসলেও, তিনি বহুবার আমার জীবন বাঁচাতে সক্ষম হয়েছিলেন। কাজের দলের মাঝির সাথে সে দিনের ঘটনার পরের দিন তিনি (ক্যাপু) আমাকে গোপনে অন্য একটি কাজের-দলে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন।

******

আমাদের জন্যে কষ্টবোধ করেছিলেন এমন দল-প্রধান বা মাঝিও ছিলেন যারা অন্তত নির্মাণ স্থলে আমাদের কষ্টকর পরিস্থিতিকে আরামদায়ক করে তোলার জন্য সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু তারাও অল্প সময়ের মধ্যে একজন সাধারণ শ্রমিক আমাদের চেয়ে কয়েকগুণ বেশি কাজ করেছে তা আমাদের মনে করিয়ে দিতে থাকে। কিন্তু তাদের বলার পর একজন কয়েদি কেনো একজন সাধারণ শ্রমিকের চেয়ে কম কাজ করে তারা এর কারণ লক্ষ্য করে যে, একজন সাধারণ কর্মী প্রতিদিন ১০.৫ আউন্স রুটিতে আর ১৩⁄৪  পিন্ট পাতলা স্যুপ খেয়ে বেঁচে থাকে না। যেখানে তাত্ত্বিকভাবে বলতে গেলে আমরা অনেক সময় তার চেয়েও কম পেতাম। একজন সাধারণ শ্রমিককে পরিবারের কোনো খবর না পেয়ে আমাদের মতো মানসিক চাপের মধ্যে দিন যাপন করতে হয়নি। যেখানে আমাদের হয় অন্য শিবিরে নতুবা তৎক্ষণাৎ পাঠিয়ে দেওয়া হতো গ্যাস দিয়ে মারার জন্য। আমাদের ন্যায় একজন সাধারণ কর্মীকে ক্রমাগতভাবে প্রতিদিন এবং প্রতি ঘন্টায় মৃত্যুর হুমকি দেওয়া হয়নি। কোনো এক দয়াবান দল-প্রধানকে আমি এও বলেছিলাম “আমি যেমন আপনার কাছ থেকে সড়ক নির্মাণের কাজ শিখছি, আপনি যদি আমার কাছ থেকে সংক্ষিপ্ত সময়ের মধ্যে কিভাবে মস্তিষ্ক অপারেশন করতে হয় তা শিখতে পারেন তাহলে আপনার প্রতি আমার যথেষ্ট শ্রদ্ধাবোধ থাকবে।” আর তিনি তাতে মুচকি হেসেছিলেন।

******

বন্দীদের দ্বিতীয় স্তরের লক্ষণ যেমন, বেদনাবোধহীনতা বা অনুভূতিহীনতা ছিলো এক আত্মরক্ষার কৌশল। বাস্তবতাকে ম্লান করে সমস্ত প্রচেষ্টা আর সব আবেগ ছিল কেবল একটিমাত্র কাজকে কেন্দ্র করে: নিজের এবং অন্য সহকর্মীদের জীবন রক্ষা করা। কাজের স্থল থেকে শিবিরে ফিরে যাওয়ার সময় বন্দীদের স্বাভাবিকভাবে বলতে শুনা যেত: “ভালো, আরও একটি দিনের সমাপ্তি হলো।” 

এরকম হতাশ পরিস্থিতিতে সহজেই বোঝা যায় যে, বেঁচে থাকার প্রয়োজনীয়তার প্রতি একেকজন মানুষের ক্রমাগত মনোযোগী হওয়ার সম্পৃক্তাতা তার আভ্যন্তরীণ জীবনকে এক আদিম পর্যায়ে পর্যবসিত করে। মনো-বিশ্লেষণে প্রশিক্ষিত আমার কয়েকজন সহকর্মী কয়েদিদের মানসিক “Regression” সম্পর্কে প্রায় বলে থাকতেন। “Regression” মানে অধিকতর আদিম মানসিক অবস্থায় ফিরে যাওয়া। তখন তার ইচ্ছা-আকাঙ্খকা আর বাসনা তার স্বপ্নে স্পষ্টতর হয়ে উঠে। 

একজন কয়েদি প্রায়শই: কিসের স্বপ্ন দেখত? সে স্বপ্ন দেখত রুটির, পিঠার, সিগারেটের ও একটি উষ্ণ স্নানের। সাধারণ এই প্রত্যাশা পূরণের অভাব তাকে স্বপ্নের মাধ্যমে আকাঙ্ক্ষা-সিদ্ধি বা ইচ্ছা-পূরণের দিকে চালি করে। এ স্বপ্ন তার কোনো কাজে আসলো কিনা তা অন্য বিষয়। তবে স্বপ্ন দেখা লোকটিকে শিবির জীবন আর তার স্বপ্ন বিভ্রমের মাঝে স্বপ্ন ছেড়ে ভয়ংকর বৈপরীত্যের বাস্তবতায় জেগে উঠতে হতো। 

একরাতে এক কয়েদির গোঙানি শব্দে কিভাবে আমাকে ঘুম থেকে জাগিয়ে তোলা হয়েছিল তা আমি কখনও ভুলবনা। দৃশ্যতই ভয়ঙ্কর দুঃস্বপ্নে ঘুমের ঘোরে সে হাত-পা ছোড়াছুড়ি করছিল। ভয়ঙ্কর স্বপ্ন বা ঘুমের ঘোরে প্রলাপ বকা লোকদের জন্য যেহেতু আমি সবসময় কষ্ট পেতাম, তাই আমি বেচারা লোকটিকে জাগাতে চেষ্টা করলাম। হঠাৎ আমি যা করতে সচেষ্ট হয়েছিলাম তাতে ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে যে হাত দিয়ে তাকে নাড়া দিতে চেয়েছিলাম তা ফিরিয়ে নিয়ে আসলাম। আর ঠিক সেই মুহূর্তে একটি বিষয় নিয়ে প্রবলভাবে সচেতন হয়ে উঠলাম যে, স্বপ্ন যতই ভয়ঙ্কর হোক না কেনো, তা আমাদের চারপাশে ঘিরে থাকা শিবিরের বাস্তবতার চেয়ে মন্দ হতে পারে না।

কয়েদিরা যে পরিমাণের উচ্চমাত্রার অপুষ্টিতে ভুগছিল তাতে করে একটা জিনিস খুবই স্বাভাবিক ছিল যে, খাবারের প্রতি তাদের উচ্চ বাসনা ছিল মানুষের একটি প্রধান আদিম সহজাত প্রবৃত্তি যাকে কেন্দ্র করে আমাদের মানসিক জীবন আবর্তিত। একে অপরের কাছাকাছি কাজ করার সময় অধিকাংশ কয়েদিদের  একবার দুর থেকে পর্যবেক্ষণ করা হয়েছিল। তাতে লক্ষ্য করা যায় যে, কাজ করার সাথে সাথে তারা খাবার নিয়ে আলোচনা শুরু করে দিচ্ছে। একজন তার পাশে কাজে ব্যস্ত অন্য সহকর্মীকে জিজ্ঞেস করছে তার প্রিয় খাবারের ব্যাপারে। তারপর তারা রেসিপি বিনিময়ের কথা বলে এবং অদূর ভবিষ্যতে শিবির থেকে মুক্ত হয়ে বাড়ি ফিরে যাওয়ার পর পুনর্মিলনীর দিনের জন্য খাবারের তালিকা তৈরির পরিকল্পনাও করেছিল। তাদের এই আলোচনা চলতেই থাকে। সবকিছু বিস্তারিতভাবে বর্ণনা করতে করতে তারা শুধু খাবারের কথাই বলে যেতো, যতক্ষণ না হঠাৎ করে পরিখা জুড়ে কোনো সতর্ক সংকেত বয়ে গেলো। আর এই সতর্ক সংকেত সাধারণত বিশেষ কোনো পাসওয়ার্ড বা সংখ্যা আকারে আসতো, যেমন “প্রহরী আসছে”।

*******

খাবার নিয়ে আলোচনাকে আমি সবসময়ই বিপজ্জনক ভাবতাম। যখন একজন মানুষ অত্যন্ত কম খাবার ও নিম্ন-মাত্রার ক্যালোরিতে কোনও রকম মানিয়ে নিতে সফল হয়েছিল তখন খাবারের এরকম বিশদ বর্ণনা আর আবেগ-তাড়িত চিত্রের মাধ্যমে কোনো প্রাণী সত্ত্বাকে প্ররোচিত করাটা কি ভুল নয়? সম্ভবত সে আলোচনা সাময়িকের জন্য আমাদের মনস্তাত্ত্বিক বা মানসিক স্বস্তি নিয়ে আসবে। তবে এটি এমন এক বিভ্রম যা নিঃসন্দেহে মানসিকভাবে বিপদমুক্ত নয়। পরবর্তী বন্দীদশায় প্রতিদিন একবার খাবার হিসেবে আমাদের তরল স্যুপ ও প্রতিদিনকার ছোট একটুকরো রুটির বরাদ্দ দেওয়া হতো। প্রতিদিনের বৈচিত্রতা নিয়ে সে খাবারের পাশাপাশি ছিল তথাকথিত “অতিরিক্ত ভাতা”। তাতে থাকতো এক আউন্সের ৩/৪ অংশ মার্জারিন মাখন, অথবা নিম্নমানের এক ফালি সসেজ, বা ছোট একখানা পনির, বা একটুখানি কৃত্রিম মধু, বা এক চামচ তরল জ্যাম। আমাদের দৈনিক শারীরিক পরিশ্রম ও ক্রমাগত অপর্যাপ্ত কাপড়ে প্রচণ্ড ঠাণ্ডায় বের হওয়াটা বিবেচনায় আনলে, প্রয়োজনীয় ক্যালোরি পরিমাণের দিক থেকে বিচার করতে গেলে খাবার হিসেবে আমাদের যা দেওয়া হতো তা ছিল একেবারেই অপর্যাপ্ত। ‘বিশেষ সেবা’র আওতায় থাকা অসুস্থদের অবস্থা ছিল আরও করুন। শিবির ছেড়ে যাওয়ার পরিবর্তে তাদের ছাউনিতে শুয়ে থাকার অনুমতি দেওয়া হতো।

ত্বকের নিম্নবর্তী চর্বির শেষ স্তরটি বিলীন হয়ে যাওয়ার পর আমাদের দেখে মনে হতো আমরা যেন চামড়া আর ময়লা কাপড়ের আড়ালে লুকিয়ে থাকা কয়েকটি কঙ্কাল। আমরা দেখতে পেতাম আমাদের দেহ ক্রমে ক্রমে আমাদের গ্রাস করা শুরু করেছে। জীবদেহটি নিজের সব প্রোটিন পরিপাক করে নিয়েছে, আর মাংসপেশি হয়ে গেছে বিলুপ্ত। তার শরীরের কাছে কোনো প্রতিরোধ ক্ষমতা অবশিষ্ট থাকলো না। আমাদের ছাউনির ছোট জনগোষ্ঠীর সদস্যরা একের পর এর এক মরে যেতে থাকে। আমরা প্রত্যেকে পরবর্তীতে কার পালা, আর তার নিজেরটা কবে আসবে তা বেশ ভালো করে অনুমান করতে পারতাম। অনেক পর্যবেক্ষণের পর আমরা তার লক্ষণ বুঝতে পারতাম, যা আমাদের ভবিষ্যদ্বাণীর যথার্থতা বেশ নিশ্চিত করতো। “সে আর বেশি দিন টিকবে না”, বা “এটি পরবর্তীটা”, বলে আমরা একে অন্যের কাছে কানাকানি করতাম। আর আমাদের দৈনিক উকুন বাছার সময় সন্ধ্যায় আমরা আমাদের নগ্ন শরীর দেখে ভাবতাম: আমার এই দেহটি ইতিমধ্যেই বস্তুত একটি লাশে পরিণত হয়েছে। আমার কি পরিণতি হয়েছে? আমি মানবীয় মাংসের বিশাল এক পিণ্ডের ছোট এক অংশ ব্যতীত আর কিছুই নয়…বৈদ্যুতিক তারের পেছনে, মাটির তৈরি কয়েকটি ছাউনিতে ভিড় করা মানবীয় মাংস পিণ্ড। প্রাণহীন হয়ে পড়ার কারণে যে পিণ্ডের একটি নির্দিষ্ট অংশ প্রতিনিয়ত পচতে শুরু করে দিয়েছে।

খাদ্য আর প্রিয় সব খাবারের চিন্তা যে কতোটা অনিবার্য হয়ে উঠতে পারে তা আমি উপরে উল্লেখ করেছি। অবসর আসলেই তা একজন কয়েদির চৈতন্যে জোর করে ফিরে আসে। সম্ভবত এটি বোঝা যায় যে, আমাদের মধ্যে সবচেয়ে শক্তিশালী ব্যক্তিটিও এমন এক সময়ের আকাঙ্খকা করছিল যখন সে পুনরায়  ভাল খাবার খেতে পারবে। ভাল খাবারে স্বার্থে ভালো খাবার নয় বরং আমাদের যে অর্ধ-মানবিক জীবন খাদ্য ব্যতীত অন্য কিছুর কথা ভাবতে অক্ষম করে তুলেছিল  তাকে বোঝার স্বার্থে।

যারা এরকম অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যায়নি তারা আত্মা-বিনষ্টকারী এই মানসিক সংঘাত আর একজন ক্ষুধার্ত মানুষের অনুভব করা ইচ্ছাশক্তির দ্বন্দ্বের কথা খুব কমই ধারনা করতে পারে। তারা বুঝতে পারবে না যে পরিখা খননের মাঝখানে দাঁড়িয়ে সাইরেনে সকালের নাস্তার জন্য আধা ঘণ্টা বিরতির ৯:৩০ বা ১০:০০ টা ঘোষণা শোনার অনুভূতি। আর মাঝি যদি ভিন্নমত পোষণকারী ব্যক্তি না হয়ে থাকে তাহলে বার বার তার কাছে কয়টা বাজে জিজ্ঞেস করা; আর কারো কোটের পকেটে থাকা রুটির টুকরোটি সযত্নে স্পর্শ করে প্রথমে হিমায়িত মোজা-হীন আঙ্গুল দিয়ে হাত বুলিয়ে তারপর একটুকরো ভেঙ্গে নিয়ে মুখে পুরে দিয়ে অবশেষে, ইচ্ছাশক্তির শেষটুকু দিয়ে, পুনরায় আর অর্ধেক পকেটে ঢুকিয়ে রেখে নিজের সাথে প্রতিজ্ঞা করা যে এইটুকু দুপুর পর্যন্ত টিকিয়ে রাখতে হবে।

আমাদের বন্দী অবস্থার পরবর্তী সময়ে প্রতিদিনের দেওয়া ছোট রুটির বরাদ্দ বণ্টনের নির্দিষ্ট পদ্ধতির অর্থ-অনর্থ নিয়ে আমরা অন্তহীন বিতর্ক তুলতে পারি। বরাদ্দ বণ্টনের পদ্ধতিকে কেন্দ্র করে দুইটি আলাদা মতধারা সৃষ্টি হয়েছিল। একদল মনে করতো আমাদের বরাদ্দ দেওয়া রুটিটি বাঁচিয়ে না রেখে তৎক্ষণাৎ খেয়ে ফেলা উচিৎ। প্রথম বিতর্ক অনুযায়ী তাতে খুব অল্প সময়ের জন্য হলেও অন্ততপক্ষে দিনে একবার ক্ষুধার তীব্রতা নিবারণ সুযোগ ও খাদ্যের সম্ভাব্য চুরি যাওয়া বা হারিয়ে যাওয়া থেকে রক্ষা পাওয়ার মতো দ্বিগুণ সুবিধা আছে। দ্বিতীয় পক্ষ ভিন্ন মতের মাধ্যমে বরাদ্দকৃত খাদ্যকে ভাগ করে খাওয়ার পক্ষে সমর্থন দিয়েছিল। আর শেষমেশ আমি দ্বিতীয় পক্ষের কাতারে যোগ দিই।

শিবির জীবনের চব্বিশ ঘণ্টার মাঝে সবচেয়ে ভয়ানক ছিল ঘুম থেকে জেগে উঠা। রাত্রের নীরবতার মাঝে বাঁশির তিনটি তীক্ষ্ণ ফুঁ ক্লান্তির ঘুমটুকু এবং তীব্র বাসনার স্বপ্নটুকু আমাদের কাছ নিষ্ঠুরভাবে কেড়ে নিতো। ইডেমার কারণে পায়ে ক্ষত ও পা ফুলে যাওয়ায় আমরা আমাদের পা ঢুকাতে না পারলে জুতোর সাথে ধস্তাধস্তি শুরু করে দিতাম। তার উপর ছিল জুতোর ফিতার পরিবর্তে ব্যবহৃত হওয়া তার কামড়িয়ে ভাঙ্গা নিয়ে তুচ্ছ সমস্যা নিয়ে স্বাভাবিক কান্নাকাটি আর হায়-হুতাশ। যাকে আমি সাহসী আর বীরত্বপূর্ণ মনে করতাম সেও দেখি এক সকালে বাচ্চার মতো কাঁদছে কারণ শেষমেশ তাকে খালি পায়ে বরফে-ডাকা মাঠে কুচকাওয়াজের যেতে হচ্ছিল। তার জুতোগুলি এতই কুচকে গিয়েছিল যে তা সে আর পড়তে পারছিলো না। সেই ভয়ানক মুহূর্তেই আমি একটু সান্ত্বনা খুঁজে পায়; রুটির টুকরোটি বের করে এনে এনে নিবিড় আনন্দে তা চিবুতে থাকলাম।

পুষ্টিহীনতার পাশাপাশি খাবারের প্রতি আমাদের সহজাত সার্বক্ষণিক চিন্তার কারণেই হয়তো সাধারণভাবে শিবিরে যৌন তাড়না ছিল না। প্রচণ্ড মানসিক আঘাতের প্রাথমিক প্রভাব ব্যতীত, পুষ্টিহীনতা এবং খাবারের মানুষের সহজাত সার্বক্ষণিক চিন্তা-ই এমন ঘটনার একমাত্র ব্যাখ্যা যা একজন মনোবিজ্ঞানীকে পুরুষ অধ্যুষিত শিবির সমূহ পর্যবেক্ষণ করতে বাধ্য করে। পর্যবেক্ষণে দেখা যায় যে, সেনানিবাসের মতো পুরুষ অধ্যুষিত অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের তুলনায় শিবিরে যৌন বিকৃতি ছিল কম। এমনকি স্বপ্নেও একজন বন্দীকে যৌনতা নিয়ে উদ্বিগ্ন হয়েছে বলে মনে হয়নি, যদিও তার প্রতিহত আবেগ আর সুন্দরতম, উচ্চতর অনুভূতি সমূহ স্বপ্নেই সুস্পষ্ট অভিব্যক্তি খুঁজে পায়।

আদিম জীবন ধারণ আর কেবল নিজের জীবন বাঁচিয়ে রাখার প্রতি কেন্দ্রীভূত প্রচেষ্টা অধিকাংশ বন্দীকে যা কিছু সেই উদ্দেশ্য সাধন করে না তাকে সম্পূর্ণভাবে অগ্রাহ্য করার দিকে ধাবিত করেছিলো। আর তা বন্দীদের অনুভূতি-হীনতার কারণও হয়ে উঠেছিল। অশউইৎস থেকে জার্মানির ডাক্সাও বন্দী শিবিরে হস্তান্তর করার পর তা আমি পরিষ্কার বুঝতে পারি। প্রায় ২০০০ বন্দীকে বহন করে নিয়ে যাওয়া ট্রেনটি অস্ট্রিয়ার ভিয়েনা হয়ে চলে গেলো। প্রায় মাঝরাতে ভিয়েনার কয়েকটি রেল স্টেশন অতিক্রম করি। পথটি আমি যেখানে জন্মগ্রহণ করেছিলাম সে সড়ক, যে বাড়িতে বন্দী করে নিয়ে যাওয়ার আগ পর্যন্ত আমি আমার জীবনের অধিকাংশ বছর পার করেছি তার পাশ দিয়ে চলে যাচ্ছিল। আমাদের পঞ্চাশ-জন বন্দীকে বহন করা কামরায় উঁকি দিয়ে দেখার জন্য দুটি খিল আঁটা ছোট ছিদ্র ছিল। 

শুধু একদল মানুষের জন্য মেঝেতে হাঁটু গেড়ে বসার পর্যাপ্ত জায়গা ছিল। বাকিরা ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ছিদ্রগুলির পাশে ভিড় করছিল। পায়ের আঙ্গুলে দাঁড়িয়ে ও অন্যদের মাথার উপর দিয়ে ছিটকানির ভেতর দিয়ে চোখ রাখলে আমার স্থানীয় শহরের আতঙ্কজনক দৃশ্য আমার চোখে ধরা দেয়। সবাই যেন জীবনের চেয়ে মৃত্যুকে বেশী অনুভব করেছিলাম তখন, কারণ আমাদের ধারনা ছিল ট্রেনটি অস্ট্রিয়ার মথাসেন বন্দী শিবির অভিমুখে এগিয়ে যাচ্ছিল। মথাসেন বন্দী শিবিরের দিকে যাওয়া মানে জীবনের দু’য়েক সপ্তাহ বাকি থাকা। আমার পরিষ্কার অনুভূতির মাধ্যমে এক মৃত মানুষের দৃষ্টি দিয়ে আমি দেখতে পেলাম আমার ছেলেবেলার সড়ক সমূহ, বাড়িঘর বেষ্টিত উন্মুক্ত স্থান ও বাড়িঘর। মনে হচ্ছিল যেন এক অন্য জগত থেকে ফিরে আসা এক মৃত মানুষ ভৌতিক কোনো শহরের দিকে তাকাচ্ছে।

কয়েক ঘণ্টা বিলম্বের পর ট্রেনটি ষ্টেশন ত্যাগ করে। কয়েকজন বালক যারা শিবির জীবনে কয়েক বছর পেছনে ফেলে এসেছে এবং যাদের কাছে এরকম কোনো যাত্রা ছিল খুবই উল্লেখযোগ্য তারা মনোযোগের সাথে সেই ছিদ্র দিয়ে উঁকি দিয়ে বাইরে তাকিয়ে বলে উঠে, “ঐ-তো মহা-সড়কটি-আমার মহাসড়ক”!। আমি তাদের অনুনয়-বিনয় করে অনুরোধ করে বলেছিলাম তারা যেন আমাকে কেবল এক মুহূর্তের জন্য ছিদ্রগুলি সামনে দাঁড়াতে দেয়। জানালার ভেতর দিয়ে আমার শহরকে এক দৃষ্টি দেখা কতটা দরকার তা আমি তখন তাদের বোঝাতে চেষ্টা করেছিলাম। আমার অনুরোধকে তারা রুক্ষতা আর হতাশার সাথে ফিরিয়ে দিয়ে বলেছিল, “এতগুলি বছর আপনি এখানে কাটিয়েছেন? বেশ, তাহলো তো আপনি ইতিমধ্যেই অনেক দেখে ফেলেছেন, আর দেখতে হবে না!”

সাধারণত শিবিরে একটি  “cultural hibernation” বা  “সাংস্কৃতিক শীতলতা বা নিষ্ক্রিয়তা”র একটি বিষয় ছিল। রাজনীতি এবং ধমের্র মতো দুটি বিষয় এই সাংস্কৃতিক শীতলতার বাইরে ছিল।  শিবিরের সবখানেই ,অনেকটা একটানাভাবে, রাজনীতি নিয়ে আলোচনা হতো। আর এই আলোচনা ছিল মূলত গুজব ভিত্তিক, যা তড়িঘড়ি করে সংগ্রহ করে সাগ্রহে বিলি করে দেওয়া হতো। সেনা পরিস্থিতি নিয়ে গুজব সমূহ প্রায়শই ছিল পরস্পরবিরোধী। এসব গুজব একে একে সবাইকে দ্রুত প্রভাবিত করে কয়েদিদের মনে স্নায়ু যুদ্ধ সৃষ্টিতে অবদান রাখতে সফল হয়েছিল। অনেক সময়, চলমান যুদ্ধের অবসান হয়ে যাওয়ার অনেক আশাবাদী গুজব বহু প্রত্যাশাকে নিরাশ করে দিয়েছিল। কিছু মানুষ সমস্ত আশা হারিয়ে ফেলে। তবে একরোখা আশাবাদীরাই ছিল সবচেয়ে বিরক্তিকর সঙ্গী। কয়েদিদের কাছে ধর্মীয় আগ্রহ খুব দ্রুত প্রচার আর প্রসার লাভ করতো।

তাদের ধর্মীয় আগ্রহ ছিল অকল্পনীয়ভাবে অকৃত্রিম। ধর্মীয় বিশ্বাসের প্রতি তাদের গভীরতা আর দৃঢ়তা প্রায় সময় একজন নতুন আগত কয়েদিকে হতবাক এবং আন্দোলিত করতো। কোনো এক ছাউনির কোনায় বা গবাদিপশু বহনের বদ্ধ ট্রাকের অন্ধকারে তাৎক্ষণিকভাবে আয়োজন করা প্রার্থনা বা প্রার্থনা-অনুষ্ঠান ছিল ধর্মীয় আগ্রহের সাথে সংশ্লিষ্ট সবচেয়ে মনোযোগ আকর্ষণকারী বিষয়। তাতে  অংশগ্রহণের জন্য দূরদূরান্তের কর্ম স্থল থেকে, ক্লান্ত, ক্ষুধার্ত আর জরাজীর্ণ বস্ত্রে হাড় কাঁপানো শীতে আমাদের ফিরে যেতে হতো।

১৯৪৫ সালের শীত ও বসন্তকালে বয়ে যাওয়া টাইফাস রোগের মহামারি শিবিরের প্রায় সব কয়েদিদের আক্রান্ত করে বসে। দুর্বলদের মাঝে মৃতের হার ছিল বেশি। তাদরে যতোটা সম্ভব কঠোর পরিশ্রমে ব্যস্ত রাখতে হয়েছিল। অসুস্থদের কোয়ার্টারগুলি ছিল সবচেয়ে বেশি অনুপযুক্ত স্থান, যেখানে বলতে গেলে ছিল না কোনো ঔষধ-পত্র বা রোগীদের দেখাশুনা করার মতো কোনো লোকজন। টাইফাসের কোনো কোনো লক্ষণ ছিল একেবারে আলাদা। সামান্যটুকু খাবারের প্রতি অদম্য অনীহা ছিল জীবনের জন্য একটি বাড়তি বিপদ। তার সাথে ছিল অসুস্থাবস্থায় প্রলাপ বিকারের ভয়াবহ আক্রমণ। আমার এক বন্ধু বিপদজনকভাবে প্রলাপ বিকারে ভুগেছিল। সে ভেবেই নিয়েছিল যে সে মরে যাবে আর তার জন্য সে শেষবারের মতো প্রার্থনা করতে চেয়েছিল। প্রলাপের ঘোরে সে কোনো কথা খুঁজে পাচ্ছিল না। এ ধরনের প্রলাপ বিকারের আক্রমণ থেকে নিজেকে রক্ষা করার জন্য অনেকের মতো আমি নিজেকে জাগিয়ে রাখতে চেষ্টা করেছিলাম অধিকাংশ রাত। অবশেষে, অশউৎসের জীবানুমুক্তকরণ বুথে আমার যে পাণ্ডুলিপিটি হারিয়েছিলাম উচ্ছিষ্ট কাগজের টুকরায় বিশেষ মন্তব্যগুটি টুকে রেখে তা পুনরায় লিখার কাজ শুরু করে দিয়েছিলাম।

কোনো এক বিশেষ অনুষ্ঠানকে কেন্দ্র করে শিবিরে একটি বৈজ্ঞানিক বিতর্কের উন্নতি ঘটে। এক সময় শিবিরে আমি এমন কিছু জিনিস দেখি যা আমি আমার স্বাভাবিক জীবনে কখনও দেখিনি, যদিও তা একজন মনোরোগ বিশেষজ্ঞ হিসেবে কিছুটা আমার নিজের পেশাগত আগ্রহের কাছাকাছি ছিল। অনুষ্ঠানটি ছিল মৃতদের সঙ্গে আধ্যাত্মিকভাবে ভাবের আদান-প্রদানের জন্য বৈঠক। শিবিরের একজন কয়েদি প্রধান চিকিৎসক আমাকে অনুষ্ঠানটিতে অংশগ্রহণের আমন্ত্রণ করেছিলেন। তিনি জানতেন যে আমি একজন মনোরোগবিদ্যার বিশেষজ্ঞ। অসুস্থদের কোয়ার্টারে তার ছোট গোপন কক্ষে আমাদের সাক্ষাত হয়। ছোট গোলাকারে আগন্তুকরা জমায়েত হলো। যাদের মধ্যে, বেশ অবৈধভাবে, উপস্থিত ছিলেন স্বাস্থ্য-সুরক্ষা দলের ওয়ারান্ট অফিসার। একব্যক্তি একধরনের প্রার্থনার মাধ্যমে আত্মার আহ্বান করা শুরু করে দিলেন। কোনো কিছু লিখার মনস্থির না করে শিবিরের কেরানী একটুকরো সাদা কাগজের শিটের সামনে বসে পড়লো। পরবর্তী দশ মিনিট পর মন্ত্র উচ্চারণ করার মাধ্যমে দিয়ে ভূত বা আত্মার প্রকাশ ঘটাতে ব্যর্থ হওয়ায় মৃতদের আত্মার সাথে ভাবের আদান-প্রদান অনুষ্ঠান ভণ্ডুল হয়ে যায়। তারপর কেরানী কাগজের উপর পেন্সিল দিয়ে সরলরেখা মতো কি একটা আঁকলেন যা ক্রমে ক্রমে দেখতে অনেকটা ল্যাটিন “VAE V” এর মতো হয়ে উঠলো। ধারনা করা হয়েছিল যে কেরানীটি কখনও ল্যাটিন ভাষা শেখেননি ও এর আগে কখনও তিনি “VAE V” বা “vae victis” কথাগুলি শোনেননি। যার অর্থ “ধিক পরাজিতদের”। আমার ধারনা সে কোথাও না কোথাও সে কথাগুলি শুনেছিলেন যা সে স্মরণ করতে পারছিলেন না। আমাদের মুক্তির কয়েকমাস পূর্বে এবং যুদ্ধের শেষ প্রান্তে এসে তার spirit of subconscious mind বা তার অবচেতন মনের আত্মায় আবির্ভূত হয়।

*******

বন্দী শিবিরে জীবন-যাপনের সকল চাপিয়ে দেওয়া শারীরিক ও মানসিক আদিমত্ব (mental primitiveness) সত্ত্বেও আধ্যাত্মিক জীবনকে আরও উন্নত করা সম্ভব ছিল। সমৃদ্ধ বুদ্ধিবৃত্তিক জীবন-যাপনে অভ্যস্ত স্পর্শকাতর ব্যক্তিরাই সম্ভবত বেশি কষ্ট পেয়েছিলো। তারা প্রায়শই এক নমনীয় জীবন-বিধানের পক্ষে কথা বলতো। তথাপি তাদের আভ্যন্তরীণ সত্ত্বার (inner selves) ক্ষতিসাধন ছিল কম। তারা তাদের চারপাশের ভয়ানক পরিবেশ থেকে নিজেদের বাঁচিয়ে এক মানসিকভাবে সমৃদ্ধশীল এবং আধ্যাত্মিক মুক্তির জীবনে আশ্রয় নিতে সক্ষম হয়েছিল। কেবল এভাবেই কম কষ্টসহিষ্ণু কয়েদিরা কিভাবে শক্তিশালী প্রকৃতির লোকদের চেয়ে দিব্যি ভালোভাবেই শিবিরে বেঁচে থেকেছিল সেই লক্ষণীয়  বৈপরীত্য paradox কে ব্যাখ্যা করা যেতে পারে। নিজের অবস্থানকে পরিষ্কার করতে আমাকে আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতায় ফিরে যেতে হলো বাধ্য হয়ে। সকালে কুচকাওয়াজ করতে করতে আমাদের যে কাজের স্থানে যেতে হয়েছিল সেখানে কি ঘটেছিল তা বলছি।

উচ্চ চিৎকারে আমাদের আদেশ দেওয়া হচ্ছিল: ডিটাচমেন্ট, সম্মুখে মার্চ করো! লেফট -২-৩-৪! লেফট -২-৩-৪! লেফট -২-৩-৪! লেফট -২-৩-৪! প্রথম-জন, লেফট এন্ড লেফট, লেফট এন্ড লেফট! ক্যাপ খুলে ফেলো! এই কথাগুলি এখনও আমার কানে বাজে। “ক্যাপ খুলে ফেলো” বলার সাথে সাথে আমরা শিবিরের ফটক পার হয়ে যেতাম। তখন অনুসন্ধান টাওয়ার থেকে আলো এসে আমাদের উপর পড়তো। ডানপিটে ভঙ্গিতে কেউ মার্চ করতে ব্যর্থ হলে তার জন্যে ছিল  লাথি। অনুমতি না পাওয়ার আগে ঠাণ্ডার কারণে কেউ যদি তার টুপিটি টেনে কান ঢাকার চেষ্টা করতো, তখনই তার চেয়ে ভয়ঙ্কর জিনিসটি ঘটতো।

মার্চ করার সময় শিবির থেকে আসা একটি সড়কের পাশ দিয়ে বড় বড় পাথরের উপর ও বৃহদাকার ডোবাগুলোর মধ্য দিয়ে যেতেই অন্ধকারে আমরা থমকে গেলাম। তাতে আমাদের সঙ্গে থাকা প্রহরীরা আমাদের উপর চিৎকার করছিল আর তাদের রাইফেলের প্রান্ত দিয়ে আমাদের তাড়া করছিল। পায়ে ক্ষত থাকাতে কেউ কেউ তার পাশের জনের বাহুতে ভর করে হাঁটছিল। কেউ কোনো কথা বলার চেষ্টা করেনি। কনকনে হাওয়া সবাইকে কথা বলা থেকে বিরত রাখে। জামার ঊর্ধ্বমুখী কলারে মুখ লুকিয়ে আমার পাশ দিয়ে মার্চ করতে থাকা এক লোক আমাকে কানে কানে বলেছিল: “আমাদের স্ত্রীরা যদি এই মুহূর্তে আমাদের দেখতে পেতো! আশা করি তারা তাদের শিবিরে ভালই আছে আর এখানে আমাদের সাথে কি ঘটেছে তা জানে না”।

********

মুহূর্তটি আমার মনে আমার স্ত্রীর ভাবনা বয়ে নিয়ে আসল। আর কোনো কথা না বলে মাইলের পর মাইল যখন আমরা বরফে পা পিছলে হোঁচট খেতে খেতে বারবার একে অন্যের উপর ভর করে, একে অন্যকে টেনে-হিঁচড়ে এগিয়ে যাচ্ছিলাম। কিন্তু আমরা উভয়েই জানতাম যে আমরা দু’জনেই আমাদের স্ত্রীদের কথা ভাবছিলাম। মাঝে মাঝে আমি আকাশের দিকে তাকাচ্ছিলাম। দেখলাম নক্ষত্ররা ম্লান হয়ে যাচ্ছিল আর ভোরের গোলাপি আলো এক সারি কালো মেঘের পেছনে ছড়িয়ে পড়ছিল। আমার মন তখনও আমার স্ত্রীর চেহারায় আটকে রয়েছে, এক অদ্ভুত সূক্ষ্মতার সাথে আমি তার প্রতিচ্ছবি কল্পনা করছিলাম। আমি তাকে সাড়া দিতে শুনলাম, দেখলাম তার হাসি, তার অকপট আর অনুপ্রেরণামূলক অবয়ব। সত্য হোক, আর মিথ্যে হোক তার চেহারার সৌন্দর্য তখন উদীয়মান সূর্যের চেয়ে বেশি উজ্জ্বল ছিল।

একটি চিন্তা এসে আমাকে অবশ করে বসে: জীবনের প্রথম আমি বহু কবিদের গানের সত্যতা বুঝতে পারি করি। বুঝতে পারি ভালবাসা সম্পর্কে বহু জ্ঞানীদের জ্ঞানে চূড়ান্ত সত্যের অস্তিত্ব। আসল কথা হলো: ভালবাসাই হচ্ছে একজন মানুষের প্রত্যাশিত চূড়ান্ত এবং সর্বোচ্চ লক্ষ্য। তারপর আমি মানব কাব্য আর মানব চিন্তার ও মানব বিশ্বাসের আরোপ করা সবচেয়ে গোপন রহস্যের অর্থ অনুধাবন করি: ভালবাসার মাধ্যমে ও ভালোবাসার মাঝেই মানুষের মুক্তি। আমি বুঝতে পেরেছিলাম এই পৃথিবীতে কোনো কিছুই অবশিষ্ট না থাকলেও প্রিয়তমাকে কল্পনা করার মাঝে ভালোবাসার স্বর্গসুখ অনুভব করার ক্ষমতা রয়েছে। হোক তা  সংক্ষিপ্ত সময়ের জন্য। একদম নিঃসঙ্গতা অবস্থায় মানুষ যখন ইতিবাচক কাজে নিজেকে প্রকাশ করতে পারে না, যখন তার একমাত্র সফলতা সঠিক ও সম্মানজনক উপায়ে কষ্টভোগের মধ্যে নিহিত থাকে, এমন পরিস্থিতিতে তার বয়ে চলা প্রেয়সীর প্রতিচ্ছবির প্রতি প্রেমময় ধ্যানের মধ্য দিয়ে সে জীবনের পরিপূর্ণতা লাভ করে। জীবনের প্রথম আমি ‘অপার মহিমার অবিরত ধ্যানে ফেরেশতারা হারিয়ে গেছে’ কথাটির মর্মার্থ অনুধাবন করতে পারি।

তখন হঠাৎ এক লোক আমার সামনে হোঁচট খেয়ে পড়লো আর তাকে অনুসরণকারীরা পড়লো তার উপরে। প্রহরীটি তড়িঘড়ি করে এসে তাদের সবার উপরে চাবুক ব্যবহার শুরু করে দেয়। এতে করে কয়েক মিনিটের জন্য আমার প্রিয়তমাকে নিয়ে ভাবনায় ব্যাঘাত ঘটে। তথাপি শীঘ্রই আমার আত্মা সে বন্দিত্বের জীবন থেকে অন্য এক জগতে ফিরে যায়, আর আমি আমার ভালবাসার মানুষটির সাথে বাক্য বিনিময় শুরু করি: আমি তাকে প্রশ্ন করি, সেই উত্তর দেয়; সে প্রশ্ন করলে আমি উত্তর দিলাম।

প্রহরী চিৎকার করে বলে উঠলেন, “থামাও”! ততক্ষণে আমরা আমাদের কাজ করার স্থানে চলে এসেছি। তাড়াহুড়া করে সবাই মোটামুটি ভাল কাজের যন্ত্রের প্রত্যাশায় ছাউনিতে ঢুকে পড়লো। প্রত্যেকেই একটি করে কোদাল বা পিক্যাক্স পেল।

“তাড়াতাড়ি করতে পারিস না, শুকরের বাচ্চারা”? প্রহরী ধমক দিয়ে বললেন। শীঘ্রই আমরা পূর্ববর্তী দিনের স্থান থেকে পরিখার ভেতরে পুনরায় কাজ শুরু করলাম। কোদালের আঘাতে হিমায়িত ভূমিতে ফাটল আর স্ফুলিঙ্গ তৈরি হচ্ছিল। লোকজন ছিল নীরব, তাদের মস্তিষ্ক অসাড় হয়ে উঠে ।

আমার মন তখনও আমার স্ত্রীর প্রতিচ্ছবিতে আটকানো। আমার প্রিয়তমা তখনও বেচে আছে না মারা গেছে সে চিন্তাটি আমার মানসপটে একটি ভাবনা দুল খেয়ে গেলো। তারপরও আমি শুধু একটি জিনিসই জানতাম, যা ইতিমধ্যে আমি ভালভাবেই রপ্ত করে পেলেছিলাম। আমি জানতাম যে, ভালবাসার মানুষের শারীরিক সত্ত্বার চেয়েও অনেক দুরে ভালবাসা বিরাজ করে। ভালোবাসা তার ভালোবাসার মানুষের আধ্যাত্মিক অস্তিত্বে, আভ্যন্তরীণ সত্ত্বায় (inner self) গভীরতম অর্থ খুঁজে পায়। তার ভালোবাসার মানুষটি প্রকৃত অর্থে উপস্থিত কিনা, জীবিত কিনা সে প্রশ্ন কোনো না কোনোভাবে ভালবাসার গুরুত্ব থামিয়ে দেয়।

আমার স্ত্রী জীবিত ছিল কিনা তা আমি জানতাম না, বা তা জানার কোনো উপায়ও ছিল না, কারণ আমার বন্দীদশা অবস্থায় ভেতর-বাইরের খবরা-খবর আদান-প্রদানের কোনো ব্যবস্থা ছিল না। তবুও সে মুহূর্তে তা কোনো ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায় নি। তা জানার দরকার ছিল না আমার; আমি কেবল জানতাম যে কোনো কিছুই আমার ভালোবাসার শক্তিকে, আমার ভাবনাকে, ও আমার প্রিয়তমার প্রতিচ্ছবিকে স্পর্শ করতে পারবে না। তখন যদি আমি আমার স্ত্রীর মৃত্যু সম্পর্কে জানতামও, তাহলে আমার মনে হয় আমি সে খবরে কোনো ধরনের বিচলিত না হয়ে তার প্রতিচ্ছবিতে নিজেকে আবিষ্ট করে রাখতাম। আর তার সাথে আমার মানসিক ভাবের আদান-প্রদান হতো ঠিক বাস্তবের মতো জীবন্ত আর তৃপ্তিকর। “সিল মোহরের ন্যায় তুমি আমায় তোমার হৃদয়ে স্থাপন করো, ভালোবাসা মৃত্যুর মতোই শক্তিশালী”।

*********

আভ্যন্তরীণ জীবনের এই তীব্রতা বন্দীদের আত্বঃসারশুন্যতা, নিঃসঙ্গতা এবং তার অস্তিত্বের আত্মিক দীনতা থেকে অতীতে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার মাধ্যমে আশ্রয় খুঁজে পেতে সাহায্য করেছিল। কল্পনার স্বাধীনতায় সে তার অতীতের তুচ্ছ আর মামুলি মুহূর্তগুলি নিয়ে খেলা করে। তার গৃহকাতর স্মৃতি সেসব তুচ্ছ ঘটনা সমূহকে মহিমান্বিত করে তুলে ও তা অদ্ভুত বৈশিষ্ট্য ধারণ করে। তাদের জগত এবং তাদের অস্তিত্বকে অনেক দূরে বলে মনে হয়েছিল। আত্মা তবুও ব্যাকুলভাবে তাদের দিকে হাত বাড়িয়ে দিয়েছিল: মনে মনে আমি বাসে করে বাড়িতে পৌঁছে গিয়েছি, আমার সামনের এপার্টমেন্টের দরজা খুলেছি, কারো টেলিফোনের উত্তর দিয়েছি, বৈদ্যুতিক আলোর চুইস চালু করেছি। আমাদের ভাবনা সমূহ এতই পুঙ্খানুপুঙ্খ কেন্দ্রিক ছিল যে এসব স্মৃতি সহজেই কাউকে চোখের জলে ভাসিয়ে দিত।

একজন কয়েদির আভ্যন্তরীণ জীবন (inner life) আরও আবেগপ্রবণ হয়ে উঠার প্রবণতা দেখা দিলে সে অতীতের তুলনায় বেশি শিল্প আর প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের অভিজ্ঞতাও লাভ করতে থাকে। শিল্প আর প্রকৃতির সৌন্দর্যর প্রভাবে সে অনেক সময় তার ভয়ানক চারপাশের কথাও ভুলে যেতো। অশউইৎয শিবির থেকে বাভারিয়ান শিবিরে যাওয়ার সময় কয়েদি বহন করা গাড়ির লোহা ঢাকা জানালার ভেতর দিয়ে অস্ট্রিয়ার সালযবুর্গ শহরের সূর্যাস্তের সময় আলোকিত পর্বতচূড়া দেখে আমাদের চেহারার যা অবস্থা হয়েছিল তা কেউ দেখলে বলতে পারবে না যে জীবন আর স্বাধীনতার সকল আশা ছেড়ে দেওয়া মানুষগুলোর চেহারা। আশা ছেড়ে দেওয়া সত্ত্বেও বা আশা ছেড়ে দেওয়ার কারণেই, আমরা প্রকৃতির সৌন্দর্য দেখে মুগ্ধ হয়েছিলাম, যার কথা আমাদের দীর্ঘদিন মনে থাকে।

শিবিরেও কোনো ব্যক্তি বাভারিয়ান বনের সু-উচ্চ বৃক্ষের ফাঁক দিয়ে সমুজ্জ্বল ডুবন্ত সূর্যের মনোরম দৃশ্যের প্রতি তার পাশে কর্ম ব্যস্ত সহকর্মীর মনোযোগ আকর্ষণ করতে পারে। জার্মান শিল্পী ডিউরের বিখ্যাত জলরঙের ছবিতে যেমন দেখা যায়। বাভারিয়ানের সেই বনের ভেতরে আমরা বিশালাকার গোপন অস্ত্র কারখানাটি নির্মাণ করেছিলাম। প্রচুর ক্লান্ত হয়ে এক সন্ধ্যায় আমরা যখন ছাউনির মেঝেতে স্যুপের বাটি হাতে বিশ্রাম নিচ্ছিলাম, তখন হঠাৎ এক কয়েদি দৌড়ে এসে আমাদের সমাবেশ মাঠে অপরূপ সূর্যাস্ত দেখার আহ্বান করে। বাইরে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আমরা দেখলাম পশ্চিম দিকে অশুভ মেঘ ভেসে বেড়াচ্ছে আর মনে হলো সমস্ত আকাশ চির-পরিবর্তনশীল আকৃতি ধারণ করেছে এবং ইস্পাত নীল থেকে রক্ত-লাল রঙে সজীব হয়ে আছে। মাটির তৈরি নির্জন ধূসর রঙের ছাউনিগুলি এক তীক্ষ্ণ বৈপরীত্য স্থাপন করছিল তখন। কাদামাখা ভূপৃষ্ঠের ডোবাগুলিতে প্রদীপ্ত আকাশ প্রতিফলিত হয়েছিল। তারপর, কয়েক মিনিটের মুগ্ধ করা নীরবতার পর এক কয়েদি আরেক কয়েদিকে বলে, “জগত কতোটা সুন্দর হতে পারে”!

অন্য এক সময় আমরা পরিখার ভেতরে কাজে ব্যস্ত ছিলাম। আমাদের চারপাশে তখনও ধূসর ভোর; উপরের আকাশও ছিল ধূসর; ভোরের ম্লান আলোয় তুষারও ছিল ধূসর রঙে ঢাকা। যে পুরনো ছেঁড়া পোশাকে আমার সহ-বন্দীরা আবৃত ছিল তাও ছিল ধূসর রঙ্গের, আর ধূসর ছিল তাদের মুখমণ্ডলও। নিবৃতে আমি পুনরায় আমার স্ত্রীর সাথে আলোচনা করছিলাম। অথবা হতে পারে তখন আমি আমার যন্ত্রনাভোগ ও ধীরে ধীরে মৃত্যুর দিকে ধাবিত হওয়ার পেছনে কারণ খুঁজে পাওয়ার চেষ্টা করছিলাম। আমি আমার আত্মাকে আবৃত করে রাখা অন্ধকারকে বিদীর্ণ করে আসন্ন মৃত্যুকে নিয়ে হতাশার বিরুদ্ধে এক বিদ্রোহী প্রতিবাদ অনুভব করি। আমি অনুভব করলাম এই বিদ্রোহী প্রতিবাদ যেন সেই নিরাশ, অর্থহীন জগতের সবখানে ছড়িয়ে পড়ছে। আর কোথাও কোথাও থেকে আমি বিজয়ী “Yes” শুনতে পায়। তা যেন বেঁচে থাকার পেছনে জীবনের চূড়ান্ত লক্ষ্য সম্পর্কে আমার প্রশ্নের উত্তর। ঠিক সেই মুহূর্তে দূরের এক খামারবাড়িতে প্রদীপ জ্বলে উঠে। তা দেখে মনে হয়েছিল যেন তা একে রাখা এক চিত্রকমের্র মতো বাভারিয়ায় অগ্রসরমান ভোরের দুর্বিষহ ধূসরতার মাঝে দিগন্তে দাঁড়িয়ে রয়েছে। “Et lux in tenebris lucet” আর অন্ধকারে আলো জ্বলল। বরফে ঢাকা মাটিতে কোদাল কোপাতে কোপাতে আমি কয়েক ঘণ্টা সেখানে দাঁড়িয়ে থেকেছিলাম। আমাকে অপমান করে এক প্রহরী আমার পাশ দিয়ে চলে গেলো। আর আমি পুনরায় আমার প্রিয়তমার সাথে ভাব-বিনিময় শুরু করে দেই। আমি আরও বেশি তার উপস্থিতি অনুভব করি, মনে হচ্ছিল সে যেন আমার সাথেই রয়েছে। আমি অনুভব করলাম আমি যেন তাকে স্পর্শ করতে পারছিলাম। পারছিলাম আমার বাহু প্রসারিত করে তাকে জড়িয়ে ধরতে। সে অনুভূতি ছিল খুবই শক্তিশালী: আমার প্রিয়তমা সেখানে উপস্থিত ছিল। তারপর ঠিক সেই মুহূর্তে একটি পাখি নীরবে উড়ে এসে আমার সামনে, পরিখা থেকে কুড়ে বের করে আনা কাদার স্তূপে বসলো, আর স্থিরভাবে আমার দিকে তাকিয়ে রইলো।

আগেও আমি শিল্প সম্পর্কে কিছু কথা উল্লেখ করেছিলাম। বন্দী শিবিরে কি আসলে শিল্প বলতে কিছু ছিল? তা বরং কে কোন জিনিসকে শিল্প হিসেবে ব্যাখ্যা দেবে তার উপর নির্ভর করে। যুগ যুগ ধরে গান গেয়ে বা নেচে বিনোদনের মাধ্যম হিসেবে ক্যাবারেই (cabaret) ব্যবহার করা হয়ে আসছে। ক্ষনস্থায়ীভাবে একটি ছাউনি পরিষ্কার করে কয়েকটি কাটের বেঞ্চ একত্রিত করে বা পেরেক দিয়ে একসাথে করে একটি অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছিল। যে সব ক্যাপু ও শ্রমিকদের দূরবর্তী কোনো জায়গায় মার্চ করার উদ্দেশ্যে শিবির ত্যাগ করতে হয়নি এমন পদাতিক লোকজন সে সন্ধ্যায় মোটামুটিভাবে শিবিরের সেই অনুষ্ঠানে জড়ো হয়েছিল। তারা সবাই শিবির জীবনের যন্ত্রণা ভুলতে সেখানে কিছুটা বিনোদন বা সম্ভবত একটু কেঁদে কষ্ট লাগব করতে এসেছিলো। সঙ্গীত, কবিতা, কৌতুক, শিবির জীবনকে কেন্দ্রকরে রসিকতায় ভরপুর ছিল জমায়েতটি। সবকিছুই আমাদের কষ্ট লাগবে সাহায্য করার কথা ছিল, আর তাই হয়েছিল। মিলন-মেলাটি এতই কার্যকর ছিল যে কয়েকজন সাধারণ কয়েদি ক্লান্ত থাকা সত্ত্বেও বারের ক্যাবারেই (cabaret) নাচ-গান দেখতে চলে গিয়েছিল, যদিও তাতে তাদের জন্য বরাদ্দকৃত দৈনিক খাবারের অংশটি হারাতে হয়েছিল।

মধ্যাহ্নভোজনের আধা ঘণ্টা বিরতির সময় আমাদের কাজের স্থানে হাতা দিয়ে তরল স্যুপ বিতরণ করা সময় আমাদেরকে একটি অসমাপ্ত ইঞ্জিন-কক্ষে জমায়েত হওয়ার অনুমতি দেওয়া হতো। ঢুকার সময়ে সবাই বাটিতে এক হাতা-পূর্ণ তরল স্যুপ নিয়ে আসতো। লোভনীয় ভঙ্গিতে আমরা যখন স্যুপে চুমুক দিতাম, তখন কোনো একজন বন্দী টবের উপর উঠে ইতালীয় অপেরা সঙ্গীত গাইত। আমরা তার সঙ্গীত উপভোগ করতাম। আর তার জন্য নিশ্চিত করা হতো দ্বিগুণ পরিমাণের স্যুপ, তাও আবার সোজা তলা থেকে—তার মানে সাথে মটরও।

কেবল বিনোদনের জন্যই শিবিরে কাউকে পুরস্কার দেওয়া হতো তা নয়, বরং হাততালি বা সাধুবাদের জন্যও কখনও কনও পুরস্কার মিলত। উদাহরণ সরূপ আমি শিবিরের অনেক কারণে “খুনি ক্যাপো” হিসেবে পরিচিত সবচেয়ে ভয়ানক ক্যাপুর কাছ থেকে সুরক্ষা পেতাম। ভালো যে তার সুরক্ষা আমার কখনো দরকার হয়নি! আর এভাবেই তার সাথে আমার পরিচয় ঘটে: এক সন্ধ্যায় পুনরায় যে কক্ষে মৃত ব্যক্তির আত্মার সাথে যোগাযোগের প্রার্থনা অনুষ্ঠান হয়েছিল সেখানে নিমন্ত্রণ পেয়ে মহা সম্মানিত হয়েছিলাম। সেখানে ছিল সেই প্রধান চিকিৎসকের কাছের বন্ধুরা। আর আবারও বেআইনিভাবে সেখানে উপস্থিত ছিলেন স্বাস্থ্য-সুরক্ষা দলের ওয়ারান্ট অফিসারটি। ঘটনাক্রমে খুনি ক্যাপোটি রুমে ঢুকলেই কেউ একজন তাকে তার একটি কবিতা আবৃত্তি করতে আহ্বান করেন। তার সে কবিতাটি এক সময় শিবিরে বিখ্যাত (বা কুখ্যাত) হয়ে উঠেছিল। তাকে আর দ্বিতীয়বার অনুরোধ করতে হয়নি এবং শীঘ্রই সে ডায়রির মতো কিছু একটা বের করে তা থেকে তার শিল্পের নমুনা সমূহ পড়তে আরম্ভ করেন। আমি তার একটি প্রেমের কবিতা শুনার পর হাসি আটকে রাখার জন্য আমি ঠোঁট কামড়ে ধরে রেখেছিলাম। এই হাসি চেপে ধরে রাখাটা সম্ভবত আমার জীবন বাঁচিয়েছিল। আমি যেহেতু করতালির বিষয়েও ছিলাম উদার। তাই এর আগে আমাকে এক দিনের জন্য তার কাজের দলে আমাকে নিযুক্ত করা হলে সা তার সাথে আমি তর্কাতর্কি করলেও কবিতা পাঠের সময় তার জন্যে প্রচুর হাততালি দেওয়াটা আমাকে বাঁচিয়েছিল। যাইহোক, সহায়ক দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করলে খুনি ক্যাপোর সাথে পরিচিত হওয়াটা ছিল দরকারি বিষয়। তাই যতোটা সম্ভব শক্তভাবে আমি তার জন্যে হাততালি দিলাম।

নিঃসন্দেহে, সাধারণভাবে বলতে গেলে শিবিরের মধ্যে যে কোনো শিল্পের চর্চা ছিল কিছুটা হাস্যকর। আমি বলব যে, শিল্পের সাথে সম্পৃক্ত যে কোনো কিছু থেকে তৈরি করা প্রকৃত ধারণা শুধুমাত্র নিঃসঙ্গ শিবির জীবনের আচরণ ও পরিবেশের মাঝে ভৌতিক বৈপরীত্য থেকে আবির্ভূত। অশউইৎয শিবিরে আমার দ্বিতীয় রাতে গানের আওয়াজে কিভাবে আমাকে আমার ক্লান্তির ঘুম থেকে জেগে উঠতে হয়েছিল তা কখনও ভুলতে পারবো না। ছাউনির সিনিয়র ওয়ার্ডেন বা প্ররক্ষক সে সময় তার কক্ষে কোনো একটা কিছু উৎযাপন করছিলেন। তার কক্ষটি ছিল ছিল ছাউনির প্রবেশ দ্বারের পাশে। আধ মাতাল শব্দে কিছু অতি প্রচলিত গানের সুর বেজে চলছিল। হঠাৎ তা নীরব যায়। তারপর রাতের গভীরতায় ভায়োলিনে এক নিদারুণ হতাশার সুর বাজতে শুরু করে। এ যেন এক স্বাভাবিক বাজনার দ্বারা নষ্ট না হওয়া অস্বাভাবিক সুর। ভায়োলিনটি যেন কেঁদেই চলছে। আর তার সাথে কেঁদে চলছিল আমার একটি অংশও। কারণ সে একই দিনটি ছিল কেউ একজনের চব্বিশতম জন্মদিন। আর সে ‘কেউ একজন’ ব্যক্তিটি অশউইৎয শিবিরের অন্য কোনো অংশে শুয়ে রয়েছে, সম্ভবত কেবল কয়েক শত বা কয়েক হাজার গজ দুরে কোথাও। তবুও যেন নাগালের বাইরে। আর সে ‘কেউ একজন’ ব্যক্তিটি ছিল আমার প্রিয়তমা স্ত্রী।

বন্দী শিবিরেও যে শিল্পের কোনও নমুনা ছিল তা আবিষ্কার করারটা একজন বহিরাগত ব্যক্তির পক্ষে যথেষ্ট অবাক করার বিষয় হতে পারে। কিন্তু সে এটা শুনে আরও বিস্মিত হতে পারে যে, একজন মানুষ সেখানে রসিকতা-বোধেরও সন্ধান পেতে পারে। তা অবশ্য রসিকতা-বোধের এক দুর্বল উপস্থিতি বা, হতে পারে কেবল কয়েক সেকেন্ড বা কয়েক মিনিটের জন্য। আত্ম-রক্ষা বা আত্ম-সংরক্ষণ সংগ্রামে রসিকতা ছিল আত্মা বা সত্ত্বার আরেকটি হাতিয়ার। এটি সবারই জানা আছে যে, যে কোনও কিছুর চেয়ে রসিকতা মানব চরিত্রে উদাসীনতা নিয়ে আসে। এবং রসিকতা মানুষকে কয়েক সেকেন্ডের জন্য হলেও যেকোনো পরিস্থিতির উর্ব্ধে উঠার সামর্থ্য দান করে। নির্মাণ স্থানে আমার পাশাপাশি কাজ করা আমার এক বন্ধুকে আমি কার্যকরীভাবে রসিকতা-বোধ বৃদ্ধি প্রশিক্ষণ দিয়েছিলাম। আমি তার কাছে একদিন আমাদের মুক্তির পরে ঘটতে পারে এমন কিছু ঘটনাকে কেন্দ্র করে চিত্তাকর্ষক কিছু গল্প উদ্ভাবন করতে একে অপরের কাছে প্রতিজ্ঞা করার প্রস্তাব করেছিলাম। তিনি ছিলেন একজন সার্জন ও বিশাল এক হাসপাতালের স্টাফদের সহযোগী হিসেবে কাজ করছিলেন। তাই শিবির থেকে বের ছাড়া পাওয়ার পর আগের পেশায় ফিরে গেলে শিবির জীবনের অভ্যাস বদলানো কতোটা অসম্ভব হতে পারে তা বর্ণনা করে আমি তাকে হাসাতে চেষ্টা করেছিলাম। কর্মকর্তারা কাজের তদন্ত করতে আসার সময় নির্মাণ স্থানে আমাদের কাজের মাঝি বা দলনেতা আমাদের Action! Action! চিৎকার করে দ্রুত কাজ করার তাড়না দিতো। তা নিয়ে একদিন আমি আমার বন্ধুকে বলেছিলাম, একদিন তুমি হাসপাতালের অস্ত্রোপচার কক্ষে ফিরে গিয়ে বড় কোনো পেটের অপারেশন করবে। আর হঠাৎ এক বৃদ্ধ লোক দৌড়ে কক্ষে ডুকে গিয়ে Action! Action! চিৎকার করে সিনিয়র সার্জনের আগমনের বিষয়ে সতর্ক করে দেবে।

মাঝে মাঝে অন্যান্য লোকেরাও তাদের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে চিত্তাকর্ষক স্বপ্নের উদ্ভাবন করতো। এই যেমন ধরুন, তারা ভবিষ্যদ্বাণী করে বলতো যে, ভবিষ্যতে রাতের খাবার খাওয়ার ব্যস্ততায় স্যুপ বণ্টনের সময় তারা হয়তো তাদের নিজেদের পরিবেশ ভুলে যাবে। আর দাওয়াত করা গৃহকত্রীর কাছে একহাতা স্যুপের জন্য অনুনয় করে বলবে “একটু তলা থেকে দেন”।

রসিকা-বোধ বৃদ্ধির প্রচেষ্টা ও পরিস্থিতিকে রসিকতার আলোকে দেখা হলো জীবন-যাপনের শৈল্পিকতা (the art of living) উন্নয়নের সময় অর্জিত এক কৌশল। তথাপি, বন্দী শিবিরে বাস করেও জীবন-যাপনের শিল্প অনুশীলন সম্ভব ছিল, যদিও যন্ত্রণা আর কষ্টভোগ ছিল সর্বত্র বিরাজমান। একটি উদাহরণের মাধ্যমে তা বর্ণনা করা যায়: একজন মানুষের যন্ত্রণা গ্যাসীয় বৈশিষ্ট্যের মতো। যদি নির্দিষ্ট পরিমাণের গ্যাস কোনো খালি চেম্বারে চালিত করা হয়, তাহলে তা সম্পূর্ণরূপে ও সমান্তরালভাবে চেম্বারটিকে পূর্ণ করে ফেলবে, চেম্বারটি আকারে কতো বড়ো তা কোনো বিষয় না। একইভাবে, যন্ত্রণা মানব-আত্মা এবং সচেতন মনকে সম্পূর্ণরূপে পূর্ণ করে ফেলে, আর সে যন্ত্রণা কতো বড় বা কতো ছোট তা কোনো বিষয় নয়। অতএব, মানব যন্ত্রণার ‘আকার’ সম্পূর্ণরূপে আপেক্ষিক।

এটাও সত্যি যে, খুব তুচ্ছ কোনো জিনিস আমাদের জীবনে মহা আনন্দের কারণ হতে পারে। অশউইৎয থেকে ডাক্সাওর সাথে সংযুক্ত আরেক শিবিরে আমাদের যাত্রার সময় যা হয়েছিল তার কথা বলা যাক, উদাহরণ সরূপ। আমাদের সবার ভয় করছিল যে আমাদের নিয়ে পরিবহনটি হয়তো মউথওসেন শিবিরের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। ডানিউব নদীর সেতুর কাছাকাছি আসতেই আমরা আরও উত্তেজিত হয়ে পড়িলাম। অভিজ্ঞ সফর সঙ্গীদের বর্ণনানুযায়ী মউথওসেন পৌছার জন্য পরিবহনটি সেতুটি পার হয়ে যাওয়ার কথা। যারা এমন কিছু আগে দেখেনি তারা কয়েদিদের বহন করে নিয়ে যাওয়া পরিবহনের ভেতরে প্রদর্শিত এমন আনন্দের নাচ সম্ভবত কল্পনাও করতে পারবেনা। যখন তারা দেখল যে পরিবহনটি সেতুর উপর দিয়ে না গিয়ে বরং সোজা ডাক্সাওর অভিমুখে এগিয়ে চলছে তখন তারা আনন্দোল্লাস করতে থাকে।

দুইদিন তিন রাতের যাত্রা শেষে যখন আমরা ডাক্সাও শিবিরে পৌঁছানোর পর কি ঘটেছিল? পরিবহনের ভেতরে এক সাথে মেঝেতে গুটিসুটি করে বসার জন্য সবার জন্য পর্যাপ্ত জায়গা ছিল না। আমাদের অনেককেই পুরো পথ দাঁড়িয়ে থাকতে হয়েছিল। আবার কয়েকজন পালা করে মানুষের প্রস্রাবে সিক্ত সামান্য খড়ের উপর উবু হয়ে বসে আসতে হয়েছিল। শিবিরে পৌঁছানোর পরপরই সবচেয়ে যে গুরুত্বপূর্ণ বার্তাটি পুরনো কয়েদিরা আমাদের দিয়েছিল তা হলো আয়তনে ছোট (২৫,০০ জনসংখ্যা) শিবিরটিতে কোনো ‘চুল্লি’, শব-চুল্লি কিম্বা গ্যাসও নাই! তার মানে ‘মুসলেম’ হিসেবে আখ্যা পাওয়া কোনো ব্যক্তিকে সোজাসুজি গ্যাস-চেম্বারে নিয়ে যাওয়া হবে না, কিন্তু তাকে তথাকথিত ‘অসুস্থ কনভয়’ এর আয়োজন করে অশউইৎয শিবিরে ফেরত পাঠানো পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। এই আনন্দদায়ক চমক আমাদের সবার মেজাজ ভালো করে দিয়েছিল। অশউইৎয শিবিরের সিনিয়র ওয়ার্ডেনদের প্রত্যাশা সত্যি হলো: যত দ্রুত সম্ভব আমরা অশউইৎয শিবির থেকে আলাদা এমন এক শিবিরে এসে পড়লাম যেখানে কোনো ‘চিমনী’ই নাই। আমরা হাসলাম এবং পরবর্তী মুহূর্তে আমাদেরকে যার মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছিল তা সত্ত্বেও আমরা রসিকতা করছিলাম।

**********

আমাদের নতুন আগতদের গণনা করে বোঝা গেলো যে আমাদের একজনকে পাওয়া যাচ্ছিল না। তাই শিবিরের বাইরে বৃষ্টি আর ঠাণ্ডা বাতাসে হারিয়ে যাওয়া সে ব্যক্তিকে ফিরিয়ে না পাওয়া পর্যন্ত আমাদের অপেক্ষা করতে হয়েছিল। অবশেষে তাকে এক ছাউনিতে আবিষ্কার করা হলো, যেখানে সে ক্লান্ত হয়ে সেখানে ঘুমিয়ে পড়েছিল। তারপর নাম ডাকা পর্ব হয়ে উঠে এক শাস্তি দেওয়ার দৃশ্য। সারা রাত পার করে পরের দিনের পড়ন্ত সকাল পর্যন্ত দীর্ঘ যাত্রার পর হিমায়িত আর সিক্ত অবস্থায় আমাদেরকে বাইরে দাঁড়িয়ে থাকতে হলো। আর তারপরও আমরা ছিলাম খুবই আনন্দিত! এই শিবিরে কোনো চিমনী নাই আর অশউইৎয ছিল অনেক দুরে।

আরেক সময় আমরা দেখি একদল আসামী আমাদের কাজের স্থান পার হয়ে চলে যাচ্ছে। কতো স্পষ্টভাবেই না সমস্ত যন্ত্রণার আপেক্ষিকতা তখন আমাদের সামনে উপস্থিত হয়েছিল! সেসব বন্দীদের সু-শৃঙ্খল, নিরাপদ আর সুখী জীবন দেখে আমরা হিংসে করেছিলাম। নিশ্চয় তাদের প্রতিদিন স্নান করার সুযোগ আছে, বিষণ্ণ-ভাবে আমরা ভাবতাম। নিশ্চয় তাদের জন্য রয়েছে দাঁত-মাজার ব্রাশ, কাপড় ধোয়ার ব্রাশ, প্রত্যেকের জন্য আলাদা আলাদা শোয়ার জন্য মেট্রেস। তারা হয়তো তাদের আত্মীয়-স্বজনদের খবরা-খবর নিয়ে প্রতি মাসে চিঠি-পত্র দেওয়া-নেওয়া করে। তারা অন্তত তাদের আত্মীয়-স্বজন বেঁচে আছে না মরে গেছে তার খবর জানে। যার সব আমরা অনেক আগেই হারিয়ে ফেলেছিলাম।

আহা, আমাদের কেউ যখন কোনো কারখানায় প্রবেশের সুযোগ পেত এবং ছায়া ঘেরা কক্ষে কাজ করতো তখন আমরা তাকে কতইনা ঈর্ষা করেছি! এরকম জীবন-রক্ষামুলক সৌভাগ্য পাওয়ার প্রত্যাশা ছিল সবার। তুলনামূলক সৌভাগ্যের স্তর আরও বহুদূর বিস্তার লাভ করেছিল। এমন কি শিবিরের বাইরের সেই বিশেষ সৈন্য দলের মাঝেও (যার একটির আমিও একজন সদস্য ছিলাম) এমন কয়েকটি ইউনিট ছিল যাদের অন্যদের চেয়ে খারাপ বলে বিবেচনা করা হতো।  প্রতিদিন বারো ঘণ্টা ধরে ছোট কোনো মাঠের রেলপথের টব খালি করে গভীর কাদা মাটির খাড়া ঢালুতে হেটে যাওয়ার প্রয়োজন হতো না এমন ব্যক্তিকে যে কেউ হিংসে করতো। এ কাজে অধিকাংশ দুর্ঘটনা ঘটতো, এবং এসব দুর্ঘটনা ছিল প্রায়শই প্রাণঘাতী।

অন্যান্য কাজের আসরে মাঝিরা শাস্তি প্রদানের ক্ষেত্রে আপাতদৃষ্টিতে স্থানীয় ঐতিহ্য বজায় রেখেছিল, যা আমাদেরকে এরকম মাঝির আদেশের অধীনে না থাকার বা অল্প সময়ের জন্য থাকার তুলনামূলক সৌভাগ্যের ব্যাপারে আমাদের কথা বলতে হয়েছিল। একদা, দুর্ভাগ্যক্রমে আমি এমন এক আসরে অন্তর্ভুক্ত হয়ে যায়। দুই ঘণ্টা পর যদি জরুরী সতর্কীকরণ এলার্মটি আমাদের ব্যাঘাত ঘটিয়ে শ্রমিকদের পরবর্তীতে পুনঃ সংগঠিত করার প্রয়োজনীয়তা সৃষ্টি না করতো, তাহলে আমার মনে হয় যারা ইতিমধ্যে কাজ করতে করতে মারা গেছে বা ক্লান্ত হয়ে মৃত্যু পদযাত্রী হয়ে পড়েছে এমন লোকদের বহন করা কোনো এক স্লেজগাড়িতে করে আমাকে শিবিরে ফিরে যেতে হতো। এহেন পরিস্থিতিতে সাইরেনটি যে কতো বড় স্বস্তির কারণ হতে পারে তা কেউ কল্পনাও করতে পারবেনা। এমনকি কোনো রাউন্ড শেষ হওয়ার ঘণ্টা শুনে শেষ মুহূর্তে নকআউট হওয়ার বিপদ থেকে রক্ষা পাওয়া কোনো বক্সারও তা বুঝতে পারবে না।

সবচেয়ে ছোট কোনো দয়া পাওয়ার জন্যও আমরা কৃতজ্ঞ ছিলাম। ঘুমোতে যাওয়ার আগ মুহূর্তে উকুন-মুক্ত হওয়ার সময়টির জন্যও আমরা আনন্দিত ছিলাম। যদিও কাজ হিসেবে তা কোনো আনন্দদায়ক কাজ ছিল না। কারণ তার জন্য আমাদেরকে উলঙ্গ হয়ে উত্তাপ-হীন ছাউনিতে দাঁড়িয়ে থাকতে হতো। তার উপর যেখানে ছিল সিলিং থেকে ঝুলতে থাকা পানির ফোঁটা থেকে তৈরি ধারালো বরফকণা। তবুও আমরা কৃতজ্ঞ ছিলাম, কারণ এসময়ে জরুরী সতর্কীকরণ এলার্মটি বেজে উঠত না আর বাতিও নিবিয়ে দেওয়া হতো না। কাজটি ঠিকমতো করতে না পারলে আমাদের অর্ধেক রাত পর্যন্ত জাগিয়ে রাখা হতো।

*******

শিবির জীবনের ছোট-খাট আনন্দগুলি “যন্ত্রণা থেকে মুক্তি” পাওয়ার জন্য এক ধরনের নেতিবাচক সুখের (negative happiness) সরবরাহ করেছিল। জার্মান দার্শনিক শওপেনহাউওয়ার বলেছিলেন যে নেতিবাচক সুখ আমাদের “যন্ত্রণা থেকে মুক্তি” থেকে মুক্তি দেয় —তাও আবার কেবল কোনো আপেক্ষিক উপায়ে। প্রকৃত ইতিবাচক আনন্দ (positive pleasures), হোক তা ক্ষুদ্রতম, ছিল খুবই কম। আমার মনে পড়ে একদিন আমি আমার আনন্দের হিসেব কষছিলাম। তাতে আমি বুঝতে পারি যে বিগত বেশ কয়েক সপ্তাহে আমার শুধু দুইটি আনন্দময় মুহূর্ত ছিল। একটি ছিল কাজ থেকে ফেরার সময় দীর্ঘ অপেক্ষার পর আমাকে যখন রান্নাঘরে প্রবেশের অনুমতি দেত্তয়া হয়েছিল। আমাকে কারা পাচক মিঃ এফ’র সামনে দাঁড়ানো সারিতে নিযুক্ত করা হয়েছিল। তিনি বিশাল এক কড়াইয়ের পেঁছনে দাঁড়িয়ে তাড়াতাড়ি করে লাইনে দাঁড়িয়ে যাওয়া কয়েদিদের তুলে ধরা বাটিতে হাতা দিয়ে স্যুপ তুলে দিচ্ছিলেন। তিনিই ছিলেন একমাত্র রাঁধুনি যে বাটিতে স্যুপ দেওয়ার সময় বাটি ধরে থাকা লোকদের দিকে তাকাতেন না। তিনিই ছিলেন একমাত্র রাঁধুনি যে গ্রহীতা নির্বিশেষে সবাইকে সমানভাবে স্যুপ বরাদ্দ করতেন। আর যিনি নিজের বন্ধু বা নিজের দেশের লোকদের খাতির করতে গিয়ে বেছে বেছে আলু দিয়ে অন্যদের বাটিতে সেঁকে সেকে কেবল পাতলা স্যুপ দেওয়ার মানুষ তিনি ছিলেন না।

যারা তাদের নিজের লোকদের অন্যদের উপরে স্থান দেয় এমন বন্দীদের বিচার করা আমার কাজ নয়। আগে-পরে বাঁচা-মরার প্রশ্ন হয়ে দাঁড়ায় এমন পরিস্থিতিতে তার বন্ধুদের প্রতি দয়া দেখানো এমন এক মানুষের প্রতি কে পাথর ছুড়তে পারে? কারো তা বিচার করা উচিৎ নয়, যদি না সে পরম সততার সাথে এমন পরিস্থিতিতে সে নিজেও একই কাজটি করতেন কিনা তার উত্তর দিতে পারে।

*****

শিবির থেকে মুক্তি পাওয়ার পর আমার স্বাভাবিক জীবন শুরু করার অনেক দীর্ঘ সময় পর কেউ একজন আমাকে এক সাপ্তাহিক ম্যাগাজিনে শিবিরের বাঙ্কারে জনাকীর্ণ অবস্থায় শুয়ে এক পরিদর্শকের দিকে নিষ্প্রাণ ভঙ্গিতে কয়েদিদের তাকিয়ে থাকার ছবি দেখায়। “ভয়ানক না?, ভয়ঙ্কর বিস্ফোরিত চেহারা সব—এর সবকিছুই ভয়ানক”, লোকটি মন্তব্য করেন।

“কেনো”? আমি জিজ্ঞেস করলাম, কারণ আমি আসলেই তার কথা বুঝতে পারিনি। সেই মুহূর্তে ছবিটি আমি পুনরায় দেখলাম: ভোর ৫ টায় বাইরে তখনও ঘোর অন্ধকার। আমি তখন মাটির তৈরি এক ছাউনির তক্তায় শুয়েছিলাম যেখানে আমাদের সত্তর-জনকে ‘দেখাশুনা করা’ হচ্ছিল। আমরা অসুস্থ ছিলাম বলে আমাদের কাজের উদ্দেশ্যে ক্যাম্প ছাড়তে হয়নি, যেতে হয়নি প্যারেডেও। অসুস্থ ছিলাম বলে ছাউনির ছোট কোণে আমরা সারাদিন শুয়ে থাকতে, ঝিমোতে ও প্রতিদিনের বরাদ্দ রুটির এবং দৈনিক সুপ সহায়তা পাওয়ার অপেক্ষা করতে পারতাম। রোগীদের জন্য এই রুটি ক্রমে ছোট হয়ে আসে আর আমাদের বেলায়  স্যুপ হয়ে উঠে আরও পাতলা হয়ে ও পরিমাণে কম। সবকিছু পরও আমরা কতই সন্তুষ্ট আর না খুশি ছিলাম! এক সময় আমরা অলসতা আর আগ্রহহীনতার দরুন একটি আঙ্গুলও নাড়তে রাজি না হয়ে অপ্রয়োজনীয়ভাবে উঞ্চতা হারানো রোধ করতে আমরা যখন একে অন্যের কাছাকাছি ঘেঁসে গুটিসুটি হয়ে বসে থেকেছিলাম। তখন আমরা হঠাৎ উন্মুক্ত স্থান থেকে ভেসে আসা কর্কশ বাঁশির শব্দ এবং মানুষের চিৎকার শুনতে পেয়েছিলাম। সেখানে রাত্রিকালীন পালা ফিরে এসেছে আর নাম ডাকার জন্য সমবেত হচ্ছিল। ঠিক তখনই দরজাটা সজোরে খুলে গিয়ে তুষার-ঝড় বয়ে যায় আমাদের ছাউনিতে। একজন ক্লান্ত সহকর্মী বরফে ঢেকে যাওয়ার কারণে হোঁচট খেয়ে পড়ে গিয়ে ভিতরে কয়েক মিনিটের জন্য বসে পড়েছিলেন। কিন্তু সিনিয়র ওয়ার্ডেন তাকে পুনরায় বাইরে নিয়ে যান। লোকজনের উপর পরীক্ষা চলাকালীন ছাউনিতে অপরিচিত কাউকে ঢুকতে দেওয়া ছিল সম্পূর্ণ নিষেধ। আমার সহকর্মীটির জন্য কতই না দুঃখ পেয়েছিলাম। আর সেই মুহূর্তে তার মতো একই পরিস্থিতির শিকার না হয়ে বরং অসুস্থ থেকে রোগীদের কোয়ার্টারে ঝিমাতো পারার কারণে কতই না আনন্দিত ছিলাম! রোগীদের কোয়ার্টারে দুটি দিন কাজ ছাড়া থাকতে পারাটা কতটাই না জীবন-রক্ষাকারী ছিল!

ম্যাগাজিনের ছবিগুলি দেখার পর এসব আমার মানসপটে ফিরে আসে। ব্যাখ্যা করার পর আমার শ্রোতারা বুঝতে পারে কেন ছবিগুলি আমার কাছে ততটা ভয়ানক ছিল না: যাইহোক, ছবিতে দেখানো মানুষগুলি হয়তো তেমনটা অসুখী ছিল না।

রোগীদের কোয়ার্টারে আমার চতুর্থ দিনের দিন প্রধান চিকিৎসক এসে আমাকে রাত্রিকালীন পালা সম্পর্কে বিস্তারিত বললেন আর টাইফাস রোগী সংবলিত অন্য একটি শিবিরে আমাকে মেডিকেল দায়িত্ব পালনের অনুরোধ করা হলো। আমার বন্ধুদের জরুরী উপদেশ আর এবং আমার প্রায় সব সহকর্মী তাদের সেবা দানের পক্ষে নারাজ থাকা সত্ত্বেও আমি স্বেচ্ছা সেবা দিতে সিদ্ধান্ত নিলাম। আমি জানতাম যে কোনো কাজের আসরে আমি অল্প সময়ের মধ্যে মারা যাবো। আমার যদি তাদের সেবায় মৃত্যুও হয় তবুও তা অর্থবহ হবে। আমি ভাবলাম যে নিষ্ক্রিয় হতে হতে অবশেষে অনুৎপাদনশীল শ্রমিক হিসেবে মরে যাওয়ার চেয়ে একজন চিকিৎসক হিসেবে আমার সহকর্মীদের সহায়তা করা হবে নিঃসন্দেহে অর্থবহ।

আমার জন্য তা ছিল এক সাধারণ অঙ্ক, কোনো ত্যাগ বা বিসর্জন নয়। কিন্তু গোপনে, স্বাস্থ্যসুরক্ষা দলের ওয়ারান্ট অফিসারটি আদেশ করলেন যে, যে দুজন চিকিৎসক টাইফাস শিবিরে স্বেচ্ছা সেবা প্রদান করবে তাদের অবশ্যই তাদের রওয়ানা হওয়ার আগ মুহূর্ত পর্যন্ত “সেবা প্রদান” করা হবে। আমাদের দেখতে এতই দুর্বল মনে হচ্ছিল যে তিনি তার হাতের কাছে দু’জন ডাক্তারের পরিবর্তে আরও দু’টি অতিরিক্ত লাশ রয়েছে চিন্তা করে ভয় পেয়েছিলেন।

আমি আগেই উল্লেখ করেছি কিভাবে কারো নিজের বা কাছের বন্ধুর জীবন রক্ষা কাজে সরাসরি সম্পৃক্ত নয় এমন যেকোনো কিছুই মূল্যহীন হয়ে পড়েছিল। বাঁচিয়ে থাকার বা বাঁচিয়ে রাখার উদ্দেশ্যে সবকিছুই বিসর্জন দেওয়া হয়েছিল। এই জায়গায় একজন মানুষের চরিত্র এমনভাবে সম্পৃক্ত হয়ে পড়েছিল যে, সে মানসিক অশান্তিতে ধরাশায়ী হয়ে পড়ে যা তার সমস্ত মূল্যবোধকে হুমকির মুখোমুখি করে সন্দেহের মধ্যে নিক্ষেপ করেছিল। যে জগত মানব জীবনের মূল্যের স্বীকৃতি দেয় না, যে জগত মানুষের ইচ্ছাকে ছিনিয়ে নিয়ে তার শরীরের শেষ সম্বলটুকু পর্যন্ত ব্যবহার হয়ে যাওয়ার পর তাকে ধ্বংশ করে ফেলার এক বস্তুতে পরিণত করেছিল, এমন জগতের প্রভাবে অবশেষে সে তার ব্যক্তিগত অহং মূল্যবোধ হারিয়ে ফেলে। বন্দী শিবিরের লোকটি যদি তার আত্ম-সম্মান রক্ষার্থে এর বিরুদ্ধে শেষ পর্য্ন্ত সংগ্রাম করতে ব্যর্থ হয়, তাহলে আভ্যন্তরীণ স্বাধীনতা আর ব্যক্তিগত মূল্যবোধ সম্বলিত এক মননশীল সত্ত্বা হিসেবে তার অনুভূতি হারিয়ে ফেলতো। সে তখন নিজেকে বিশাল জনগোষ্টির নিছক একটি অংশ হিসেবে ভাবতে শুরু করে দিতো। আর তার অস্তিত্ব এক পশুর জীবনের পর্যায়ে নেমে আসতো। তারপর চিন্তা-চেতনা বা স্ব-ইচ্ছাহীন ভেড়ার পালের ন্যায় মাঝে মাঝে এক সাথে তারপর পৃথকভাবে তাদের তাড়া করে এক স্থান থেকে অন্য স্থানে নিয়ে যাওয়া হতো। ছোট কিন্তু বিপজ্জনক নির্যাতন পদ্ধতি ও ধর্ষকামে অভিজ্ঞ একঝাক শিকারী কুকুর তাদের চারপাশ থেকে লক্ষ্য ঘিরে থাকতো। তারা বিরতীহীনভাবে ভেড়ার পালটিকে চিৎকার করে, লাথি মেরে এবং বেত্রাঘাত করে কখনও সামনের দিকে, কখনও পিছনের দিকে চালিত করতে থাকে। আর ভেড়া হিসেবে আমরা শুধু দুটি ভাবনায় আবিষ্ট থাকতাম—কিভাবে মন্দ কুকুরকে এড়িয়ে চলবো এবং কিভাবে একটু খাবার পাবো।

ভয়ে ভয়ে পালের মাঝখানে ভীড় করা ভেড়ার মতো, আমরা প্রত্যেকেই সব সময় আমাদের পালের কেন্দবিন্দুতে পৌঁছানোর চেষ্টা করেছিলাম। তাতে আমরা আমাদের সারির সামনে-পেছনে ধাবমান প্রহরীদের বেতের আঘাত থেকে নিজেদের বাঁচিয়ে রাখতে পারতাম। আর পালের ঠিক মাঝখানে অবস্থান করার ফলে ঠান্ডা বাতাস থেকে সুরক্ষার বাড়তি এক সুবিধাও ছিল। সুতরাং, নিজের জান বাঁচানোর চেষ্টায় একজন মানুষ আক্ষরিকভাবে ভিড়ের মধ্যে নিজেকে ডুবিয়ে রাখার চেষ্টা করতো। যে কাজটি পালের মধ্যে আপনা-আপনিতেই ঘটে থাকতো। কিন্তু মাঝে মাঝে SS কর্মীদের দৃষ্টি এড়াতে তা ছিল শিবিরের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আত্ম-রক্ষার উপায়। আমাদের পক্ষ থেকে তা ছিল একটি খুবই সচেতন প্রচেষ্টা। আমরা সব সময় SS কর্মীদের দৃষ্টি আকর্ষণ এড়িয়ে চলতে চেষ্টা করেছিলাম।

*******

অবশ্য সম্ভব হলে এবং এমনকি প্রয়োজনে ভিড় থেকে নিজেদের দুরে রাখার সময়ও আমাদের ছিল। একটি বিষয় সবার জানা আছে যে চাপিয়ে দেওয়া কোনো সমাজ-জীবনে সব সময় একজন মানুষ যা করে তার দিকে দৃষ্টিপাত করা হয়। যা একজন মানুষকে অন্তত অল্প সময়ের জন্য হলেও তা থেকে নিস্তার পাওয়ার এক অনিবার্য তাড়নার সৃষ্টি করতে পারে। এরকম পরিস্থিতিতে একজন কয়েদি নিজের সাথে এবং তার ভাবনা নিয়ে একা থাকাকে ব্যাকুলভাবে কামনা করে। সে একটু গোপনীয়তা আর নির্জনতার জন্য আকুল হয়ে উঠে। তথাকথিত একটি “বিশ্রাম শিবির”এ আমার অপসারণের পর একবার প্রায় পাঁচ মিনিটের জন্য একাকী থাকার  দুর্লভ সুযোগ হয়েছিল আমার। মাটির যে ছাউনিটির পেছনে আমি কাজ করেছিলাম ও যাতে প্রায় পঞ্চাশ-জন বিকারগ্রস্ত রোগী ভিড় করছিল সেখানে ক্যাম্পকে ঘেরা কাঁটাতারের জোড়া বেড়ার এক কোনায় একটি কোলাহল-মুক্ত স্থান ছিল। কয়েকটি খুঁটি আর গাছের ঢাল দিয়ে সেখানে একটি তাম্বুর বন্দোবস্ত করা হয়েছিল, যাতে পাঁচ-ছয়জন রোগীকে সেখানে আশ্রয় দেওয়া যায়। ক্যাম্পে প্রতিদিন পাঁচ-ছয়জন মানুষ মারা যেতো। একটি খাদ পানির পাইপের দিকে বয়ে গিয়েছিল। যখনই হাতে কোনো কাজ থাকত না, তখন আমি গিয়ে পানির খাদের কাঠের তৈরি ঢাকনায় উবু হয়ে বসে থাকতাম। আমি কেবল বসে থাকতাম আর প্রস্ফুটিত সবুজ ঢালু আর দুরের কাঁটাতারের বুননে আবৃত বাভারিয়ান ভূপৃষ্ঠের পর্বত সমূহের দিকে তাকিয়ে থাকতাম। তীব্র আকাঙ্ক্ষা নিয়ে আমি স্বপ্ন দেখতাম, আর আমার ভাবনাগুলি উত্তর থেকে উত্তরপূর্ব দিকে, আমার বাড়ির দিকে, ভেসে চলে যেতো। কিন্তু আমি মেঘ ছাড়া কিছুই দেখতে পেতাম না।

আমার পাশে পড়ে থাকা লাশগুলিতে উকুন হামাগুড়ি দিচ্ছিল। তারা আমাকে বিরক্ত করেনি। কেবল পাশ দিয়ে হেটে চলা প্রহরীদের পায়ের শব্দই আমার স্বপ্নভঙ্গ করতে পারতো। অথবা তা হতো রোগীদের কক্ষ থেকে ভেসে আসা ডাক বা হতে পারে আমার ছাউনির জন্য আগত ঔষধ সংগ্রহ করার আহ্বান। ঔষধের মধ্যে থাকতো পঞ্চাশ-জন রোগীর কয়েক দিনের জন্য পাঁচটি বা দশটি এসপ্রিন ট্যাবলেট, যার সরবরাহ সংগ্রহ করার ডাক আমাকে স্বপ্ন থেকে জাগ্রত করেছিল। ঔষধগুলি সংগ্রহ করে রোগীদের শীরা নির্ণয় করে এবং মারাত্মক কোনো অবস্থায় সেবনের জন্য অর্ধেক ট্যাবলেট দেওয়ার পর আমি আমার দায়িত্বের পালা সম্পূর্ণ করেছিলাম। হলে হবে কি, বেপরোয়াভাবে অসুস্থ মানুষেরা কোনো ঔষধ পেত না। কারণ এরকম পরিস্থিতিতে ঔষধে কোনো কাজ হবে না। পাশাপাশি তা যাদের নিয়ে এখনও আশা রয়েছে এমন রোগীদের ঔষধ পাওয়া থেকে বঞ্চিত করবে। হালকাভাবে অসুস্থ রোগীদের জন্য উৎসাহের বাক্য ব্যতীত আমার আর কিছুই ছিল না। এভাবে আমি নিজেকে এক রুগী থেকে অন্য রুগীর কাছে টেনে নিয়ে গিয়েছিলাম, যদিও টাইফাসের আক্রমণে আমি নিজেও ছিলাম দুর্বল আর ক্লান্ত। তারপর পানির খাদের কাঠের ঢাকনার কাছে একাকী স্থানে ফিরে যায়।

ঘটনাক্রমে এই খাদটিই এক সময় তিনজন কয়েদির জীবন বাঁচিয়েছিল। আমাদের মুক্তির কিছু দিন আগে ডাক্সাও যাওয়ার জন্য এক গণ-পরিবহনের আয়োজন করা হচ্ছিল। আর এই তিনজন কয়েদি বুদ্ধিমত্তার সাথে যাত্রাটি এড়িয়ে যাওয়া চেষ্টা করেছিল। তারা পানির খাদ বেয়ে উঠে সেখানে প্রহরীদের কাছ থেকে লুকিয়ে থেকেছিল। আমি ঢাকনার উপর শান্তভাবে বসে নিষ্পাপ চেহারা করে কাঁটাতারের দিকে পাথর ছুড়ে বাচ্চাদের মতো খেলা করছিলাম। আমাকে দেখতে পেয়ে প্রহরীটি এক মুহূর্ত ইতস্তত বোধ করল, কিন্তু তারপর পাশ কেটে চলে গেলো। শীঘ্রই আমি খাদের নিচে সে তিনজন মানুষের চরম বিপদটি কেটে যাওয়া বুঝতে পারি।

শিবিরে মানুষের জীবনের উপর কতো তুচ্ছ মূল্য নির্ধারণ করা হতো তা অনুধাবন করা একজন বহিরাগত মানুষের পক্ষে খুবই কষ্টকর। শিবিরে কয়েদিদের অন্তরকে কঠোর করে তুলা হয়েছিল। কিন্তু  যখন অসুস্থ লোকদের জন্য কোনো বহর বা কনভয়ের আয়োজন করা হতো তখন মানব জীবনের এই তাচ্ছিল্যতা সম্পর্কে তারা আরও সচেতন হয়ে উঠতো। অসুস্থদের ক্ষীণকায় দেহগুলি কয়েদিদের দিয়ে মাইলের পর মাইল তুষার ঝড়ের মধ্যে নিকটবর্তী শিবিরে টেনে আনা দুই চাকার টানাগাড়িতে নিক্ষেপ করা হতো। টানাগাড়ি বা কার্ট ত্যাগের আগে যদি কোনো অসুস্থ লোক মারা যেত, অসুস্থ মানুষের সংখ্যার তালিকা ঠিক রাখার জন্য তবুও তাকে সেখানে নিক্ষেপ করা হতো! কারণ এই তালিকাই ছিল গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, মানুষ নয়। একজন মানুষকে কেবল তার কয়েদি নাম্বারের জন্যই মূল্যায়ন করা হতো। একজন ব্যক্তি আক্ষরিক অর্থে একটি সংখ্যায় পরিণত হয়েছিল। মৃত বা জীবিত তা গুরুত্বপূর্ণ ছিল না। কোনো নাম্বারের জীবন ছিল সম্পূর্ণ অর্থহীন। সেই সংখ্যা আর মানুষটির জীবনকে ঘিরে তার নিয়তি, তার ইতিহাস, আর পরিচিতি ছিল আর কম গুরুত্বপূর্ণ। একজন চিকিৎসক হিসেবে অসুস্থ রোগীদের যে গাড়িতে করে আমাকে ভাবারিয়ার এক শিবির থেকে অন্য শিবিরে যেতে হয়েছিল, সে গাড়ির লোকদের তালিকার মধ্যে এক যুবক কয়েদির ভাইয়ের নাম ছিলনা বলে তার ভাইকে পেছনে ফেলে যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু যুবকটি এত দীর্ঘ সময় ধরে অনুনয়-বিনয় করেছিল যে শিবির ওয়ার্ডেন তার অন্য একজন কয়েদির বদলে তার ভাইকে পাঠিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন, যাতে তার ভাইটিও যুবকটির সাথে যেতে পারে। যার দরুন ভাইটি এমন এক ব্যক্তির স্থান নিয়েছিল যে সে মুহূর্তে শিবিরে থেকে যাওয়াটা শ্রেয় মনে করেছিল। কিন্তু তালিকা তো সঠিক থাকা চায়! সহজেই তা সম্ভব হতো। ভাইটি অন্য বন্দীর নাম্বারের সাথে তার নাম্বারটি বদলে নিয়েছিল।

আমি যেমনটি আগেই উল্লেখ করেছি, আমাদের কাছে কোনো ধরনের নথিপত্র ছিল না। তাই প্রত্যেকেই তার নিজের দেহকে অক্ষত রাখতে পারার কারণে সৌভাগ্যবান ছিল, যে দেহটিতে সর্বোপরি তখনও নিঃশ্বাস আসা যাওয়া করছিল। আমাদের সম্পর্কে অবশিষ্ট সবকিছুর প্রতি আগ্রহ তখনই ছিল, যখন অসুস্থ রোগীদের পরিবহনে আমাদের নিযুক্ত করা হয়ে থাকত, তা হতে পারে আমাদের রোগা কঙ্কাল থেকে ঝুলন্ত নেকড়া। ছেড়ে যাওয়ার সময় নির্লজ্জ আগ্রহের সাথে “মুসলেমদের” কোনো কোট বা জুতোজোড়া কারো কারো কোট বা জুতোর চেয়ে ভালো কিনা তা পরখ করে দেখছিল কিছু কিছু মানুষ। সর্বোপরি, তাদের ভাগ্যকে মোহর করে দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু যারা শিবিরে রয়ে গিয়েছিল, যারা তখনও কিছু কাজ করতে সমর্থ ছিল, তাদেরকে বেঁচে থাকার সম্ভাবনার উৎকর্ষ সাধনে প্রতিটি উপায়কে কাজে লাগাতে হয়েছিল। তারা ভাবপ্রবণ ছিলনা। তারা দেখতে পেলো যে তাদের ভাগ্য সম্পূর্ণরূপে প্রহরীদের মন-মেজাজের উপর নির্ভরশীল, যাকে একটি ভাগ্যের ছেলেখেলা বলা চলে। আর তা তাদের পরিস্থিতির দ্বারা আহুত অমানবিকতার চেয়েও বেশি অমানবিক করে তুলেছিল। 

অশউৎয শিবিরে আমি আমার নিজের জন্য একটি নিয়ম বাস্তবায়ন করি যা মঙ্গলজনক নিয়মে পরিণত হয়। এবং যা পরবর্তীতে আমার অধিকাংশ সহ-কর্মী অনুসরণ করেছিল। আমি সাধারণত সব প্রশ্নে উত্তর সততার সাথে দিতাম। কিন্তু স্পষ্টভাবে জিজ্ঞেস না করা কোনো প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে আমি নীরব থাকতাম। আমার বয়স জিজ্ঞেস করা হলে আমি তা বলতাম। আমার পেশা সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হলে আমি বলতাম আমি একজন “চিকিৎসক”, কিন্তু কি ধরনের চিকিৎসক তা ব্যাখ্যা করতাম না। অশউইৎযের প্রথম সকালে একজন SS কর্মকর্তা মাঠে কুচকাওয়াজ করতে এসেছিলেন। আমাদের কয়েদিদের পৃথক পৃথক সারিতে দাঁড়াতে হয়েছিল: চল্লিশ বছরের ঊর্ধ্বে, চল্লিশ বছরের নীচে, মেটাল শ্রমিক, কারিগর, ও অন্যান্য। তারপর আমাদের দেহের ভেতরে কোনো আঘাত আছে কিনা তা পরীক্ষা করে দেখা হয়েছিল এবং কয়েকজন বন্দীকে নিয়ে আরেকটি নতুন দল তৈরি করা হয়েছিল। আমি যে দলে ছিলাম সে দলটিকে অন্য একটি ছাউনিতে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল যেখানে আমরা পুনরায় সারিবদ্ধ হয়েছিলাম। আরও একবার যাচাই-বাছাইয়ের পর ও আমার বয়স আর পেশা সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদের পর আমাকে আরেকটি ছোট দলে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছিল। আরও একবার আমাদের অন্য একটি ছাউনিতে চালিত করে ভিন্নভাবে দলবদ্ধ করা হয়েছিল। এই প্রক্রিয়া চলতে থাকে কিছু সময় ধরে, আর অবোধ্য বিদেশী ভাষায় কথা বলা অপরিচিতদের মাঝে নিজেকে আবিষ্কারের ফলে আমি কিছুটা অসন্তুষ্ট হয়েছিলাম। তারপর আসে অন্তিম নির্বাচনের পালা, আমি নিজেকে প্রথম ছাউনিতে যে দলটিতে ছিলাম সে দলটিতে নিজেকে পুনরায় খুঁজে পায়! তারা বুঝতে পারেনি যে আমাকে ইতিমধ্যে এক ছাউনি থেকে অন্য ছাউনিতে পাঠানো হয়েছিল। কিন্তু আমি বুঝতে পেরেছিলাম যে সেই কয়েক মিনিটে আমার নিয়তি আমার কাছে বিভিন্ন রূপে ধরা দিয়েছিল।

যখন “বিশ্রাম শিবিরের” জন্য অসুস্থদের নিয়ে যাওয়ার পরিবহনের আয়োজন করা হচ্ছিল, তখন তালিকায় আমার নাম (আমার নাম্বার বা সংখ্যা) দেওয়া হয়েছিল কারণ সেখানে কয়েকজন চিকিৎসকের প্রয়োজন ছিল। কিন্তু কেউই বিশ্বাস করতে পারছিলো না যে গাড়িটি আসলেই কোনো বিশ্রাম শিবিরের দিকে যাচ্ছিল। কয়েক সপ্তাহ আগেও সেই একই পরিবহনের ব্যবস্থা করা হয়েছিল। তখনও সবাই ভেবে নিয়েছিল যে গাড়িটি গ্যাস চুল্লির জন্য নির্ধারণ করা হয়েছিল। কিন্তু যখন ঘোষণা করা হলো যে, যারা ভয়াবহ রাতের শিফটে রোগীদের স্বেচ্ছাসেবা প্রদান করবে তাদের নাম পরিবহনের জন্য প্রস্তুত তালিকা থেকে বাদ দেয়া হবে, সঙ্গে সঙ্গে বিরাশি জন কয়েদি স্বেচ্ছায় এগিয়ে এসেছিল। পনের মিনিট খানেক পর পরিবহনটি বাতিল করা হলেও রাতের শিফটের জন্য বিরাশি জনের নাম তালিকায় রয়েই গেল। অনেকের কাছে তা ছিল পরবর্তী পনের দিনের মধ্যে মৃত্যু।

এখন পুনরায়  বিশ্রামে ক্যাম্পের জন্য দ্বিতীয় বারের মতো পরিবহনের ব্যবস্থা করো হলো। আবারও কেউই বিশ্বাস করতে পারছিলো না যে অসুস্থদের কাছ থেকে চৌদ্দ দিনের জন্য কাজ আদায়ের শেষ কামড় ছিল কিনা—বা গ্যাস চুল্লিতে যাবে কি না, অথবা যাবে কিনা প্রকৃত বিশ্রাম শিবিরে। প্রধান চিকিৎসক, যিনি আমাকে পছন্দ করতেন, এক সন্ধ্যায় পৌনে দশটার দিকে চুপেচুপে আমাকে বলেছিলেন, “কর্তব্যরত কক্ষে আমি জানিয়ে দিয়েছি যে তুমি চাইলে তালিকা থেকে তোমার নাম মুছে ফেলতে পারবে; তুমি দশটা পর্যন্ত সময়ের মধ্যে তা করতে পারো”।

আমি তাকে বললাম যে এটা আমার কাজ নয়; নিয়তি আমাকে যে দিকে নিয়ে যায় সেদিকে আমি চলতে শিখেছি। “আমিও সম্ভব আমার বন্ধুদের সাথে থাকতে চাই”, আমি বললাম। তার চোখে আমি কৃপার দৃষ্টি লক্ষ করি, মনে হলো যেন তিনি তা জানতেন….। তিনি নীরবে আমার সাথে করমর্দন করেন, মনে হলো যেন বিদায় জানাচ্ছেন, আজীবনের জন্য নয়, বরং জীবন থেকে বিদায় জানাচ্ছেন। ধীরে ধীরে আমি আমার ছাউনির দিকে হেটে যায়। গিয়ে দেখি সেখানে আমার এক ভালো বন্ধু আমার জন্য অপেক্ষা করছে।

“তুমি কি আসলে তাদের সাথে যেতে চাও”? সে জিজ্ঞেস করেছিল।

“ হ্যাঁ, আমি যাচ্ছি”।

তার চোখে পানি আসলো আর আমি তাকে সান্ত্বনা দিতে চেষ্টা করেছিলাম। তার কাছে আমার ইচ্ছার কথা জানিয়ে দেওয়া বাকি ছিল-

“শুনো, ওটো, আমি যদি আমার স্ত্রীর কাছে ফিরে নাও যাই, ও তার সাথে যদি তোমার পুনরায় দেখা হয়, তাহলে তাকে বলো যে প্রতিদিন, প্রতি মুহূর্তে আমি তাকে স্মরণ করছিলাম। তোমার মনে আছে নিশ্চয়। দ্বিতীয়ত, যে কারো চেয়েও বেশি আমি তাকে ভালবেসেছিলাম। তৃতীয়ত, যে সংক্ষিপ্ত সময়টিতে আমি তার সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ থেকেছি তা এখানে আমি যা কিছুর মধ্য দিয়ে গিয়েছি তার সবকিছুকেই ছাড়িয়ে গেছে”।

ওটো, তুমি এখন কোথায়? তুমি কি বেঁচে আছো? শেষবার যখন দু’জন একসঙ্গে হয়েছিলাম তখন থেকে তোমার কি হয়েছে? তুমি কি আবার তোমার স্ত্রীকে খুঁজে পেয়েছ? তোমার কি মনে আছে তোমার শিশুসুলভ কান্না সত্ত্বেও আমি কিভাবে তোমাকে আমার ইচ্ছা মুখস্থ করিয়েছিলাম?

পরদিন সকালে আমি পরিবহনের সাথে চলে গিয়েছিলাম। এবার তা কোনো গুজব ছিল না। গ্যাস চেম্বারে না গিয়ে আমরা এক বিশ্রাম শিবির দিকে ধাবিত হচ্ছিলাম। যারা আমাকে দয়া দেখিয়েছিল তারা শিবিরে রয়ে গিয়েছিল। আমাদের চলে যাওয়ার পর সে শিবিরে এক দুর্ভিক্ষ আমাদের নতুন শিবিরের চেয়ে মারাত্মকভাবে তাণ্ডব চালিয়েছিল। তারা নিজেদের বাঁচাতে চেষ্টা করলেও তাদের নিয়তি নির্ধারিত হয়ে গিয়েছিল। কয়েক মাস পর, আমাদের মুক্তি পর অশউইৎযের পুরনো শিবিরের এক বন্ধুর সাথে আমার সাক্ষাত হয়েছিল। একজন শিবিরের একজন সে পুলিশ হিসেবে সে আমাকে বলেছিল যে, সে লাশের স্তূপ থেকে হারিয়ে যাওয়া সে একটুকরো মানব দেহের খুঁজ করেছিল। সে মানব দেহটি একটি পাত্রের ভেতরে রান্না করা অবস্থায় খুঁজে পেয়ে জব্দ করে। নরমাংস খাওয়া ছড়িয়ে পড়েছিলো শিবিরে। ভাগ্যিস আমি ঠিক সময়েই শিবির ছেড়ে চলে গিয়েছিলাম।

এটি কি আপনাকে Death in Teheran বা তেহরানে মৃত্যু গল্পটির কথা স্মরণ করিয়ে দেয় না? পারস্যের এক ধনী ও শক্তিশালী লোক একদা তার দাস-দাসীদের সঙ্গে নিয়ে তার বাগানে পায়চারি করছিলেন। এক দাস চিৎকার করে বলে উঠে যে সে এইমাত্র মৃত্যুর সাথে মুখোমুখি হয়েছিল, যে তাকে হুমকি দেয়। তাই সে তার প্রভুকে অনুনয় করে তার সবচেয়ে দ্রুততম ঘোড়াটি তাকে দেওয়ার অনুরোধ করে যাতে সে দ্রুত তেহরানে পালিয়ে যেতে পারে, যেখানে সে সন্ধ্যায় পৌঁছাতে পারতো। প্রভু রাজি হলেন আর দাসটি ঘোড়ার পিটে রওয়ানা করে। বাড়িতে ফেরার পথে প্রভু নিজেই মৃত্যুর সাথে সাক্ষাৎ করে, এবং মৃত্যুকে প্রশ্ন করে, “আপনি কেন আমার দাসকে আতঙ্কিত ও হুমকি দিয়েছেন?” “আমি তাকে হুমকি দেয়নি; আমি কেবল তাকে এখানে খুঁজে পেয়ে তার কাছে বিস্ময় প্রকাশ করেছিলাম। আজ রাতেই তেহরানে তার সাথে সাক্ষাতের পরিকল্পনা করেছি”, মৃত্যু বলল।

*******

শিবিরের কয়েদিরা কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণে ও কোনো ধরনের পদক্ষেপ নিতে ভীতসন্ত্রস্ত ছিল। নিয়তি যে কারো জীবনের নিয়ন্ত্রক হতে পারে তা তারই শক্তিশালী ফলাফল। তারা চিন্তা করতো নিয়তিকে কোনোভাবেই প্রভাবিত করা উচিৎ নয়। নিয়তিকে বরং এর নিজের গতিতেই চলতে দেওয়া উচিৎ। অধিকন্তু, উদাসীনতাও কয়েদিদের অনুভূতিতে এক বড় প্রভাব ফেলতো। অনেক সময়, জীবন-মৃত্যুর কারণ হতে পারে এমন তড়িৎ সিদ্ধান্ত তাদের গ্রহণ করতে হতো। নিয়তিকে তাদের হয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করাটাকে কয়েদিরা শ্রেয় মনে করতো। বন্দীদশার এই গৃহীত দায়িত্ব থেকে রেহায়ের এই উপায় শিবির থেকে কোনও কয়েদির পালিয়ে যাওয়ার প্রচেষ্টার পক্ষে-বিপক্ষে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে সবচেয়ে সুস্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হতো। সিদ্ধান্ত নেওয়ার সে মিনিটগুলিতে সে নরকের যন্ত্রণা ভোগ করতো। তার কি পালিয়ের যাওয়ার চেষ্টা করা উচিৎ? ঝুঁকিটা নেওয়া কি তার উচিৎ হবে?   

আমিও এ যন্ত্রণার অভিজ্ঞতা লাভ করেছি। যুদ্ধক্ষেত্র যতই নিকটে আসতে থাকে, ততই আমার পালিয়ে যাওয়ার সুযোগ আসে। আমার এক বন্ধুকে চিকিৎসা দায়িত্বের খাতিরে শিবিরের বাইরে ছাউনিতে পরিদর্শনে যেতে হতো, সেও পালিয়ে যেতে চেয়েছিল। আর চেয়েছিল আমাকেও সঙ্গে নিতে। বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের পরামর্শ প্রয়োজন এমন এক রোগীকে পরামর্শ দানের ভান করে সে বাইরে বেরিয়ে পড়েছিল একদিন। শিবিরের বাইরে এক বিদেশী প্রতিরোধ আন্দোলন কর্মীর আমাদের উর্দি ও প্রয়োজনীয় কাগজ-পত্র সরবরাহ করার কথা ছিল। ঠিক সে মুহূর্তে শিবিরে কিছু কারিগরি জটিলতা দেখা দেয়ার কারণে আমাদের পুনরায়  শিবিরে ফিরে যেতে হয়েছিল। সুযোগটিকে আমরা কিছু খাদ্য সংগ্রহ—কয়েকটি পচা আলু—এবং কাঁদ ব্যাগ খুঁজার জন্য ব্যবহার করি।

আমরা মহিলাদের একটি খালি ছাউনিতে দরজার ভেঙ্গে ডুকে পড়েছিলাম। মহিলাদের অন্য শিবিরে পাঠিয়ে দেওয়াই ছাউনিটি খালিই পড়েছিল। ছাউনিটি খুবই বিশৃঙ্খল অবস্থায় ছিল; দেখে বোঝা-ই যাচ্ছিল যে অনেক মহিলা জোগান সংগ্রহ করে পালিয়েছে। নেকড়া, স্ট্র, পচা খাবার, ভাঙ্গা হাড়ি-পাতিলে সয়লাব ছিল ছাউনিটি। কয়েকটি বাটির অবস্থা তখনও ভালো ছিল, যা আমাদের কাছে মূল্যবান মনে হলেও না নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। কারণ আমরা জানতাম যে সম্প্রতি সেগুলি কেবল খাবারের জন্য ব্যবহার করা হয়নি, বরং তা হাত-ধোয়ার বেসিন ও মূত্রাধার বা মূত্রধানী হিসেবেও ব্যবহার করা হয়েছে। ছাউনিতে কোনো ধরনের বাসনকোসন আনার বিরুদ্ধে কঠোর আইন ছিল। যদিও কাউকে কাউকে এই বিধিনিষেধ ভাঙ্গতে বাধ্য করা হয়েছিল, বিশেষত টাইফাস রোগীর ক্ষেত্রে। টাইফাস রোগীরা এতই দুর্বল ছিল যে অন্যদের সাহায্য নিয়েও বাইরে বের হতে পারত না।  আমি যখন পাহারাদার হিসেবে কাজ করছিলাম তখন আমার বন্ধুটি ভেতরে ডুকেই অল্প সময়ের মধ্যে তার কোটের ভেতর লুকিয়ে একটি কাঁদ-ব্যাগ নিয়ে ফিরে আসল। সে ভেতরে আরও একটি কাঁদ-ব্যাগ পড়ে থাকতে দেখে তা আমাকে সংগ্রহ করতে বলেছিল। তাই আমরা আমাদের অবস্থান পরিবর্তন করে আমি ভেতর ডুকে পড়ে ছিলাম। আবর্জনার মধ্যে খুঁজ করার সময় আমি যে শুধু কাঁদ-ব্যাগ আর দাঁত মাজার ব্রাশ খুঁজে পেয়েছিলাম তা নয়, অন্যান্য জিনিসের মাঝে আমি হঠাৎ ফেলে যাওয়া একটি বস্তুর দিকে লক্ষ্য করি, তা ছিল এক নারী দেহ।

আমি দৌড়ে আমার জিনিসপত্র সংগ্রহ করার জন্য আমার ছাউনিতে ফিরে যায়। আমার খাবার বাটি, এক মৃত টাইফাস রোগীর কাছ পাওয়া একজোড়া চীর্ণ দস্তানা, এবং শর্ট-হ্যান্ড নোট সম্বলিত কয়েকটি কাগজের টুকরো (যাতে, যেমনটি আমি আগে বলেছি, আমি অশউইৎযে হারানো পাণ্ডুলিপিটি পুনর্ঘটন শুরু করেছিলাম) সংগ্রহ করে নিয়েছিলাম। ছাউনির উভয় দিকে গলিত কাঠের তক্তায় গাদাগাদি করে শুয়ে থাকা আমার রোগীদের দ্রুত এক চক্কর দিলাম। মৃতপ্রায় আমার একমাত্র স্বদেশীকে তার মারাত্মক পরিস্থিতি সত্ত্বেও তাকে বাঁচিয়ে রাখা ছিল আমার লক্ষ্য। তখনও পালিয়ে যাওয়ার ইচ্ছায় দৃঢ় প্রতিজ্ঞ ছিলাম, কিন্তু আমার কিছুটা বিচলিত আচরণ দেখে আমার সহকর্মীটি বোধহয় ততক্ষণে ধারণা করে ফেলেছিল যে আমার কোনো না কোনো সমস্যা হয়েছে। পরিশ্রান্ত কণ্ঠে সে আমাকে জিজ্ঞেস করে, “তুমিও বের হয়ে যাচ্ছো”? আমি তা অস্বীকার করলাম, কিন্তু তার দুঃখিত চাহনি এড়িয়ে চলা আমার পক্ষে কঠিন হয়ে পড়েছিল। আমার রোগীদের দেখাশুনা করার পালা শেষ হওয়ার পর আমি তার কাছে ফিরে যায়। পুনরায়  তার নিরাশ চাহনি আমাকে সম্ভাষণ জানায় এবং কোনো না কোনো ভাবে তা আমার কাছে এক অভিযোগর চাহনি বলে মনে হয়েছিল। আমি যে তার সাথে পালিয়ে যাবো তা আমার বন্ধুকে বলা সাথে সাথে যে অপ্রীতিকর অনুভূতি আমাকে ঘিরে ধরেছিল তা আরও প্রগাড় হয়ে উঠেছিল সে মুহূর্তে। হঠাৎ একবারের জন্য হলেও আমার ভাগ্য আমার নিজের হাতে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। আমি দৌড়ে ছাউনি থেকে বের হয়ে গেলাম এবং আমার বন্ধুকে বললাম যে আমি তার সাথে যেতে পারব না। যখনই চূড়ান্তভাবে তাকে বললাম যে আমি আমার রোগীদের সাথে থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছি, অপ্রীতিকর অনুভূতি আমাকে ছেড়ে চলে যায়। আমি জানতাম না পরের দিন আমার জন্য কি রয়েছে, কিন্তু আমার ভেতরে আমি এক আভ্যন্তরীণ প্রশান্তি লাভ করেছিলাম যার অভিজ্ঞতা আমি এর পূর্বে আমি কখনও লাভ করিনি। ছাউনিতে ফিরে গিয়ে আমার স্বদেশীর পায়ের কাছে তক্তায় বসে পড়ি এবং তাকে সান্ত্বনা দিতে চেষ্টা করি; তারপর অন্যদের সাথে আলাপ করেছি, এবং প্রলাপ বিকারে মধ্যে তাদের শান্ত করতে চেষ্টা করেছিলাম।

শিবিরে আমাদের শেষদিন আসে। যুদ্ধক্ষেত্র নিকটে আসলে, গণ-পরিবহন সমূহ প্রায় সব বন্দীদের অন্যান্য শিবিরে নিয়ে যায়। সব শিবির কর্তৃপক্ষ, ক্যাপু ও রাঁধুনিরা পালিয়ে গিয়েছিল। সে দিন এক আদেশ জারি করা হয়েছিল যে, সূর্যাস্তের মধ্যে অবশ্যই শিবির খালি করে দিতে হবে। এমনকি কয়েকজন অবশিষ্ট অসুস্থ ব্যক্তি, কয়েকজন চিকিৎসক, ও কয়েকজন নার্স সহ সব কয়েদিদের চলে যেতে হবে। রাতে শিবিরে আগুন দেওয়ার কথা। বিকেলে যে ট্রাকগুলির রোগীর সংগ্রহ করার কথা ছিল তা তখনও এসে পৌঁছায়নি। বরং ক্যাম্পের প্রবেশদ্বারগুলি হঠাৎ বন্ধ করে দেওয়া হলো এবং কাঁটাতারের বেড়ার দিকে নিবিড় নজর রাখা হলো যাতে কেউ পালানোর চেষ্টা না করে। মনে হচ্ছিল যেন অবশিষ্ট কয়েদিদের শিবিরের সাথে আগুনে জ্বলতে হবে। আমি ও আমার বন্ধুটি দ্বিতীয় বারের মতো পালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম।

কাঁটাতারের বাইরে তিনজন মানুষকে দাফন করার আদেশ দেওয়া হলো আমাদের। শিবিরে কেবল আমাদের দুজনেরও সে কাজ করার জন্য পর্যাপ্ত শক্তি ছিল। প্রায় সবাই তখনও ব্যবহৃত হওয়া কয়েকটি ছাউনিতে জ্বর আর প্রলাপ বিকারের কারণে শুয়ে থাকছিল। আমরা আমাদের পরিকল্পনা করেছিলাম যে, প্রথমে লাশের সাথে আমরা কফিন হিসেবে ব্যবহৃত হওয়া ধোলাইখানার টবের ভেতর লুকিয়ে আমার বন্ধুর কাঁদ-ব্যাগটি পার করবো। দ্বিতীয় লাশটি বাইরে নিয়ে যাওয়ার সময় আমরা আমার কাঁদ-ব্যাগটিও বহন করে নিয়ে যাবো, আর তৃতীয় যাত্রায় আমরা পালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেবো। প্রথম দু’যাত্রা আমাদের পরিকল্পনা অনুযায়ী সম্পন্ন হয়েছিল। ফিরে এসে পরবর্তী কয়েকদিন জঙ্গলে খাওয়ার জন্য আমার বন্ধু যখন একটুকরো রুটির সন্ধান করছিল তখন আমি তার জন্য অপেক্ষা করছিলাম। আমি অপেক্ষা করেই চলছিলাম। কয়েক মিনিট পার হয়ে গেলো। তার ফিরে না আসাতেই আমি অধৈর্য হয়ে উঠেছিলাম। তিন বছর বন্দীদশার পর, আমি আনন্দের সাথে মুক্তির চিত্র আঁকছিলাম, যুদ্ধক্ষেত্রের পানে ছুটে যাওয়া কতোটা অপূর্ব হতে পারে তা কল্পনা করছিলাম। কিন্তু আমরা ততদূর যেতে পারিনি, আমাদের পরিকল্পনা সফল হয়নি।

যখন আমার বন্ধু ফিরে আসে তখন শিবিরের প্রবেশদ্বার খুলে দেওয়া হয়েছিল। অ্যালুমিনিয়াম রঙ্গের চমৎকারে একটি কার, যাতে বড় করে রেডক্রস অঙ্কিত ছিল, ধীরে ধীরে কুচকাওয়াজ মাঠে অগ্রসর হয়। জেনেভার আন্তর্জাতিক রেডক্রসের একজন প্রতিনিধি এসে পৌঁছেছিলেন, আর শিবির ও এর কয়েদীরা এখন তার আশ্রয়ে। প্রতিনিধিটি নিকটস্থ এক খামারবাড়িতে বাস করতে শুরু করেছিলেন যাতে জরুরী পরিস্থিতিতে সবসময় শিবিরের কাছাকাছি থাকতে পারেন। পালিয়ে যাওয়ার কথা এখন কে চিন্তা করে? গাড়ি থেকে ঔষধের বাক্সগুলি নামিয়ে আনা হলো, সিগারেট বণ্টন করা হলো। আমাদের ছবি তুলা হলো আর তখন আমাদের আনন্দ সর্বাত্মক রাজত্ব করেছিল। এখন যুদ্ধ ক্ষেত্রের দিকে পলায়ন করে ঝুঁকি নেওয়া কোনো প্রয়োজন ছিলনা।

আমাদের উত্তেজনার বশে তৃতীয় লাশটির কথা আমরা ভুলেই গিয়েছিলাম। লাশটি বহন করে বাইরে নিয়ে গিয়ে তিনজনের জন্য ইতিমধ্যে খুড়ে রাখা কবরে তাকে ফেলে দিয়েছিলাম। আমাদের সাথে থাকা যে প্রহরীটি তুলনামূলকভাবে একজন অমানবিক লোক ছিলেন—হঠাৎ করে তিনি শান্ত-ভদ্র হয়ে গেলো। তিনি লক্ষ্য করলেন যে পরিস্থিতি বদলে যেতে পারে আর তাই তিনি অনুগ্রহ লাভের চেষ্টা করেছিলেন। তিনি মৃত ব্যক্তিদের উপর মাটি ছিটিয়ে দেওয়ার আগে তাদের জন্য আয়োজিত সংক্ষিপ্ত প্রার্থনায় অংশগ্রহণ করেছিলেন। বিগত দিন ও মুহূর্তের চিন্তা আর উত্তেজনার পর মৃত্যুর সাথে দৌড়ের সেই শেষ দিনগুলিতে শান্তি কামনায় আমাদের প্রার্থনার ভাষা ছিল কখনও কোনো মানব কণ্ঠে উচ্চারিত ভাষার মতোই আকুলতাপূর্ণ।

আর তাই শিবিরের শেষ দিনগুলি মুক্তির অপেক্ষায় কাটে। কিন্তু আমরা খুব আগ থেকেই আনন্দিত হয়ে পড়েছিলাম। রেডক্রস প্রতিনিধি আমাদের নিশ্চিত করেছিলেন যে একটি চুক্তি সাক্ষরিত হয়েছে, এবং তাই শিবির খালি করে দেওয়ার আর প্রয়োজন নেই। কিন্তু তারপরও সেই রাতে ট্রাক আর শিবির খালি করার আদেশ নিয়ে SS কর্মীদের আগমন ঘটেছিল। অবশিষ্ট শেষ বন্দীদের একটি কেন্দ্রীয় শিবিরে নিয়ে যাওয়ার কথা বলা হলো, যেখান থেকে তাদেরকে আটচল্লিশ ঘণ্টার মধ্যে কিছু যুদ্ধবন্দীর সাথে বিনিময় হওয়ার জন্য সুইৎযারল্যান্ডে পাঠিয়ে দেওয়া হবে। আমরা SS কর্মীদের সহজে চিনতে পারিনি। তারা খুবই বন্ধুসূলভ আচরণ করতে শুরু করে, নির্ভয়ে আমাদের ট্রাকে উঠার জন্য বোঝাতে থাকে, আর বলেছিল যে আমাদের সৌভাগ্যের জন্য আমাদের অবশ্যই কৃতজ্ঞ হওয়া উচিৎ।

যারা মোটামুটি শক্তিশালী ছিল তারা ভিড় করে ট্রাকে উঠে পড়ে আর গুরুতরভাবে অসুস্থ ও দুর্বলদের কষ্ট করে তুলা হয়েছিল। আমি ও আমার বন্ধু এখন আমাদের কাঁদ-ব্যাগ লুকিয়ে না রেখে, শেষ দলে দাঁড়িয়েছিলাম। যে দলটি থেকে পরবর্তী শেষ ট্রাকের জন্য তের জনকে বেছে নেওয়ার কথা। প্রধান চিকিৎসক প্রয়োজনীয় সংখ্যাটি শব্দ করে গণনা করলেন, কিন্তু গনগনায় তিনি আমাদের দুজনকে বাদ দিলেন। তের জনকে ট্রাকে তুলা হলো, আর আমরা দুজনকে পেছনে থেকে রয়ে যেতে হয়েছিল। বিস্মিত, খুব বিরক্ত আর হতাশ হয়ে আমরা তার জন্য প্রধান চিকিৎসককেই দায়ী করেছিলাম। ক্লান্ত এবং অমনোযোগী হওয়ার কারণে এ ঘটনা হয়েছে বলে জানিয়ে তিনি ক্ষমা চেয়েছিলেন। তিনি ভেবেছিলেন আমরা হয়তো তখনও পালিয়ে যাওয়ার জন্য সংক্ল্পবব্ধ ছিলাম, তাই তিনি তাদের বাদ দিয়েছিলেন। কাঁদ-ব্যাগ কাঁদে রেখে অধৈর্য হয়ে আমরা বসে পড়লাম, আর বাকী কয়েকজন বন্দীদের সাথে শেষ ট্রাকে অপেক্ষায় থাকি। দীর্ঘ সময় আমাদের অপেক্ষা করতে হয়েছিল। শেষ কয়েক ঘনটা আর কয়েকদিনের উত্তেজনায় ভারাক্রান্ত হয়ে অবশেষে আমরা পরিত্যক্ত প্রহরী কক্ষের মেট্রেসের উপর শুয়ে পড়েছিলাম। এই সময়ে আমরা আশা-নিরাশার মাঝে অবিরতভাবে দোলতে থাকি। যাত্রার জন্য প্রস্তুতি নেওয়া জুতা-কাপড়ে আমরা ঘুমিয়ে পড়ি।

রাইফেল আর কামানের শব্দে আমাদের ঘুম ভেঙ্গে যায়। ট্রেসার বুলেটের আলো ও বন্দুকের গুলাগুলি ছাউনিতে ডুকে পড়ে। প্রধান চিকিৎসক সবেগে ডুকে আমাদের মেঝেতে আশ্রয় নেওয়ার আদেশ দেন। এক কয়েদী জুতো পড়া অবস্থায় আমার উপরে অবস্থিত বিছানা থেকে আমার পেটের উপর লাফ দেয়। তা আমাকে আসলেই জাগিয়ে তুলেছিল! তারপর আমরা কি ঘটছিল তা অনুধাবন করতে পারি: যুদ্ধক্ষেত্র আমরা পর্যন্ত পৌঁছে গিয়েছিল! গুলাগুলি কমে যায় এবং সকাল নেমে আসে। বাইরে শিবিরের প্রবেশদ্বারে খুঁটিতে একটি সাদা পতাকা বাতাসে উড়ছিল।

**********

অনেক সপ্তাহ পর বুঝতে পারি যে, এমন কি সেই শেষ কয়েক ঘণ্টাতেও আমরা বাকি কয়েকজন কয়েদীর সাথে নিয়তি খেলা করেছিল। আমরা বুঝতে পারি মানুষের সিদ্ধান্ত কতটা অনিশ্চিত, বিশেষ করে জীবন-মৃত্যুর প্রশ্নে। আমাদের আদুরে অবস্থিত ছোট শিবিরে তুলা ছবিগুলি আমার সামনে আনা হয়েছিল। আমার যে বন্ধুরা সে রাতে ট্রাকে করে সেই ছোট শিবিরে মুক্তির দিকে যাত্রা করছে ভেবেছিল, সেখানে তাদের ছাউনিতে বন্দী করে পুড়িয়ে মারা হয়েছিল। ছবিতে তাদের দগ্ধ দেহগুলিকে চেনা যাচ্ছিল। আমার পুনরায় তেহরানে মৃত্যু বা Death in Tehran কাহিনীটির কথা মনে পড়লো।

************

প্রতিরক্ষামূলক কৌশল ভূমিকা ছাড়াও, কয়েদীদের উদাসীনতা অন্য উপাদানেরও ফসল। সাধারণ জীবনের মতো ক্ষুধা, ঘুমের অভাব উদাসীনতা ও সাধারণ বিরক্তি বোধের কারণ হয়ে উঠেছিল, যা কয়েদীদের মানসিক অবস্থার আরেক বৈশিষ্ট্য। ভয়াবহরুপে জনাকীর্ণ ছাউনিতে পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা আর স্বাস্থ্য বিধানের  সাধারণ অভাবে কীট-পতঙ্গের উপদ্রবের জালাতনই ঘুমের অভাবের জন্য কিছুটা দায়ী। আমাদের কাছে কোনো ধরনের বিড়ি-সিগারেট বা চা-কফি না থাকাও উদাসীনতা এবং বিরক্তিবোধ অবস্থা সৃষ্টির কারণ।

উদাসীনতা এবং বিরক্তিবোধের এসব শারীরিক কারণের পাশাপাশি, নির্দিষ্ট কিছু জটিল ধরনের মানসিক কারণও বিদ্যমান ছিল। অধিকাংশ কয়েদীই এক ধরনের হীনমন্যতা জটিলতায় ভুগছিল। আমরা সবাই “বিশেষ কোনো ব্যক্তি” হওয়ার স্বপ্ন দেখতাম বা দেখেছিলাম। এখন আমাদের সাথে সম্পূর্ণ অনস্তিত্ব, অবস্তু বা অসত্তা হিসেবে আচরণ করা হচ্ছে। কারো আভ্যন্তরীণ মূল্যবোধের চেতনা উচ্চতর, বৃহত্তর আধ্যাত্মিক উপাদানে নোঙর বদ্ধ, আর তাকে শিবির জীবন-যাপনের মাধ্যমে নাড়ানো অসম্ভব। কিন্তু কয়েদি তো দুরের কথা, কয়জন স্বাধীনচেতা মানুষ তা লাভ করতে পারে? তাকে কেন্দ্র করে সচেতন চিন্তা ব্যতীত একজন সাধারণ বন্দী নিজেকে নিতান্তই মর্যাদাহীন অনুভব করতো। শিবিরের একক সমাজতাত্ত্বিক কাঠামোর দ্বারা প্রস্তাবিত বৈসাদৃশ্যগুলি পর্যবেক্ষণ করলে তা স্পষ্ট প্রতীয়মান হয়ে ওঠে। নিয়ম অনুযায়ী সুপরিচিত কয়েদীরা, যেমন ক্যাপু, রাঁধুনি, গুদাম ঘরের পাহারাদার, এবং শিবিরের পুলিশেরা কোনোভাবেই অধিকাংশ বন্দীদের মতো এতো মর্যাদাহীন অনুভব করেনি, বরং উল্টো তাদের পদোন্নতি দেওয়া হতো! এমনকি কেউ কেউ ক্ষুদ্রাকার মহিমা-বিভ্রম গড়ে তুলেছিল। অনুগ্রহপ্রাপ্ত এই ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীর প্রতি ঈর্ষান্বিত ও অসন্তুষ্ট সংখ্যাগরিষ্ঠদের মানসিক প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করার হরেক রকম উপায় ছিল। অনেক সময় রসিকতার মাধ্যমে হয়ে থাকতো। উদাহরণ সরূপ, একজন বন্দীকে আমি এক ক্যাপুর ব্যাপারে বলতে শুনেছিলাম, “চিন্তা করতে পারো”! কেবল বড় এক ব্যাংকের প্রেসিডেন্ট হিসেবে আমি লোকটিকে চিনতাম। এটা কি সৌভাগ্যের বিষয় নয় যে পৃথিবীতে সে অনেক উচ্চতায় পৌঁছেছে”?

মর্যাদাহীন সংখ্যাগরিষ্ঠ এবং পদোন্নতি পাওয়া ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠী সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়লে তার ফলাফল হতো বিস্ফোরক রকমের। অতএব, এসব মানসিক চাপ যুক্ত হয়ে সাধারণ বিরক্তি বোধ হয়ে উঠত সবচেয়ে তীব্রতর। প্রায়শই এই মানসিক চাপ সাধারণ মারামারিতে রূপ নেওয়াটা অবাক করার কিছু ছিলনা। কারণ একজন কয়েদি ক্রমাগতভাবে প্রহারের দৃশ্য দেখতে দেখতে সহিংসতার প্রতি তার তাড়না বৃদ্ধি পেতে থাকে। ক্ষুধার্ত ও ক্লান্ত অবস্থায় আমার উপর ক্ষোভ ভর করলে আমি টের পায় আমার ঘুসি দৃঢ় মুষ্টিতে পরিণত হতে। আমি সাধারণত খুবই ক্লান্ত থাকতাম, কারণ আমাদেরকে সারা রাতজুড়ে চুলার আগুনে কাঠ সরবরাহ দিতে হতো। টাইফাস রোগীদের কারণে আমাদের ছাউনিতে একটি চুলা রাখার অনুমতি দেওয়া হয়েছিল। যদিও সবচেয়ে অলস ঘণ্টাগুলি আমি পেয়েছিলাম মধ্যরাতে যখন অন্যরা বিকারগ্রস্ত হয়ে পড়ে থাকতো বা ঘুমিয়ে থাকতো। চুলার সামনে আমি সোজা হয়ে শুয়ে থাকতে পারতাম এবং চুরি করা কয়লা থেকে সৃষ্ট আগুনে চুরি করে আনা কয়েকটি আলু তাতে সেক দিতাম। কিন্তু পরদিন আমি সবসময়ই আরও অধিক ক্লান্ত, অনুভূতিহীন ও বিরক্তি অনুভব করতাম।   

*********

টাইফাস রোগীদের ঘরে আমি যখন একজন চিকিৎসক হিসেবে কাজ করছিলাম, তখন আমাকে অসুস্থ সিনিয়র ব্লক ওয়ার্ডেনের কাজও করতে হয়েছিল।  তাই শিবির কর্তৃপক্ষের নিকট ছাউনি পরিষ্কার রাখার বিষয়ে আমি দায়বদ্ধ ছিলাম- যদি আদৌ “পরিষ্কার” শব্দটি এরকম পরিস্থিতিকে বর্ণনায় ব্যবহার করা সম্ভব হয়ে থাকে। ছাউনিতে ঘন ঘন পরিদর্শনের ছুতোর পেছনে স্বাস্থ্যবিধির চেয়ে জালাতনের উদ্দেশ্যেই ছিল বেশী। আরও একটু খাবার এবং কয়েকটি ঔষধই যেখানে বেশি সহায়ক হতো, সেখানে পরিদর্শকদের উদ্বেগ ছিল কেবলই গলির মাঝখানে কোনো স্ট্র ফেলে যাওয়া হলো কিনা , কিম্বা ময়লা , জীর্ণ এবং রোগীদের কীট-পতঙ্গে আক্রান্ত কম্বলগুলি নিখুঁতভাবে তাদের পায়ের সাথে গুঁজিয়ে দেওয়া হলো কিনা তা নিয়ে। কয়েদিদের নিয়তির বেলায় তারা ছিল বেশ বিবেচনাহীন। আমার নেড়া মাথা থেকে আমার কয়েদী টুপিতে আঘাত করতে করতে এবং আমার পায়ের গোড়ালি দিয়ে জোতার ক্লিক শব্দ করে যদি আমি চটপটে হয়ে রিপোর্ট করতাম,“ছাউনি নাম্বার ৬/৯, ৫২ জন রোগী, দু’জন সেবক বেয়ারা, ও একজন চিকিৎসক”, তাতে পরিদর্শকেরা সন্তুষ্ট হতো। তারপর তারা চলে যেতো। অনেক সময় তারা ঘোষিত সময়ের চেয়ে কয়েক ঘণ্টা দেরি করতো বা অনেক সময় আসতই না। কিন্তু যতক্ষণ না তারা এসে পৌঁছেছে ততোক্ষণ আমাকে জোর করে কম্বলগুলি সোজা রাখতে, বাঙ্ক বিছানা থেকে পড়া স্ট্রটি কুড়িয়ে নিতে, বিছানায় এপাশ ওপাশ করতে থাকা বেচারা দুষ্টদের চিৎকার করে এবং পরিপাটি ও পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতায় আমার সমস্ত প্রচেষ্টাকে লণ্ডভণ্ড করার হুমকি দিয়ে যেতে হতো। জ্বরের রোগীদের কাছে উদাসীনতা মাত্রা ছিল বিশেষত চড়া, তাই চিৎকার করা ছাড়া তারা একেবারেই কোনো সাড়া দিত না। অনেক সময় তাতেও কাজ হত না, আর তখন তাকে আঘাত না করার জন্য প্রচণ্ড আত্ম-নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা প্রয়োজন হতো। কারণ নিজের বিরক্তি বোধ অন্য জনের উদাসীনতার মুখোমুখি হয়ে অনেক অনুপাতে বেড়ে যেতো, বিশেষত আসন্ন পরিদর্শনের মতো বিপদের মুখোমুখি হলে।

*********

বন্দী শিবিরের বন্দীদের সাধারণ বৈশিষ্ট্য সমূহের এই মনস্তাত্ত্বিক উপস্থাপনা এবং সাইকোপ্যাথোলজিকাল ব্যাখ্যা প্রদানের প্রচেষ্টায়, আমি এই ধারণাটি দিতে পারি যে, মানুষ তার চারপাশ দ্বারা সম্পূর্ণ এবং অনিবার্যভাবে প্রভাবিত। এ ক্ষেত্রে পারিপার্শ্বিকতা হলো শিবির জীবনের অনন্য কাঠামো, যা একজন কয়েদির আচরণকে নির্দিষ্ট এক আকৃতিতে খাপ খাইয়ে নেওয়ায় বাধ্য করতো। তাহলে মানব মুক্তির কোনো উপায় আছে? আচরণের ক্ষেত্রে কিম্বা নির্দিষ্ট কোনো পারিপার্শ্বিকতা বা পরিবেশের প্রতি প্রতিক্রিয়ার বেলায় কি কোনো আধ্যাত্মিক মুক্তি নেই?

মানুষ যে অনেক শর্তাধীন ও পরিবেশগত উপাদানের ফলাফল ব্যতীত কিছু নয় এমন ধারনা দেওয়া তত্ত্বটি কি সত্য – হোক তা জৈবিক, মনস্তাত্ত্বিক বা সমাজতাত্ত্বিক প্রকৃতির? মানুষ কি এসবের দৈব ফলাফল ছাড়া আর কিছুই নয়? সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নটি হলো: বন্দী শিবিরের অদ্ভুত জগতের প্রতি কয়েদিদের প্রতিক্রিয়া কি প্রমাণ করে যে মানুষ তার পারিপার্শ্বিকতা বা পরিবেশের প্রভাব থেকে পালাতে পারেনা? এরকম পারিপার্শ্বিকতা বা পরিবেশের সাক্ষাতে মানুষের কি বিকল্প ক্রিয়া বা ক্রিয়া নির্বাচন করার সুযোগ থাকে না?

এসব প্রশ্নের উত্তর আমরা অভিজ্ঞতার নিরিখে এবং তত্ত্বের ভিত্তিতে দিতে পারি। শিবির জীবনের অভিজ্ঞতা প্রমাণ করে যে বিকল্প ক্রিয়া বা পরিবেশের প্রতি আপনি কিভাবে আচরণ করবেন তা নির্বাচন করার সুযোগ মানুষের থাকে। শিবিরে তার বহু উদাহরণ ছিল যাতে প্রমাণ হয় যে উদাসীনতাকে অতিক্রম করা সম্ভব, সম্ভব বিরক্তি বোধকে দমন করা। যে উদাহরণ সমূহ অনেকটাই বীরত্বপূর্ণ প্রকৃতির। মানুষ আধ্যাত্মিক মুক্তির, মনের স্বাধীনতার, এমনকি এরকম মানসিক ও শারীরিক চাপের ভয়াবহ অবস্থার মাঝেও পদচিহ্ন সংরক্ষণ করতে পারে।

আমরা বন্দী শিবিরে বাস করা আমাদের মতো যারা ছাউনির মধ্য দিয়ে হেটে হেটে অন্যদের সান্ত্বনা দিয়েছিল এমন লোকদের কথা স্মরণ করতে পারি। তারা অন্যের জন্য ছেড়ে দিয়েছিল তাদের শেষ রুটিটিও। হতে পারে তারা সংখ্যায় নগণ্য, কিন্তু তাদের এসব কর্মকাণ্ডের দ্বারা প্রমাণ হয় যে, মানুষের কাছ থেকে সবকিছুই কেড়ে নেওয়া যেতে পারে, একটি জিনিস ব্যতীত: তা হলো প্রদত্ত কোনো পারিপার্শ্বিকতা বা পরিবেশের মধ্যে নিজের মনোভাব কি রকম হওয়া উচিৎ তা নির্বাচন করার, কারো নিজের পথ বেছে নেওয়ার মানুষের স্বাধীনতা।

আর সেখানে সবসময়ই বিকল্প সিদ্ধান্ত গ্রহণের সুযোগ ছিল। প্রতিদিন, প্রতি ঘণ্টা কোনো না কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণের সুযোগ সৃষ্টি করেছিল। যেসব অপশক্তি আপনার একান্ত সত্ত্বাকে, আভ্যন্তরীণ মুক্তিকে আপনার কাছ থেকে হরণ করার হুমকি দেয় তার বাধ্য হবেন কি হবেন না তা নির্ধারণ করার সিদ্ধান্ত। সে সিদ্ধান্ত কয়েদিদের সাধারণ গতানুগতিক ধারার রূপ ধারণ করতে স্বাধীনতা আর মর্যাদা পরিত্যাগ করে নিজেকে পারিপার্শ্বিকতা বা পরিবেশের খেলনার বস্তু হবে কিনা তা নির্ধারণ করতো।

এই দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে, নির্দিষ্ট শারীরিক ও সমাজতাত্ত্বিক অবস্থার নিছক অভিব্যক্তির চেয়ে বন্দী শিবিরের কয়েদিদের মানসিক প্রতিক্রিয়া আমাদের কাছে আরও বেশি প্রতীয়মান হয়। যদিও ঘুমের অভাব, অপর্যাপ্ত খাবারের মতো অবস্থা এবং বহুবিধ মানসিক চাপ থেকে প্রতীয়মান হয় যে, কয়েদিরা নির্দিষ্ট কিছু উপায়ে প্রতিক্রিয়া করতে বাধ্য ছিল। চূড়ান্ত বিশ্লেষণে পরিষ্কার হয়ে উঠে যে, আভ্যন্তরীণ সিদ্ধান্তের ফলে একজন কয়েদি নির্দিষ্ট শ্রেণীর মানুষে পরিণত হয়, কেবল মাত্র শিবিরের প্রভাবের ফলে নয়। মৌলিকভাবে, অতএব, এরকম পারিপার্শ্বিকতা বা পরিবেশেও যে কোনো মানুষ মানসিকভাবে ও আধ্যাত্মিকভাবে তার পরিণতি কি হবে তার সিদ্ধান্ত নিতে পারে। এমনকি বন্দী শিবিরের মাঝেও সে ইচ্ছে করলে তার মানবিক মর্যাদা বজায় রাখতে পারে। রাশিয়ান উপন্যাসিক দার্শনিক ফয়ডর ডাফটাইয়েফস্কি একদা বলেছিলেন,“ আমি কেবলমাত্র একটি জিনিসকে ভয় করি: আমার যন্ত্রণার উপযুক্ত না হওয়া”। শিবিরে যাদের আচরণ, যাদের যন্ত্রণাভোগ ও মৃত্যু কোনো পারিপার্শ্বিকতা বা পরিবেশে নিজের মনোভাব কি রকম হওয়া উচিৎ তা নির্বাচন করার জন্য মানুষের আভ্যন্তরীণ স্বাধীনতা যে হারিয়ে যেতে পারে না সে সত্যের বিষয়ে সাক্ষ্য বহন করা শহীদদের সাথে পরিচয় হওয়ার পর থেকে একথাগুলি বার বার আমার মনে পড়তো। বলা যেতে পারে যে তারা তাদের যন্ত্রনাভোগের উপযুক্ত বা যোগ্য ছিল। যেভাবে তারা তাদের যন্ত্রণাকে সহ্য করেছিল তা ছিল এক অকৃত্রিম আভ্যন্তরীণ অর্জন। এই সেই আধ্যাত্মিক স্বাধীনতা যাকে হরণ করা সম্ভব নয়, যা জীবনকে করে তুলো অর্থবহ ও উদ্দেশ্যপূর্ণ।

সক্রিয় জীবন মানুষকে সৃজনশীল কর্মে তার মূল্যবোধকে অনুধাবনের সুযোগ প্রদানের লক্ষ্য সরবরাহ করে, যেখানে উপভোগের নিষ্ক্রিয় জীবন সৌন্দর্য, শিল্প, বা প্রকৃতিকে উপভোগের মাধ্যমে জীবনের পূর্ণতা লাভের সুযোগ প্রদান করে। কিন্তু অনেকটা সৃজনশীলতা আর উপভোগ বিবর্জিত জীবন ও যে জীবন এক উচ্চতর নৈতিক স্বভাবের সম্ভাবনাকে মেনে নেয় এমন জীবনেও লক্ষ্য-উদ্দেশ্য থাকে। সেই উচ্চতর নৈতিক স্বভাব হতে পারে বাহ্যিক শক্তি দ্বারা সীমাবদ্ধ জীবনের প্রতি কোনো মানুষের মনোভাব। একটি সৃজনশীল জীবন ও একটি উপভোগের জীবন তার জন্যে নিষিদ্ধ। কিন্তু কেবল সৃজনশীলতা আর উপভোগই অর্থবহ নয়। জীবনে যদি কোনো অর্থ থেকেই থাকে, তাহলে যন্ত্রণাভোগেও অবশ্যই কোনো অর্থ থাকতে হবে। যন্ত্রণা বা যন্ত্রণাভোগ জীবনের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ, নিয়তি আর মৃত্যুর ন্যায় মসৃণ। যন্ত্রণা আর মৃত্যু ছাড়া মানব জীবন অসম্পূর্ণ।

একজন মানুষ তার নিয়তি এবং এর সাথে অন্তর্ভুক্ত সকল যন্ত্রণাকে যেভাবে গ্রহণ করে, যেভাবে সে সবচেয়ে কঠিন পরিস্থিতিতেও তার কষ্টভোগকে কাঁদে তুলে নেয়, তা তাকে তার জীবনে গভীর অর্থ সংযুক্ত করার যথেষ্ট সুযোগ করে দেয়। জীবন তখনও এক সাহসী, মর্যাদাপূর্ণ ও স্বার্থহীন থাকতে পারে। নচেৎ আত্ম-সংরক্ষণের তিক্ত সংগ্রামে সে তার মানব মর্যাদা ভুলে গিয়ে একটি পশুর চেয়েও হীন কিছু হয়ে উঠতে পারে। কোনো কঠিন পরিস্থিতির দ্বারা সমর্থিত নৈতিক মূল্যবোধ অর্জনের সুযোগের সদ্ব্যবহার করবো, না বর্জন করব তাতেই একজন মানুষের সম্ভাবনা নিহিত। আর এটি সে যন্ত্রণাভোগের উপযুক্ত কিনা তার সিদ্ধান্ত দেয়।

মনে করবেন না যে এসব আলোচনা জগৎবহির্ভূত বা অপার্থিব আর বাস্তব জীবন থেকে অনেক দূরে। এটি সত্যি যে খুব কম মানুষই এরকম উচ্চতর নৈতিক মানদণ্ডে পৌঁছাতে সক্ষম। কয়েদিদের মাঝে কেবল কয়েকজন মানুষই তাদের পূর্ণ আভ্যন্তরীণ স্বাধীনতা ধরে রাখতে ও তাদের যন্ত্রণাভোগের দ্বারা আহুত মূল্যবোধকে অর্জন করতে পেরেছিল। কিন্তু মানুষের আভ্যন্তরীণ শক্তি যে তার বাহ্যিক পরিণতির/ভাগ্যের ঊর্ধ্বে উপনীত হতে পারে তার জন্য এরকম একটি উদাহরণই যথেষ্ট। এরকম মানুষ যে কেবলই শিবিরের মধ্যে রয়েছে তা নয়। যন্ত্রণাভোগের মধ্য দিয়ে কিছু অর্জনের সম্ভাবনা নিয়ে সর্বত্র মানুষকে তার পরিণতি বা ভাগ্যের মুখোমুখি হতে হয়।

অসুস্থ মানুষদের পরিণতির কথা ধরুন—বিশেষ করে দুরারোগ্য রোগে আক্রান্তদের। আমি একসময় এক পঙ্গু ব্যক্তির লিখা একটি চিঠি পড়েছিলাম যাতে তিনি তার এক বন্ধুকে বলেছিলেন যে তিনি আর বেশিদিন বাঁচবেন না, এমনকি কোনো অস্ত্রোপচারে তাতে কোনো লাভ হবে না। তিনি আরও লিখেছিলেন যে, তিনি এক চলচ্চিত্রে দেখেছিলেন একজন মানুষকে সাহসী আর মর্যাদাপুর্ণভাবে মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা করতে। ভালোভাবে মৃত্যুর সাক্ষাৎকে লোকটি এক বড় অর্জন বলে মনে করছিলেন তিনি। আর তিনি লিখেছিলেন যে নিয়তি তার জন্য এখন একই সুযোগ নিয়ে এসেছে। আমরা যারা কয়েক বছর আগে রাশিয়ান লেখক লিও টলস্টয়ের বই থেকে নেয়া Resurrection নামের চলচ্চিত্রটি দেখেছি তাদেরও হয়তো একই ভাবনা থাকতে পারে। তাতে আমরা মহান নিয়তি এবং মহান মানুষদের দেখতে পায়। আর সে সময় আমাদের জন্য ছিল না কোনো মহান নিয়তি বা ভাগ্য; ছিলনা এরকম মমত্ব অর্জনের সম্ভাবনাও। চলচ্চিত্রটি শেষ হওয়ার পর আমরা পার্শ্ববর্তী এক ক্যাফেতে গিয়েছিলাম, কফি আর স্যান্ডউইচ খেতে খেতে এক মুহূর্তের জন্য আমাদের মনে উদয় হওয়া অদ্ভুত আধ্যাত্মিক  ভাবনায় ডুবে গিয়েছিলাম। কিন্তু আমরা নিজেরা যখন এক মহান নিয়তির মুখোমুখি হয় এবং উপযুক্ত আধ্যাত্মিক মহত্ত্ব নিয়ে তা মুকাবিলা করার সিদ্ধান্তের মুখোমুখি হয়ে পড়ি, ততক্ষণে আমরা আমাদের অনেক আগের তারুণ্যপূর্ণ দৃঢ়তাকে ভুলে গিয়েছি, আর আমাদের জন্য ব্যর্থতা নেমে আসে অবধারিতভাবে।

সম্ভবত আমাদের কারো কারো জন্যে কোনো একদিন সে চলচ্চিত্রটি পুনরায় দেখার বা একই ধরনের অন্য কোন ছবি দেখার সুযোগ হয়েছিল। কিন্তু ততদিনে হয়তো অন্যান্য চলচ্চিত্রও কারও আভ্যন্তরীণ দৃষ্টির সামনে একই সময়ে উদ্ঘাটিত হয়ে পড়েছিল। কোনো আবেগপ্রবণ চলচ্চিত্র তুলে ধরতে সক্ষম এমন আবেগের চেয়ে, যেসব মানুষ তাদের জীবনে অনেক বেশি কিছু অর্জন করেছিল তাদের সম্পর্কে চলচ্চিত্র। বন্দী শিবিরে আমার স্বচক্ষে দেখা এক যুবতী মহিলার মৃত্যুর কাহিনীর ন্যায় কোনো ব্যক্তির আভ্যন্তরীণ মহত্ত্ব সম্পর্কে কিছু বিশদ বিবরণ হয়তো কারো মনে পড়ে যেতে পারে। এটি এক সাধারণ কাহিনী। এ সম্পর্কে তেমন কিছু বলার নেই আর মনে হবে যেন তা আমি উদ্ভাবন করেছি; তবে আমার কাছে তা একটি কবিতার মতো।

এই যুবতী মহিলা জানত পরবর্তী কয়েক দিনের মধ্যে সে মারা যাবে। কিন্তু আমি যখন তার সাথে কথা বলি তখন বুঝতে পারি যে, তা জানা সত্ত্বেও উৎফুল্ল ছিল। “আমি কৃতজ্ঞ যে নিয়তি আমাকে এত কঠোরভাবে আঘাত করেছে”, সে আমাকে বলেছিল। “আমার অতীত জীবনে আমি পথ-ভ্রষ্ট ছিলাম এবং আধ্যাত্মিক অর্জনকে আমি গুরুত্বতার সাথে দেখেনি”। ছাউনির জানালা দিয়ে ইশারা করে সে বলেছিল, “এই বৃক্ষটিই আমার একাকীত্বের একমাত্র বন্ধু”। সেই জানালার ভেতর দিয়ে সে কাঠবাদাম গাছটির একটি শাখা দেখতে পেতো, আর সে শাখায় ছিল দুটি ফুল। “আমি প্রায়শই এই বৃক্ষটির সাথে কথা বলি”, সে আমাকে বলেছিল। আমি হতবাক হয়ে পড়লাম ও কিভাবে তার কথাগুলি গ্রহণ করবো তা বুঝতে পারছিলাম না। সে কি তাহলে বিকারগ্রস্ত বা উন্মত্ত ছিল? তার কি মাঝে মাঝে দৃষ্টিভ্রম হতো? উদ্বেগের সাথে আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম বৃক্ষটি সাড়া দেয় কিনা। “হ্যাঁ” সে বলেছিল। বৃক্ষটি তাকে কি বলেছিল? “বৃক্ষটি আমাকে বলেছে, আমি এখানে আছি, আমি এখানে, আমি জীবন, অনন্ত জীবন”, সে উত্তর দিয়েছিল।

**********

আমরা আগেই বলেছি যে, বন্দীদের আভ্যন্তরীণ সত্তার অবস্থার জন্য চূড়ান্তভাবে মনস্তাত্ত্বিক কারণকে তেমনটা দায়ী করা যাবে না, যতটা না আমাদের স্বাধীন সিদ্ধান্তের ফলাফল তার জন্য দায়ী। কয়েদিদের উপর করা এক মনস্তাত্ত্বিক গবেষণা প্রমাণ করে যে, যারা তাদের নৈতিক এবং আধ্যাত্মিক সত্ত্বার উপর “আভ্যন্তরীণ দুর্গকে” (inner hold) প্রশমিত হতে দিয়েছিল কেবল তারাই অবশেষে শিবিরের অবক্ষয়জনিত প্রভাবের শিকার হয়েছিল। এখন প্রশ্ন আসে, কিসের উপাদানে এই “আভ্যন্তরীণ দুর্গের” সৃষ্টি হতে পারে বা হওয়া উচিৎ?

অতীতের বন্দীরা তাদের  অভিজ্ঞতা সম্পর্কে লিখতে গিয়ে একমত পোষণ করে বলে যে, একজন কয়েদিকে কতদিন বন্দীদশায় কাটাতে হবে তা জানতে না পারাটাই ছিল শিবিরের সবচেয়ে হতাশাজনক প্রভাব। তাকে অবমুক্তির কোনো তারিখ জানানো হতো না। আমাদের ক্যাম্পে তা নিয়ে কথা বলাটাই ছিল অর্থহীন। প্রকৃত অর্থে, কেবল কারাভোগই যে অনিশ্চিত ছিল তা নয় বরং তা ছিল অসীম। একজন বিখ্যাত মনস্তাত্ত্বিক গবেষক নির্ণয় করেছেন যে, বন্দী শিবিরের জীবনকে একটি provisional existence বা “অস্থায়ী অস্তিত্ব” বলা যেতে পারে। আমরা একে সংজ্ঞায়িত করতে যুক্ত করতে পারি “অজানা সময় অবধি অস্থায়ী অস্তিত্ব”।

নতুন আগন্তুকরা সাধারণত শিবিরের পরিস্থিতি সম্পর্কে কিছুই জানত না। যারা অন্য শিবির থেকে ফিরে আসতো তারা বাধ্য হয়েই নীরব থাকত, এবং কিছু কিছু শিবির থেকে কেউই আসতত না। শিবিরে প্রবেশের সময় লোকজনের মনে একটি পরিবর্ত অবস্থান নিতো। অনিশ্চয়তার সমাপ্তির সাথে আসে সমাপ্তির অনিশ্চয়তা। কখনও বা আদৌ এই অস্তিত্বের শেষ হবে কিনা তা অনুমান করা ছিল অসম্ভব। 

ল্যাটিন শব্দ finis এর দু’টি অর্থ রয়েছে: শেষ বা সমাপ্তি, এবং পৌঁছানোর কোনো লক্ষ্য। যে ব্যক্তি তার “অস্থায়ী অস্তিত্ব”র সমাপ্তি দেখতে পারেনি তার পক্ষে জীবনের কোনো চূড়ান্ত লক্ষ্যে স্থির হওয়া সম্ভব ছিলনা। স্বাভাবিক জীবনের তুলনায়, সে ভবিষ্যতের জন্য বেঁচে থাকার সমাপ্তি ঘটায়। তাতে, তার অভ্যন্তরীণ জীবনের পুরো অবকাঠামো পরিবর্তিত হয়ে যায়। অবক্ষয়ের চিহ্ন শুরু হয় যা আমরা জীবনের অন্যান্য ক্ষেত্র থেকে বুঝতে পারি। যেমন, একজন বেকার শ্রমিকও একই রকম অবস্থায় রয়েছে। তার অস্তিত্ব বা জীবন হয়ে উঠেছে অস্থায়ী এবং কোনো এক নির্দিষ্ট অর্থে সে আর ভবিষ্যতের জন্য বাঁচতে পারে না অথবা ভবিষ্যতের কোনো লক্ষ্যে স্থির থাকতে পারে না। কয়লাখনির বেকার শ্রমিকদের উপর করা গবেষণায় দেখা যায় যে, তারা এক অদ্ভুত ধরনের অভ্যন্তরীণ deformed time বা “বিকৃত সময়” ব্যাধি’তে ভুগে থাকে। যা তাদের বেকারত্ব অবস্থার পরিণতি। বন্দীরাও এই অদ্ভুত “সময় অভিজ্ঞতা” য় ভুগেছিল। শিবিরে, নির্যাতন আর অবসাদে ভর্তি সময়ের ক্ষুদ্র একক ঘণ্টাকে মনে হতো অন্তহীন সময়। সপ্তাহের মতো বৃহত্তর সময়ের একককে মনে হতো যেন খুব দ্রুতই শেষ হয়ে যাচ্ছে। কতই না প্যারাডক্সিকল বা স্ববিরোধী ছিল আমাদের “সময় অভিজ্ঞতা”! এ সম্পর্কে আমাদের টমাস ম্যান এর The Magic Mountain এর কথা স্মরণ করিয়ে দেয়।তাতে কিছু খুবই স্পষ্ট মনস্তাত্ত্বিক মন্তব্য রয়েছে। ম্যান স্বাস্থ্যনিবাস (sanatorium) এর যে সব রোগীরা তাদের অব্যাহতির তারিখ সম্পর্কে জানতো না এমন যক্ষ্মা রোগীদের মানসিক অবস্থার আধ্যাত্মিক উন্নয়ন নিয়ে গবেষণা করেন। তিনি লক্ষ্য করেন যে, তারাও একই রকম ভবিষ্যৎহীন ও লক্ষ্যহীন এক অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে দিন কাটায়।

একজন কয়েদি আগমনের পর যে নতুন আগতদের দীর্ঘ সারিতে স্টেশন থেকে শিবিরে কুচকাওয়াজ করেছিল, সে পরে আমাকে জানায় যে কুচকাওয়াজ করার সময় তার মনে হয়েছিল যেন সে তার নিজের অন্ত্যোষ্টিক্রিয়ার দিকে হেঁটে যাচ্ছিল। তার কাছে তার জীবনকে একেবারেই ভবিষ্যৎহীন মনে হয়েছিল। সে ভেবেছিল তার ভবিষ্যৎ শেষ হয়ে গেছে, যেন তার ইতিমধ্যেই মৃত্যু হয়েছে। জীবনহীনতার এই অনুভুতি অন্যান্য কারণেও তীব্রতর হয়েছিল: সময়ের বেলায় (time), তা ছিল কারাবন্দী সময়ের সীমাহীনতা যা তারা খুব তীব্রভাবে অনুভব করতো। অবস্থানের বেলায় (space), তা ছিল কারাগারের সংকীর্ণ পরিসর। কাঁটাতারের বাইরে যেকোনো কিছুই তাদের কাছে  বিচ্ছিন্ন আর নাগালের বাইরে মনে হত। আর তা কোন না কোনোভাবে অবাস্তব হয়ে উঠেছিল। শিবিরের বাইরের জীবন যাপন একজন মানুষ যতদূর দেখতে পায় তার কাছে তা অনেকটা একজন মৃত মানুষের কাছে আবির্ভূত হওয়ার ন্যায় আবির্ভূত হতো। তার কাছে মতো হতো সে যেন অন্য জগত থেকে তার দিকে তাকিয়ে আছে। 

একজন মানুষ, যে নিজের ভবিষ্যৎ দেখতে পায়না বলে নিজেকে অবক্ষয়ের দিকে ঠেলে দেয়, সে নিজেকে অতীত ঘটনা প্রবাহের ভাবনায় নিজেকে ব্যস্ত রাখে। অন্য এক অর্থে, সমস্ত ভয়াবহতা সত্ত্বেও বর্তমানকে কম বাস্তবিক করে তুলতে কয়েদিদের অতীতের মাঝে ফিরে যাওয়ার প্রবণতার কথা আমরা আগেই বলেছি। কিন্তু বর্তমানকে বঞ্চিত বাস্তবতা করার মাঝে এক বিপদও রয়েছে। শিবির জীবন থেকে ইতিবাচক কিছু সৃষ্টির অনেক সুযোগকে উপেক্ষা করা সহজ হয়ে গিয়েছিল। আমাদের “অস্থায়ী অস্তিত্ব বা জীবন” যেমন ছিল অবাস্তব, তেমনি তা ছিল কয়েদিদের জীবনের উপর নিয়ন্ত্রণ হারানোর ক্ষেত্রে এক গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। এক পর্যায়ে সবকিছুই একপ্রকার অর্থহীন হয়ে উঠেছিল। এ ধরনের লোকজন ভুলে যায় যে, কেবল এরকম  বিশেষ কোনো কঠিন বাহ্যিক পরিস্থিতিই একজন মানুষকে আধ্যাত্মিকভাবে নিজেকে ছাড়িয়ে বেড়ে উঠার সুযোগ প্রদান করে। শিবিরের অসুবিধা সমূহকে নিজেদের আভ্যন্তরীণ শক্তির পরীক্ষা হিসেবে নেওয়ার পরিবর্তে, তারা তাদের জীবনকে গুরুত্বতার সাথে না নিয়ে পরিণতিহীন কোনো বস্তুর মতো জীবনকে অবহেলা করেছে। চোখ বন্ধ করে অতীতে বাস করাকে তারা শ্রেয় মনে করেছিল। এরকম মানুষের কাছে জীবন হয়ে উঠেছিল অর্থহীন।

স্বভাবতই কেবল কয়েকজন মানুষ-ই মহানতর আধ্যাত্মিক উচ্চতায় পৌছতে সক্ষম ছিল। কিন্তু কয়েকজনকেই তাদের কাছে প্রতীয়মান জাগতিক ব্যর্থতা আর মৃত্যুর মাধ্যমে মানব মহত্ত্ব অর্জনের সম্ভাবনা প্রদান করা হয়েছে। এটি এমন একটি অর্জন যা সাধারণ কোনো পরিস্থিতিতে তারা কখনই অর্জন করতো না। আমাদের মাঝে অন্যান্য সাধারণ এবং দুর্বলচিত্তের মানুষের জন্য জার্মান কূটনৈতিক বিসমার্কের কথাটি বলা যেতে পারে। তিনি বলেছিলেন, “জীবন দন্তচিকিৎসকের কাছে যাওয়ার মতো। আপনি সবমসময় ভাবেন যে হয়তো মন্দটা এখনো বাকি আছে, এবং তারপরও ইতিমধ্যে তার সমাপ্ত হয়েছে।” এর পরিবর্তে, আমরা বলতে পারি যে, বন্দী শিবিরের অধিকাংশ মানুষ বিশ্বাস করেছিলো যে, তাদের জীবনের প্রকৃত সুযোগ শেষ হয়ে গেছে। তবুও, সত্যিকার অর্থে জীবনের সুযোগ আর প্রতিবন্ধকতা উভয়ই সেখানে  ছিল। জীবনকে এক আভ্যন্তরীণ বিজয়ে পরিবর্তন করার মাধ্যমে একজন মানুষ সেইসব অভিজ্ঞতা থেকে বিজয়ের জন্ম দিতে পারে, বা একজন মানুষ প্রতিবন্ধকতাকে উপেক্ষা করতে ও পুরোপুরিভাবে নীরস জীবন-যাপন করতে পারে, যেমনটি অধিকাংশ কয়েদি করেছিলো।

********

শিবিরে সাইকোথেরাপিউটিক বা মনস্তাত্ত্বিক চিকিৎসা বা সাইকোহাইজিনিক বা মানসিক স্বাস্থ্যবিধি পদ্ধতির মাধ্যমে একজন কয়েদির সাইকোপ্যাথলজিক্যাল (বা মানসিক ব্যাধির) প্রভাবকে দমনের যে কোনো প্রচেষ্টার উদ্দেশ্য ছিল তাকে বাস্তবে পরিণত করতে পারে এমন কোনো ভবিষ্যৎ লক্ষ্য প্রদানে মাধ্যমে অভ্যন্তরীণ শক্তি সরবরাহ করা। স্বভাবতেই, কোনো কোনো কয়েদী নিজে নিজেই তার সন্ধান পাওয়ার চেষ্টা করেছিল। মানুষের একটি বিশেষত্ব হলো সে কেবলমাত্র ভবিষ্যতের পানে চেয়ে বাচতে পারে। আর তার কঠিন অস্তিত্বের মুহূর্তে এটিই তার মুক্তি, যদিও মাঝে মাঝে তাকে কর্মে তার মনকে বাধ্য করাতে হয়।

আমার এক ব্যক্তিগত অবিজ্ঞতার কথা মনে পড়ে। ছেঁড়া জুতো পরার কারণে আমার পায়ে ভয়ানক ক্ষতের সৃষ্টি হওয়ার কারণে ব্যথার ছোড়ে প্রায় অশ্রুসিক্ত অবস্থায় মানুষের দীর্ঘ সারিতে আমাদের কাজের স্থল থেকে শিবির পর্যন্ত কয়েক কিলোমিটার পথ আমি খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলেছিলাম। পথিমধ্যে খুবই ঠাণ্ডা আর তীব্র হাওয়া আমাদের তাড়িত করেছিল। তখন আমাদের দুর্দশাগ্রস্ত জীবনে ছোট ছোট অসংখ্য সমস্যা নিয়ে আমি চিন্তা মগ্ন ছিলাম। যেমন, আজ রাতে খাওয়ার জন্য কি থাকতে পারে? একখানা সচেজ যদি বাড়তি বরাদ্দ হিসেবে আসে, একটুকরো রুটি জন্য কি আমার তার বিনিময় করা উচিৎ হবে? পনের দিন আগে গ্রহণ করা বোনাস থেকে বেছে যাওয়া আমার সর্বশেষ সিগারেটটি আমি এক বাটি স্যুপের সাথে বিনিময় করবো? আমার জুতোর ফিতা হিসেবে ব্যবহৃত হওয়া তারের টুকরোটি প্রতিস্থাপনের জন্য কিভাবে আমি একটুকরো তার পেতে পারি? আমার চলতি কাজের আসরে যোগ দেওয়ার জন্য আমি কি ঠিক সময়ে আমাদের কাজের স্থানে পৌঁছাতে পারব, বা আমাকে কি অন্য দলে যোগ দিতে হবে, যাতে থাকতে পারে এক নির্দয় দল-প্রধান? ক্যাপুদের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ ভাব বজায় রাখতে আমি কি করতে পারি, যারা আমাকে শিবিরে প্রতিদিন ভয়ানকভাবে দীর্ঘ দৌড়ের দায়িত্ব নেওয়ার পরিবর্ত কাজ পেতে সাহায্য করতে পারে? এসব চিন্তা।

প্রতিদিন আর প্রতি ঘণ্টায় এরকম তুচ্ছ বস্তুর বিষয়ে ভাবতে বাধ্য করা এমন পরিস্থিতির সাথে আমি বিতৃষ্ণা হয়ে উঠেছিলাম। আমি আমার ভাবনাকে অন্য বিষয়ের প্রতি মনোনিবেশে বাধ্য করেছিলাম। ভাবতে ভাবতে হঠাৎ আমি নিজেকে এক আলো-প্রজ্বলিত ও মনোরম লেকচার কক্ষের প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখি। আমার সামনে আরামদায়ক পরিশোভিত আসনে বসে আছে মনোযোগী দর্শকেরা। তখন আমি বন্দী শিবিরের মনস্তত্ত্বের বিষয়ে শিক্ষা দিচ্ছিলাম! আমাকে নিপীড়ন করা সবকিছুই সেই মুহূর্তে বস্তুগত হয়ে উঠেছিল। বিজ্ঞানের পরোক্ষ দৃষ্টিকোণ থেকে আমি সেসব লক্ষ্য ও বর্ণনা করেছিলাম। এই পদ্ধতির মাধ্যমে কষ্টকর পরিস্থিতি, মুহূর্তের যন্ত্রণাভোগের ঊর্ধ্বে উঠতে আমি সফল হয়েছিলাম। আর আমি লক্ষ্য করেছিলাম যে সেসব যন্ত্রনাভোগ যেন ইতিমধ্যেই অতীত হয়ে গেছে। আমি আর আমার যন্ত্রণা উভয়েই আমার করা আকর্ষণীয় মনো-বৈজ্ঞানিক বা psychoscientific গবেষণার অংশে পরিণত হয়। নীতিবিদ্যায় স্পিনোযা কি বলেন? তিনি বলেন- Emotion, which is suffering, ceases to be suffering as soon as we form a clear and precise picture of it. (“যখনই আমরা যন্ত্রনার বিষয়ে পরিষ্কার এবং সুনির্দিষ্ট চিত্র গঠন করি তখন তা আর যন্ত্রণা থাকে না”।)

*******

ভবিষ্যতের উপর আশা হারিয়ে ফেলা কয়েদিদের নিয়তি নির্ধারণ হয়ে যেতো। ভবিষ্যতের উপর তার আশা হারিয়ে কয়েদিরা তাদের আধ্যাত্মিক নিয়ন্ত্রণও হারিয়ে ফেলতো। এভাবে তারা  নিজেদের অবক্ষয়ের দিকে ঠেলে দিতো এবং মানসিক ও শারীরিক অবক্ষয়ের বস্তুতে পরিণত হতো। সাধারণত তা হঠাৎ করেই ঘটে থাকতো, কোনো সংকটের রূপে। তার উপসর্গ ক্যাম্পের অভিজ্ঞ কয়েদিদের কাছে পরিচিত ছিল। আমরা সবাই এই মুহূর্তটাকে ভয় পেতাম–নিজেদের জন্য নয়, কারণ নিজেদের জন্য ভয় পাওয়া অর্থহীন। বরং আমরা আমাদের বন্ধুদের জন্যই ভয় পেতাম। সাধারণত তা কোনো এক সকালে কোনো কয়েদির কাপড় পরতে, গোসল করতে বা কুচকাওয়াজ মাঠে যাওয়ার অস্বীকৃতি জানানো থেকে শুরু হত। কোনো অনুনয়-বিনয়, কোনো মারধর, কোনো হুমকি তাতে কাজ হত না। সে কেবলই সেখানে পড়ে রইত, তেমন নাড়াচাড়া না করে। এই সংকট যদি কোনো ধরনের অসুস্থতার কারণে হয়ে থাকত, তবে তারা অসুস্থদের কোয়ার্টারে যেতেও অস্বীকৃতি জানাত বা অস্বীকৃতি জানাত নিজেদের সাহায্যার্থে কোনো কিছু করতে। সে নিতান্তই আশা ছেড়ে দিয়েছে। আর সে জন্যে সে কেবলই তার মল-মূত্রের উপর শুয়ে থাকত, আর কোনো কিছুই তাকে আর বিরক্ত করতে পারতো না।

আমি নিজেই এক সময় ভবিষ্যতের উপর আশা/প্রত্যাশা হারিয়ে ফেলা এবং এই বিপজ্জনক আশা ছেড়ে দেওয়ার মাঝে ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের এক নাটকীয় দৃশ্য দেখতে পেয়েছিলাম। আমার সিনিয়র ওয়ার্ডেন মিঃ এফ., যিনি ছিলেন একজন মোটামুটি সু-পরিচিত সুরকার এবং রচনা লেখক, তিনি একদিন আমাকে গোপনে বলেছিলেন, “আমি তোমাকে কিছু বলতে চাই, ডাক্তার সাহেব। আমি এক অদ্ভুত স্বপ্ন দেখেছি। এক কণ্ঠস্বর এসে আমাকে বলেছিল যে আমি তার কাছে কোনো কিছু চাইতে পারি। কোনো কিছু জানতে চাইলে আমি যেন তাকে প্রশ্ন করি, সে আমার সকল প্রশ্নের উত্তর দেবে। তোমার কি মনে হয় আমি তার কাছে কি চেয়েছিলাম? আমি জানেতে চেয়েছিলাম কবে আমার জন্য যুদ্ধের সমাপ্তি হবে। তুমি জানো আমি ‘আমার জন্য’ বলতে কি বোঝাতে চেয়েছি, ডাক্তার সাহেব! আমি জানতে চেয়েছিলাম কবে আমরা শিবির মুক্ত হবো এবং আমাদের কষ্টের শেষ হবে।

কবে আপনি এ স্বপ্ন দেখেছেন? আমি প্রশ্ন করলাম।

“ফেব্রুয়ারিতে, ১৯৪৫”, তিনি উত্তর দিলেন। যখন তিনি আমাকে তার স্বপ্নের কথা বলেছিলেন তখন ইতিমধ্যে মার্চ মাস ছিল।

আপনার স্বপ্নের কণ্ঠস্বর কি উত্তর দিয়েছে?

চুপিসারে তিনি আমাকে বলেছিলেন, “৩০শে মার্চ”।

মিঃ এফ. যখন আমাকে তার স্বপ্নের ব্যাপারে বলেছিলেন, তখনও তিনি ছিলেন প্রত্যাশায় পূর্ণ এবং দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করেছিলেন যে তার স্বপ্নের কথা সত্যি হবে। কিন্তু স্বপ্নের সেই দিনটি কাছাকাছি আসলে আমাদের কানে আসা যুদ্ধের খবর থেকে বুঝতে পারি যে, স্বপ্নের সেই দিনেই আমরা মুক্ত হবো। ২৯শে মার্চ মিঃ এফ. হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন এবং উচ্চ তাপমাত্রার জর উঠে। ৩০শে মার্চ, তার ভবিষ্যদ্বাণীর দিন তাকে জানিয়ে দিয়েছিল যে তার জন্য যুদ্ধ ও কষ্টভোগ শেষ হয়ে যাবে, তিনি বিকারগ্রস্ত হয়ে পড়ে জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিলেন। ৩১মে মার্চ তিনি মারা যান। বাহ্যিক সকল হাবভাব থেকে বোঝা গেলো যে তিনি টাইফাস রোগে মারা গিয়েছিলেন।

*******

যারা একজন মানুষের মানসিক অবস্থার সাথে তার দেহের রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতার কতোটা ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে তা জানে, তারা বুঝতে পারবে আকস্মিকভাবে আশা ও সাহস হারিয়ে ফেলাটা স্বাস্থ্যের উপর কতটা মারাত্মক প্রভাব ফেলতে পারে। আমার বন্ধু মিঃ এফ’র মৃত্যুর চূড়ান্ত কারণ ছিল যে তার প্রত্যাশিত মুক্তি আসেনি আর যে কারণে সে মারাত্মকভাবে হতাশ হয়ে পড়েছিল। তা আকস্মিকভাবে টাইফাস সংক্রমণের বিরুদ্ধে তার দেহের প্রতিরোধ ক্ষমতাকে কমিয়ে দিয়েছিল। ভবিষ্যতের উপর তার বিশ্বাস এবং বেঁচে থাকার ইচ্ছা পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়ে পড়ে ও তার দেহ হয়ে পড়ে অসুস্থতার শিকার—আর এভাবেই তার স্বপ্নে কণ্ঠস্বর সত্যি হয় অবশেষে।

এই একটি ঘটনার উপর ফলাফল আমাদের শিবিরের প্রধান চিকিৎসক কর্তৃক পর্যবেক্ষণ করা ও তার অর্জিত ফলাফল আমার মনোযোগ আরক্ষণ করেছিল। ১৯৪৪ সালের বড়দিন আর ১৯৪৫ সালে নববর্ষের মধ্যে শিবিরের পূর্ববর্তী সব অভিজ্ঞতাকে ছাড়িয়ে মৃত্যুর হার বেড়ে গিয়েছিল। তার মতে, মৃত্যুর হার বেড়ে যাওয়ার পেছনে কাজের কঠিন পরিস্থিতি দায়ী ছিল না। অথবা দায়ী ছিলনা আমাদের খাদ্য সরবরাহের গুনগত বা পরিমাণগত অবনতিও অথবা কোনো আবহাওয়া পরিবর্তন বা নতুন কোনো মহামারি। অধিকাংশ কয়েদি যারা বড়দিনের মধ্যে পুনরায় বাড়িতে থাকতে পারবে এই অতি সরল প্রত্যাশায় জীবন-যাপন করেছিল। আর এই সরল প্রত্যাশাই তাদের মৃত্যুর কারণ ছিল। সময় ঘনিয়ে আসলে এবং উৎসাহমূলক কোনো খবর না পেয়ে বন্দীরা তাদের উৎসাহ হারিয়েছিল আর হতাশা তাদের পরাস্ত করেছিল। আর তাতে তাদের প্রতিরোধ ক্ষমতায় এক ক্ষতিকর প্রভাব পড়ে। যার কারণে তাদের একটি বড় সংখ্যক মানুষ মৃত্যুবরণ করেছিল।

আমরা যেমনটি আগেই বলেছি, ক্যাম্পে একজন মানুষের আভ্যন্তরীণ শক্তির পদস্থাপনের যেকোনো প্রচেষ্টাই ছিল প্রথমে তাকে ভবিষ্যতের কোনো লক্ষ্য প্রদর্শনে সফল হওয়া। ফ্রেড্রিক নিৎসের, “ যার কেন বেঁচে থাকতে হবে তার কারণ রয়েছে সে প্রায় যে কোন উপায়ই সহ্য করতে সক্ষম ” কথাটি কয়েদিদের সম্পর্কে সকল সাইকোথেরাপিউটিক বা মনস্তাত্ত্বিক চিকিৎসা বা সাইকোহাইজিনিক বা মানসিক স্বাস্থ্যবিধির পথনির্দেশক মূলমন্ত্র হতে পারে। যখনই তার সুযোগ হতো কাউকে না কাউকে কয়েদিদের তাদের জীবনের জন্য একটি ‘কেনো’র মাধ্যমে কোনো লক্ষ্য প্রদান করতে হতো, যাতে তারা তাদের অস্তিত্বের ভয়াবহ ‘কিভাবে’ কে সহ্য করার শক্তিশালী হয়ে উঠতে পারে। আফসোস তার জন্য, যে তার জীবনে কোনও অর্থ দেখতে পায়নি। লক্ষ্যহীন, উদ্দেশ্যহীন, অতএব বেঁচে থাকার মানে হয় না। সে সহসাই কালের গহ্বরে হারিয়ে গিয়েছিল। যে সাধারণ উত্তরের মাধ্যমে একজন মানুষ সকল প্রেরণামূলক বিতর্ককে প্রত্যাখ্যান করতো তা ছিল, “আমার জীবন থেকে প্রত্যাশা করার মতো আর কিছুই নেই“। একজন মানুষ তাতে কি উত্তর দিতে পারে?

প্রকৃতপক্ষে আমাদের যা দরকার ছিল তা হলো জীবন সম্পর্কে আমাদের মনোভাবের এক আমূল বা মৌলিক পরিবর্তন। সর্বোপরি, আমাদের নিজেদের শিখতে হয়েছিল, এবং হতাশ লোকদের আমাদের শেখাতে হয়েছিল যে, প্রকৃত অর্থে আমরা জীবন থেকে কি প্রত্যাশা করেছি তা কোনো বিষয় নয়, বরং জীবন আমাদের কাছ থেকে কি প্রত্যাশা করেছিল তাই আসল বিষয়। জীবনের অর্থ সম্পর্কে প্রশ্ন করা আমাদের থামিয়ে দিতে হয়েছিল, বরং প্রতিদিন আর প্রতি ঘণ্টায় নিজেদেরকে আমাদের জীবন দ্বারা প্রশ্নবিদ্ধ মানুষ হিসেবে ভাবতে হয়েছিল। আমাদের উত্তর আলাপচারিতায় আর ধ্যানের মধ্যে নিহিত ছিল না, বরং তা নিহিত ছিল আমাদের সঠিক কর্ম আর সঠিক আচরণে। অবশেষে, জীবন মানে জীবনের সমস্যা সমাধানের সঠিক উত্তর খুঁজে বের করার দায়বদ্ধতা গ্রহণ করা এবং প্রতিটি মানুষের জন্য জীবন ক্রমাগতভাবে যে কাজ স্থাপন করে তা পরিপূর্ণ করা। তাই এইসব কাজ, আর জীবনের অর্থ একেকজন মানুষের কাছে একেকরকম, এবং ভিন্ন মুহূর্তে ভিন্ন রকম হয়ে থাকে। তাই সাধারণভাবে জীবনের অর্থ বা মানে সংজ্ঞায়িত করা অসম্ভব। জীবনের অর্থ বা মানে সম্পর্কে প্রশ্নের উত্তর কখনোও সুদূরপ্রসারী উক্তি দ্বারা দেওয়া সম্ভব নয়। ‘জীবন’ মানে অনিশ্চিত কোনো কিছুকে বোঝায় না, কিন্তু খুবই বাস্তব আর মূর্ত কোনো কিছুকে বোঝায়, ঠিক যেমন জীবনের কাজও খুবই বাস্তব আর মূর্ত। এসব কাজ মানুষের নিয়তিকে গঠন করে, যা প্রতিটি মানুষের জন্য ভিন্ন আর অনুপম। কোনো ব্যক্তি আর কোনো নিয়তি বা গন্তব্যকে অন্য কোনো ব্যক্তির সাথে বা অন্য কোনো গন্তব্যের সাথে তুলনা করা যাবে না। কোনো পরিস্থিতিরই পুনরাবৃত্তি হয় না, তাই প্রতিটি পরিস্থিতিই ভিন্ন ভ্ন্নি প্রতিক্রিয়ার দাবি রাখে। মাঝে মাঝে একজন মানুষ নিজেকে যে পরিস্থিতিতে আবিষ্কার করে তাতে হয়তো কর্মের দ্বারা তার নিজের নিয়তি নির্ধারণের দরকার হয়। মাঝে মাঝে গভীর চিন্তা ও এভাবে তার গুণাবলিকে উপলব্ধির জন্য কোনো সুযোগের সদ্ব্যবহার তার জন্য অধিকতর সুবিধাজনক। মাঝে মাঝে একজন মানুষকে সাদাসিধেভাবে তার নিয়তিকে গ্রহণ করার প্রয়োজন হয়, প্রয়োজন হয় তার যন্ত্রণা বহন করার। প্রতিটি পরিস্থিতিই তার অনন্যতার দরুন স্বতন্ত্র, এবং আসন্ন পরিস্থিতির দ্বারা সৃষ্টি সমস্যার জন্য সব সময় কেবল একটি সঠিক উত্তরই থাকে।

একজন মানুষ যখন বুঝতে পারে যে যন্ত্রণাভোগই তার নিয়তি, তখন তার একক আর অনুপম কাজ হিসেবে তাকে তা গ্রহণ করতে হবে। তাকে স্বীকার করে নিতে হবে যে এমনকি যন্ত্রণাভোগের মাঝেও ব্রহ্মাণ্ডে সে অনুপম বা স্বতন্ত্র এবং একক। কেউই তাকে যন্ত্রনাভোগ থেকে উদ্ধার করতে পারে না বা তার স্থলে অন্য কেউ তার নিজের যন্ত্রণাভোগ করতে পারে না। যেভাবে একজন মানুষ তার কষ্টকে বহন করে তাতেই তার স্বতন্ত্র বা অনুপম সুযোগ অন্তর্ভুক্ত।

কয়েদী হিসেবে আমাদের বেলায় এসব ভাবনা সমূহ বাস্তবতার অনুমান থেকে দুরে ছিলনা। কেবল সেসব ভাবনাই আমাদের কাজে লাগতো। সেসব ভাবনা আমাদের হতাশা থেকে দূরে রেখেছিল, এমনকি যখন শিবির থেকে জীবিত বের হওয়ার কোনো সম্ভাবনা ছিল না বলে মনে হতো তখনও। জীবনের অর্থ কি তা প্রশ্ন করার স্তর আমরা অনেক আগেই পার করে এসেছি। এটি একটি সরল প্রশ্ন যা জীবনকে মূল্যবান কিছুর সক্রিয় সৃষ্টির মাধ্যমে কোনো লক্ষ্য অর্জন হিসেবে বোঝানো হয়। আমাদের বেলায়, জীবনের অর্থ জীবন-মৃত্যুর, যন্ত্রণাভোগের এবং মরণের বিস্তৃত চক্রের সাথে জড়ানো ছিল।

যখনই যন্ত্রণাভোগের অর্থ আমাদের কাছে প্রকাশিত হলো, আমরা শিবিরের  অবজ্ঞা বা মিথ্যা মোহের আশ্রয়ে এবং কৃত্রিম আশাবাদ পোষণ করে নির্যাতনকে হ্রাস বা প্রশমিত করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছিলাম। যন্ত্রণা বা যন্ত্রণাভোগ আমাদের তরে হয়ে ওঠে এক কর্ম যা থেকে  আমরা পিছপা হয়নি। সাফল্যের জন্য আমরা যান্ত্রণাভোগের গোপন সুবিধা সমূহ অনুধাবন করতে পেরেছিলাম। যে সুবিধা সম্পর্কে অস্ট্রিয়ার কবি মারিয়া রীলকে লিখেছিলেন, Wie viel ist aufzuleiden! সফল হওয়ার জন্য কতটা যন্ত্রণা সহ্য করতে হয়! (How much suffering there is to get through!) রীলকে “যন্ত্রণা সহ্য করা বা যন্ত্রণায় সফল হওয়া” সম্পর্কে বলেছিলেন, যেমনটি অন্যরা যন্ত্রণার চেয়ে “কাজকে সহ্য করা” র কথা বলতো। আমাদের মাঝে সহ্য করার জন্য প্রচুর যন্ত্রণা ছিল। অতএব, দুর্বলতা আর লুকিয়ে কান্না করার মুহূর্তগুলিকে সর্বনিম্ন পর্যায়ে রাখার প্রচেষ্টার মাধ্যমে সম্পূর্ণ অর্থে যন্ত্রণার মুখোমুখি হওয়া প্রয়োজন ছিল। তবে চোখের জল নিয়ে লজ্জা পাওয়ার কোনো প্রয়োজন ছিলনা, কারণ চোখের জল মানে একজন মানুষের সর্বাধিক সাহস থাকা, যন্ত্রণাভোগের সাহস। কেবল কয়েকজন মানুষই তা অনুধাবন করতে পেরেছিল। কিভাবে তার ইডেমা রোগ থেকে মুক্তি পেয়েছিল সে প্রশ্নে একজন কর্মী তার স্বীকারোক্তি দিয়ে আমাকে বলেছিল, “আমি কেঁদে কেঁদে তা আমার অন্ত্র থেকে বের করে দিয়েছিলাম”। তার মতো কখনো সখনো লজ্জিত মুখে কেউ কেউ তাদের গোপন কান্নার কথা স্বীকার করতো আমার কাছে।

*********

সম্ভব হলে সাইকোথেরাপিউটিক বা মনস্তাত্ত্বিক চিকিৎসা বা সাইকোহাইজিনিক বা মানসিক স্বাস্থ্যবিধির সূক্ষ্ম আরম্ভ ছিল স্বভাবতই হয় ব্যক্তিগত না হয় সমষ্টিগত। অনেক সময় ব্যক্তিগত সাইকোথেরাপিউটিক বা মনস্তাত্ত্বিক চিকিৎসা প্রচেষ্টা ছিল এক রকম “জীবনরক্ষা প্রক্রিয়া”। এসব প্রচেষ্টা সাধারণত কয়েদিদের আত্মহত্যাকে প্রতিরোধের সাথে সম্পৃক্ত ছিল। শিবিরের কঠোর নিষেধাজ্ঞা অনুযায়ী আত্মহত্যা করতে চেষ্টা করা এমন কাউকে বাঁচানোর প্রচেষ্টা ছিল নিষিদ্ধ। উদাহরণ সরূপ বলা যেতে পারে, নিজেকে ঝুলানোর চেষ্টা করছে এমন কাউকে গাছ কেটে নামিয়ে আনা নিষিদ্ধ ছিল। তাই এধরনের আত্মহত্যার প্রচেষ্টা সংঘটিত হওয়াকে ব্যাহত করা খুবই জরুরী ছিল।

সম্ভাব্য দুটি আত্মহত্যার ঘটনার কথা আমার মনে পড়ে, যার প্রতিটি ঘটনাই এক লক্ষণীয় সাদৃশ্যতা ছিল। উভয় ব্যক্তিই তাদের আত্মহত্যা করার উদ্দেশ্য সম্পর্কে আমাকে বলেছিল। উভয়েই স্বাভাবিক যুক্তি উপস্থাপন করে বলেছিল যে – জীবন থেকে প্রত্যাশা করার তাদের কিছুই ছিল না। উভয় ঘটনায় জীবন যে তাদের কাছ থেকে এখনও কিছু প্রত্যাশা করছে তা অনুধাবন করিয়ে দেওয়াই ছিল আসল প্রশ্ন। তাদের বুঝিয়ে দেওয়া যে ভবিষ্যতে তাদের কাছ থেকে কিছু প্রত্যাশা করার মতো রয়েছে। বস্তুত, আমরা উদ্ঘাটন করতে পেরেছিলাম যে, একজনের জন্য তার ছেলেই ছিল আত্মহত্যা চেষ্টার কারণ। যে ছেলে সে অত্যন্ত পছন্দ করতো ও যে তার জন্য এক ভিন্ন দেশে অপেক্ষা করছিল। অন্য একজনের ক্ষেত্রে আত্মহত্যা চেষ্টার কারণ ছিল একটি বস্তু, কোনো ব্যক্তি নয়। সেই লোকটি ছিলেন একজন বিজ্ঞানী যে কয়েকটি বইও লিখছিলেন যা তখনও অসমাপ্ত ছিল। অন্য কাউকে দিয়ে যেমন তার কাজ শেষ করা যাবে না, তেমনি সন্তানের ভালবাসায় একজন পিতার স্থান অন্য কেউ কখনও নিতে পারে না।

এই স্বতন্ত্রতা এবং এককত্ব যা প্রত্যেক ব্যক্তিকে আলাদা করে ও তার জীবনের অর্থ প্রদান করে, সৃজনশীল কর্মে তার তাৎপর্য রয়েছে, যতটা তাৎপর্য রয়েছে মানব ভালবাসায়। যখন কোনো ব্যক্তির স্থানে অন্য কোন ব্যক্তিকে স্থলাভিষিক্ত করার অসম্ভাবনাকে উপলব্ধি করা হয়, তখন তা একজন মানুষের জীবনের জন্য এবং এর ধারাবাহিকতা রক্ষার জন্য থাকা দায়বদ্ধতাকে সকল মাত্রায় আবির্ভাবের অনুমতি দেয়। যে ব্যক্তি স্নেহশীলভাবে তার জন্য অপেক্ষায় থাকা এমন একজন মানুষের জন্য সহ্য করা দায়বদ্ধতা সম্পর্কে সচেতন হয়ে উঠে, বা যে ব্যক্তি তার অসমাপ্ত কাজের অপেক্ষায় থাকে সে কখনও তার জীবনকে বিনষ্ট করতে দেবে না। সে তার অস্তিত্বের পেছনে “why” বা “কেনো” সম্পর্কে অবগত থাকে, আর প্রায় যেকোনো “how” বা “কিভাবে” বা উপায়কে সহ্য করতে সমর্থ হয়।

******

শিবিরে সমষ্টিগত সাইকোথেরাপিউটিক বা মনস্তাত্ত্বিক চিকিৎসার সুযোগ তার ছিল সাধারণত সীমিত। কথার চেয়ে যথাযথ উদাহরণ ছিল অধিকতর কার্যকর। যে সিনিয়র ওয়ার্ডেনটি কর্তৃপক্ষের পক্ষ নেয়নি তার ন্যায়পরায়ণ আর উৎসাহমূলক আচরণের মাধ্যমে তার এখতিয়ারের অধিনে থাকা ব্যক্তিদের উপর সুদূরপ্রসারী নৈতিক প্রভাব বিস্তারের হাজার খানেক সুযোগ ছিল। আচরণের তাৎক্ষনিক প্রভাব সব সময়ই কথার চেয়ে কার্যকর। কিন্তু মাঝে মাঝে কথাও কার্যকর ছিল, যখন মানসিক গ্রহনযোগ্যতা বাহ্যিক পরিপার্শিকতার দ্বারা তীব্রতর হত। একটি ঘটনার কথা আমি স্মরণ করতে পারি যখন পুরো ছাউনির বাহ্যিক এক পরিস্থিতির কারণে কয়েদিদের মানসিক গ্রহনযোগ্যতা তীব্রতর হওয়ার কারণে সাইকোথেরাপিউটিক বা মনস্তাত্ত্বিক চিকিৎসার সুযোগ হয়েছিল।

দিনটি ছিল মন্দ। যেসব কাজকে তখন থেকে নাশকতা হিসেবে বিবেচিত করা হবে আর যার জন্য ঝুলিয়ে তৎক্ষণাৎ মৃত্যুর মাধ্যমে শাস্তি দেওয়া হবে সেসব কাজের বিষয়ে কুচকাওয়াজের সময় ঘোষণা দেওয়া হলো। আর সেসব কাজের মধ্যে অপরাধ হিসেবে ছিল পায়ের গোড়ালিতে ব্যবহার করার জন্য আমাদের পুরনো কম্বল থেকে ছোট টুকরো কাটা এবং ছোট-খাটো “চুরির ঘটনা”। কয়েকদিন আগে এক অর্ধ-অনাহারী ব্যক্তি কয়েক পাউন্ড আলু চুরির উদ্দেশ্যে আলুর গুদামে ঢুকেছিল। চুরির ঘটনাটি আবিষ্কার করা হয়েছিল। আর কয়েকজন বন্দী “চুরটিকেও” চিনতে সমর্থ হয়েছিল। শিবির কর্তৃপক্ষ যখন ঘটনাটি শুনতে পায় তখন তারা অপরাধী লোকটিকে তাদের হাতে তুলে দেওয়ার নির্দেশ দেয়, আর ঘোষণা দেয় যে অন্যথায় পুরো শিবিরকে একদিন অনাহারে থাকতে হবে। স্বভাবতই শিবিরের ২৫০০ কয়েদি উপবাস থাকাকে শ্রেয় মনে করেছিল।

সে উপবাসের দিন সন্ধ্যায় আমরা খুব হতাশ মেজাজে আমাদের মাটির তৈরি ছাউনিতে শুয়েছিলাম। খুব কমই আমরা কথা বলছিলাম আর প্রতিটি বাক্যই তখন খিটখিটে শোনাচ্ছিল। তারপর, বিষয়টিকে আরও খারাপ করে দিয়ে চলে গেলো আলো। মন-মেজাজ সর্বনিম্ন পর্যায়ে নেমে গেলো। কিন্তু আমাদের সিনিয়র ব্লক ওয়ার্ডেন ছিলেন একজন বুদ্ধিমান মানুষ। তিনি সে মুহূর্তে আমাদের মনের বিষয়াদি নিয়ে তাৎক্ষণিকভাবে ছোট আলাপ শুরু করে দিয়েছিলেন। গত কয়েক দিনে হয় অসুস্থতায়, না হয় আত্মহত্যা করে মারা যাওয়া অনেক সহকর্মীদের বিষয়ে তিনি অনেক বলেছিলেন। কিন্তু তাদের মৃত্যুর প্রকৃত কারণও তিনি উল্লেখ করেছিলেন: আশা ছেড়ে দেওয়া। তিনি উল্লেখ করেছিলেন যে সম্ভাব্য ভবিষ্যৎ ভুক্তভোগীদের এই চরম পরিস্থিতিতে পৌঁছা থেকে রক্ষা করার কোনো উপায় থাকা উচিৎ। আর আমার কাছে মনে হয়েছিল যেন তিনি এই সাইকোথেরাপিউটিক উপদেশ দেওয়ার জন্য আমাকে ইশারা করেছিলেন।

ঈশ্বর জানেন, তখন আমার সহকর্মীদের এক ধরনের আত্মার বা মনের চিকিৎসা সেবা প্রদানের উদ্দেশ্যে মনস্তাত্ত্বিক ব্যাখ্যা দেওয়ার জন্য বা কোনো ধর্মীয় শিক্ষা প্রদানের জন্য আমি প্রস্তুত ছিলাম না। আমি তখন শীতার্ত আর ক্ষুধার্ত, খিটখিটে ও ক্লান্ত ছিলাম, কিন্তু আমাকে এই অনুপম সুযোগের সদ্ব্যবহারে প্রচেষ্টা চালিয়ে যেতে হয়েছিল। সবচেয়ে বেশি প্রেরণার এখনই দরকার।

তাই আমি সবার আগে ছোট ছোট আরাম-আয়েশ সমূহ উল্লেখ করে শুরু করেছিলাম। আমি বলেছিলাম যে এই ইউরোপেও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ৬ষ্ট তম শীতকালে আমাদের অবস্থা আমরা যেমনটা ভেবেছিলাম তার মতো এতটা ভয়াবহ হয়নি। আমি বলেছিলাম যে আমাদের প্রত্যেকের নিজেকে জিজ্ঞেস করতে হবে কোনো অপূরণীয় ক্ষতির তাকে আজ অবধি সম্মুখীন হতে হয়েছে কিনা। আমি ধারণা করে নিয়েছিলাম যে অনেকের জন্য এরকম ক্ষতির পরিমাণ ছিল প্রকৃত অর্থে কম। তখন পর্যন্ত বেঁচে থাকা যেকারও কাছেই আশা-প্রত্যাশার কারণ ছিল। স্বাস্থ্য, পরিবার, সুখ-শান্তি, পেশাগত সামর্থ্য, ভাগ্য, সামাজিক অবস্থান—এসব কিছুই পুনরায় অর্জন করা বা ফিরিয়ে আনা সম্ভব। সর্বোপরি, আমাদের সকলেরই হাড় ছিল অক্ষত। আমরা যা কিছুরই মধ্য দিয়ে গিয়েছি তা আমাদের জন্য ভবিষ্যতের সম্পদ হতে পারে। আর আমি নিৎশেকে উদ্ধৃতি করলাম: “যা আমাদের মারতে পারে না, তা আমাদের অধিকতর শক্তিশালী করে তুলে”। (That which does not kill me, makes me stronger.)

তারপর আমি ভবিষ্যতের বিষয়ে কথা বলেছিলাম। আমি বলেছিলাম যে ন্যায়পরায়ণ মানুষের কাছে ভবিষ্যৎ অবশ্য হতাশ মনে হয়। আমি সম্মতি দিয়ে বলেছিলাম যে আমাদের বেঁচে থাকার সম্ভাবনা কতোটা ক্ষীণ ছিল তা আমরা প্রত্যেকে অনুমান করতে পারি। আমি তাদের বলেছিলাম যদিও শিবিরে তখনও কোনো টাইফাস মহামারি দেখা দেয়নি, তবুও প্রতি বিশ জনে একজন হিসেবে আমি আমার নিজের বেচে থাকার সম্ভাবনাকে অনুমান করেছিলাম। কারণ ভবিষ্যৎ তার জন্য কি নিয়ে আসবে তা কেউই জানতো না, তার চেয়ে কম অনিশ্চিত ছিল পরবর্তী মুহূর্তে কি হবে তার সম্ভাবনা। এমনকি আমরা যদি পরবর্তী কয়েক দিনে যুদ্ধ সম্পর্কে কোনো চাঞ্চল্যকর সামরিক ঘটনা প্রত্যাশা নাও করতে পারি, শিবিরে আমাদের অভিজ্ঞতার কারণে কে আমাদের চেয়ে ভালা জানতো যে মাঝে মাঝে আকস্মিকভাবে কোনো ব্যক্তির জন্য কতো বড় সম্ভাবনার দ্বার খুলে গিয়েছিল। উদাহরণস্বরূপ, কেউ হয়তো অপ্রত্যাশিতভাবে বিশেষভাবে কাজের ভালো অবস্থা রয়েছে এমন কোনো বিশেষ দলের প্রতি সংযুক্ত ছিলেন, কারণ এই ধরনে জিনিসই একজন কয়েদির “নিয়তি” গঠন করেছিল।

কিন্তু আমি কেবল ভবিষ্যৎ আর তার সম্ভাবনা হারিয়ে যাওয়ার বিষয়ে কথা বলেছিলাম তা নয়। আমি অতীত সম্পর্কেও কথা বলেছিলাম। কথা বলেছিলাম অতীতের সব আনন্দ, আর কিভাবে তার আলোয় বর্তমান অন্ধকারচ্ছতাকে আলোকিত করেছিল সে সম্পর্কেও। নিজেকে একজন ধর্মপ্রচারকের মতো শুনা থেকে বিরত রাখতে পুনরায় আমি এক কবির উদ্ধৃতি করেছিলাম-যিনি লিখেছিলেন, “তুমি যার অভিজ্ঞতা লাভ করেছো বা শিখেছ, কোনো শক্তিই তা তোমার কাছ থেকে কেড়ে নিতে পারবে না”। (What you have experienced, no power on earth can take from you.) কেবল আমাদের অভিজ্ঞতা নয়, বরং আমরা যাই করেছি, যত মহৎ বা মহান ভাবনা আমাদের ছিল, এবং আমরা যে যন্ত্রণাভোগ করেছি, তার কোনো কিছুই হারিয়ে যায়নি, যদিও তা অতীতে রূপান্তরিত হয়েছে। আমরা তাকে এক সত্ত্বা বা অস্তিত্বে রূপ দিয়েছি। গত হয়ে যাওয়া বা অতীত হয়ে যাওয়াও এক ধরনের অস্তিত্ব, আর সম্ভবত সবচেয়ে নিশ্চিত প্রকারের অস্তিত্ব।

তারপর আমি জীবনকে অর্থবহ করে তোলার বহু সুযোগ সম্পর্কে কথা বলেছিলাম। আমি আমার সহকর্মীদের যারা নিথর হয়ে পড়ে থেকেছিল তাদের উল্লেখ করে বলেছিলাম যে, যে কোনও পরিস্থিতিতেও মানব জীবন অর্থহীন হয় না। এবং জীবনের এই ক্ষয়হীন অর্থ’র মাঝে সম্পৃক্ত রয়েছে যন্ত্রণাভোগ ও মৃত্যু বরণ, অভাব ও মৃত্যু। ছাউনির অন্ধকারে দীনহীন হয়ে পড়ে থাকা প্রাণী, যারা আমার কথা মন দিয়ে শুনছিল আমি তাদের আমাদের পরিস্থিতিকে গুরুত্ব সহকারে মোকাবিলা করার আহ্বান করেছিলাম। আমি বলেছিলাম যে, তাদের আশা-প্রত্যাশা হারিয়ে ফেলা উচিৎ নয় বরং এই নিশ্চয়তায় সাহস রাখা প্রয়োজন যে আমাদের সংগ্রামের ব্যর্থতা জীবনের মর্যাদা এবং অর্থ’কে হরণ করেনি। আমি বলেছিলাম যে কঠিন মুহূর্তে কেউ –বন্ধু-বান্ধব, স্ত্রী, মৃত বা জীবিত যে কেউ, অথবা ঈশ্বর – আমাদের প্রত্যেককে অবজ্ঞার চোখে দেখে থাকে, তবে সেও চাইবে না যে আমরা তাকে হতাশ করি। সেও আশা করবে যে কিভাবে মৃত্যুকে বরণ করে নিতে হয় তা জেনে আমরা যেন গৌরবের সাথে আমাদের যন্ত্রণা ভোগ করি – দুর্দশাগ্রস্তভাবে নয়।

আর অবশেষে, আমি আমাদের ত্যাগের বিষয়ে কথা বলেছিলাম, প্রতিটি ক্ষেত্রে যা অর্থবহ ছিল। এই ত্যাগের ধরনের কারণেই সাধারণ বস্তুগত সফলতার জগতে তা অর্থহীন প্রতীয়মান হয়। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে উৎসর্গের অর্থ রয়েছে। খোলাখুলি ভাবেই বলার কারণে আমাদের মাঝে যাদের ধর্মীয় বিশ্বাস ছিল তারা সহসাই বিষয়টি বুঝতে পেরেছিল। আমি তাদেরকে আমাদের এক সহকর্মীর কথা বলেছিলাম, যে শিবিরে আগমনের পরপরই স্বর্গের সাথে চুক্তি করতে চেষ্টা করেছিলেন যে, তার যন্ত্রণাভোগ ও মৃত্যুর উদ্দেশ্য হবে সে যাদের ভালবেসেছিল তাদের কষ্টদায়ক অবসান থেকে বাঁচানো। এই লোকটির জন্য যন্ত্রণাভোগ ও মৃত্যু ছিল অর্থবহ; তার ত্যাগ ছিল গভীরতম তাৎপর্যের। তিনি নিষ্ফল কোনো কিছুর জন্য প্রাণ দিতে চাননি। আমরা কেউই তা চাই না।

তখনও সেখানে সেই ছাউনিতে এবং সেই বাস্তবিকপক্ষে হতাশ মুহূর্তে আমার কথার উদ্দেশ্য ছিল আমাদের জীবনের পরিপূর্ণ অর্থ খুঁজে পাওয়া। আমি লক্ষ করেছিলাম যে আমার প্রচেষ্টা সফল হচ্ছিল। যখন বৈদ্যুতিক বাল্ব আবার জ্বলে ওঠে, আমি দেখলাম আমার বন্ধুদের হতাশাগ্রস্ত দেহ সমূহ খুড়াতে খুড়াতে তাদের অশ্রুসজল নয়নে আমাকে ধন্যবাদ দিচ্ছে। কিন্তু এখানে আমাকে স্বীকার করতে হবে যে, যন্ত্রণাভোগ করা আমার সঙ্গীদের সাথে আমার যোগাযোগ করার খুব কমই আভ্যন্তরীণ শক্তি (Inner strength) ছিল এবং তা করতে গিয়ে আমার হয়তো অনেক সুযোগ হাতছাড়া হয়ে গিয়েছিল।

*********

আমরা এখন কয়েদিদের মানসিক প্রতিক্রিয়ার তৃতীয় স্তর সম্পর্কে কথা বলব। আর তাহলো কোনো কয়েদির মুক্তির পর তার মানসিক অবস্থা। কিন্তু তার পূর্বে আমরা প্রায়শই মনস্তাত্ত্বিকদের দ্বারা করা প্রশ্নটি বিবেচনায় আনবো, বিশেষত যখন শিবিরের এসব বিষয়ে কোনো কয়েদির ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থাকে। প্রশ্নটি হলো: শিবির প্রহরীদের মানসিক স্বভাব সম্বন্ধে আপনি আমাদের কি বলতে পারি? অসংখ্য কয়েদিদের অভিযোগ অনুযায়ী, কিভাবে সেসব রক্ত-মাংসের মানুষদের পক্ষে অসংখ্য কয়েদিদের সাথে এরকম আচরণ করা সম্ভব হয়েছিল? এক সময় এসব বর্ণনা শুনে ও এসব জিনিস যে ঘটেছিল তা বিশ্বাস করে একজন মানুষ, মনস্তাত্ত্বিকভাবে বা মানসিকভাবে তা কিভাবে সম্ভব হতে পারে তা জানতে চাইবে। এ প্রশ্নের উত্তর দিতে বিষদ বর্ণনায় না গিয়ে আমাদের কয়েকটি বিষয় চিহ্নিত করা দরকার:

প্রথমত, প্রহরীদের মাঝে কেউ কেউ ধর্ষকামী বা স্যাডিস্ট লোক ছিল। যাদের সম্পূর্ণ ক্লিনিক্যাল অর্থে ধর্ষকামী বলা যেতে পারে।

দ্বিতীয়ত, এই ধর্ষকামীদের সব সময়ই বাছাই করে নেওয়া হত যখন সত্যিই তীব্রভাবে প্রহরী সৈন্যদলের প্রয়োজন হত।

তীব্র ঠাণ্ডায় দু’ঘণ্টা কাজ করার পর কয়েক মিনিটের জন্য ডাল-পালা আর কাঠের টুকরোতে ভর্তি ছোট একটি চুলার সামনে নিজেদের উষ্ণ করে তোলার অনুমতি থাকলে আমাদের কাজের স্থলে মহা আনন্দ থাকতো। কিন্তু কিছু কিছু দল প্রধান তা আমাদের কাছ থেকে নিয়ে যাওয়ার মাঝে মহা আনন্দ পেতেন। কত পরিষ্কারভাবেই না তাদের সেই আনন্দ তাদের চেহারায় প্রতিফলিত হতো যখন তারা কেবল আমাদের নিষেধ করেই ক্ষান্ত না হয়ে বরং চুলাটিকে উল্টিয়ে দিয়ে তার আনন্দদায়ক আগুন বরফের মধ্যে ফেলে দিতো! SS এর লোকেরা যখন কোনো লোককে অপছন্দ করতো তখন তাদের সারিতে সব সময়ই ধর্ষকামী নির্যাতনে অভিজ্ঞ ও ধর্ষকামী নির্যাতনে অনুমতি দেওয়া হয়েছে এমন একজন বিশেষ মানুষ থাকতো আর দুর্ভাগা কয়েদিকে তার কাছে পাঠিয়ে দেওয়া হতো।

তৃতীয়ত, বছরের পর বছর ক্রমবর্ধমান মাত্রায় ক্যাম্পের নির্মম পদ্ধতি দেখতে দেখতে অধিকাংশ প্রহরীদের অনুভূতি অসাড় বা ভোঁতা হয়ে গিয়েছিল। নৈতিকভাবে ও মানসিকভাবে কঠোর হয়ে উঠা এই মানুষগুলি ধর্ষকামী নিয়ন্ত্রণে সক্রিয় অংশগ্রহণে অন্তত অস্বীকৃতি জানাত। কিন্তু তারা ধর্ষকামী নির্যাতন চালিয়ে যাওয়া মানুষগুলিকে বাধা দেয়নি। 

চতুর্থত, এটি স্বীকার করতে হবে যে এমনকি প্রহরীদের মাঝেও এমন লোক ছিল যারা আমাদের প্রতি দয়া দেখাত। আমি এক্ষেত্রে যে শিবির থেকে আমাকে মুক্তি দেওয়া হয়েছিল সে শিবিরের অধিনায়কের কথা উল্লেখ করতে পারি। মুক্তির পর বুঝতে পারি যে সে লোকটি নিকটতম বাজার থেকে কয়েদিদের জন্য ঔষধ ক্রয় করতে নিজের পকেট থেকে বড় অঙ্কের অর্থ পরিশোধ করেছিলেন। কেবল একজন ক্যাম্প চিকিৎসকই আগে থেকে তা জানতেন, যে নিজেও ছিলেন একজন কয়েদি। কিন্তু আমাদের সিনিয়র ওয়ার্ডেন যিনি নিজেও একজন কয়েদী ছিলেন, তিনি যেকোনো SS প্রহরীদের চেয়ে কঠোর ছিলেন। তিনি হালকা সুযোগ ফেলেই অন্যান্য কয়েদিদের মারধর করতেন। যেখানে আমার অভিজ্ঞতায় শিবির অধিনায়ক, কখনও আমাদের বিরুদ্ধে হাত তোলেন নি।

একটি বিষয় পরিষ্কার যে, একজন ব্যক্তির শিবির প্রহরী বা একজন কয়েদী হয়ে উঠা সম্পর্কে বলতে গেলে আমাদের কিছুই ধারণা দেয় না। মানবিকতা সকল দলের মানুষের মাঝে বিদ্যমান, এমনকি সার্বিকভাবে যাদের সহজেই দোষারোপ করা যায় তাদের মাঝেও। মানুষের মাঝে মানবিকতার সীমানা একদল থেকে অন্য দলে ছড়িয়ে পড়েছে এবং এই লোকগুলি ফেরেশতার মতো বা ঐসব লোকগুলি শয়তানের মতো বলে বিষয়গুলিকে সহজসাধ্য করার চেষ্টা করতে নেই। নিঃসন্দেহে, একজন প্রহরীর জন্য বা একজন কাজের দলনেতার পক্ষে শিবিরের সমস্ত প্রভাব সত্ত্বেও কয়েদিদের প্রতি দয়াবান হওয়াটা এক উল্লেখযোগ্য কৃতিত্ব। আর অন্যদিকে, একজন কয়েদি যে তার নিজের সঙ্গীদের প্রতি নির্মম আচরণ করেছিল তার হীনতা বা অপকর্ম ছিল অতি নিকৃষ্ট। দৃশ্যত, কয়েদিদের জন্য এরকম মানুষদের চরিত্রহীনতা ছিল বিশেষভাবে উদ্বেগজনক, যেখানে কোনো প্রহরী কর্তৃক ক্ষুদ্রতম উদারতা তাদের গভীরভাবে নাড়া দিতো। আমার মনে পড়ে একজন দল প্রধানের কথা যে একদিন গোপনে আমাকে একটুকরো রুট দিয়েছিলেন। আমি জানতাম তিনি নিশ্চয় তা তার সকালের নাস্তার বরাদ্দ থেকে বাঁচিয়ে রেখেছিলেন। সে সময় যে জিনিসটি আমার চোখে জল এনেছিল তা সে ছোট রুটির টুকরোটি নয়। তা ছিল মানবিক ‘একটা-কিছু’ যা এই লোকটি আমাকে দিয়েছিলেন, আর তা ছিল উপহারের সাথে আসা তার বাক্য ও চাহনি।

এসব থেকে আমরা শিখতে পারি যে, পৃথিবীতে মানুষের দু’টি জাত রয়েছ, কেবল এই দুই জাত – শালীন (decent) মানুষের “জাত” এবং অশালীন (indecent) মানুষের “জাত”। উভয় জাতেরই সবখানে অস্তিত্ব রয়েছে; এই জাত দুটি সমাজের সকল দলে প্রবেশ করে। নির্দিষ্ট কোনো দলই কেবল শালীন বা অশালীন মানুষ দিয়ে গঠিত নয়। এই অর্থে, কোনো দলকেই আমরা “শুদ্ধ জাত” বলতে পারি না- আর তাই কেউ মাঝে মধ্যে শিবিরের প্রহরীদের মাঝেও একজন শালীন মানুষকে খুঁজে পেতো।

বন্দী শিবিরের জীবন মানুষের আত্মাকে ছিঁড়ে উন্মুক্ত করে দিয়েছিল এবং এর গভীরতাকে উদ্ভাসিত করেছিল। সেই গভীরতায় আবার কেবল মানুষের গুণাবলীকে খুঁজে পাওয়া কি আশ্চর্যের কিছু যা প্রকৃতপক্ষে ভালো আর মন্দের মিশ্রণ? মন্দ থেকে ভালোকে পৃথক করা ফাটলটি সকল মানুষকে ভেদ করে সর্ব নিম্ন স্তরে পৌঁছে গিয়েছে আর তা বন্দী শিবির দ্বারা উন্মুক্ত রাখা অতল গহ্বরের তলদেশেও দৃশ্যমান হয়ে উঠে।

*******

আর এখন শেষ অধ্যায়ে রয়েছে মুক্ত হওয়া কয়েদির মনস্তত্ত্ব সম্পর্কে। মুক্তির ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতাকে বর্ণনা করতে, কয়েকটি অত্যন্ত উত্তেজনাপূর্ণ দিনের পর শিবিরের প্রবেশ ধারের উপরে সাদা পতাকা উড্ডয়নের যে সকালের কথা বলা হয়েছে, সেখান থেকে আমরা আমাদের বর্ণনার অংশটি শুরু করবো। এই অভ্যন্তরীণ উদ্বেগের পর এসেছিল পরিপূর্ণ স্বস্তি। কিন্তু এটা ভাবা কি বেশ অন্যায় হবে যে আনন্দের সাথে আমরা পাগল হয়ে গিয়েছিলাম। তখন আসলে কি হয়েছিল?

ক্লান্ত-পরিশ্রান্ত পদক্ষেপে আমরা কয়েদিরা নিজেদেরে শিবিরের প্রবেশ ধার পর্যন্ত টেনে নিয়ে গিয়েছিলাম। ভয়ে ভয়ে আমরা চারদিকে দেখলাম আর জিজ্ঞাসু ভঙ্গিতে একে অন্যের পানে তাকালাম। তারপর আমরা সাহস করে শিবিরের বাইরে কয়েক পা এগিয়ে গেলাম। এসময় কোনো চিৎকার করা আদেশ আমাদের দেওয়া হয়নি, প্রয়োজন হয়নি দ্রুত মাথা নিচু করে আঘাত বা লাথি থেকে বাঁচার প্রচেষ্টা করার। হা হা! এখন দেখি প্রহরীরাও আমাদের সিগারেট সাধছে! প্রথম প্রথম আমরা তাদের চিনতেই পারিনি। তড়িঘড়ি করে তারা বেসামরিক পোশাকে পরিবর্তিত হয়ে পড়েছিল। শিবির থেকে বয়ে যাওয়া সড়ক ধরে আমরা ধীরে ধীরে হাঁটছিলাম। শীঘ্রই আমাদের পা ব্যথা করছিল ও বেঁকে যাওয়ার মতো অবস্থা হলো। কিন্তু তারপরও আমরা খুড়িয়ে হাটতে থাকলাম; মুক্ত মানুষের চোখে আমরা প্রথমবারের মতো শিবিরের চারপাশ দেখতে চাইলাম। নিজেদের কাছে “মুক্তি” বা স্বাধীনতা শব্দটি কথায় কথায় পুনরাবৃত্তি করলাম, আর তবুও শব্দটিকে উপলব্ধি করতে পারলাম না। এই কয়েক বছরে স্বপ্ন দেখা শব্দটিকে নিয়ে আমরা অসংখ্যবার কথা বলেছিলাম, যে শব্দটি তার অর্থ হারিয়ে ফেলেছিল তখন। শব্দটির বাস্তবতা আমাদের চেতনায় প্রবেশ করেনি। আমরা বুঝতে পারিনি যে আমরা আসলেই মুক্ত হয়েছিলাম।

আমরা ফুলে পরিপূর্ণ এক তৃণভূমিতে আসলাম। আমরা দেখলাম আর অনুধাবন করলাম যে, যার যেখানে থাকার কথা সেখানে সবকিছুই। কিন্তু তাদের সম্পর্কে আমাদের কোনো অনুভূতিই ছিল না। বহুরঙা পালকের লেজ নিয়ে একটি মোরগ আমাদের চোখে পড়তেই আমাদের প্রথম আনন্দের ঝলকানি হয়। কিন্তু তা কেবল এক ঝলকানিতে শেষ হয়ে যায়। আমরা তখনও এই জগতের অন্তর্ভুক্ত হতে পারিনি।

সন্ধ্যায় আমরা পুনরায় ছাউনিতে মিলিত হলাম, কেউ কেউ গোপনে একে অন্যকে বলেছিল, “আমাকে বলুন তো, আপনি কি আজকে আনন্দিত ছিলেন?”

যেহেতু সে জানতো না যে আমরাও একই জিনিস অনুভব করছিলাম তাই লজ্জিত হয়ে অন্যজন উত্তর দেয়, “সত্যিকার অর্থে, না”! আমরা আক্ষরিক অর্থে আনন্দিত অনুভব করার সামর্থ্য হারিয়ে ফেলেছিলাম। আর সে অনুভূতি আমাদেরকে ক্রমে ক্রমে পুনরায় অর্জন করতে হয়েছিল।

********

মনস্তাত্ত্বিকভাবে, মুক্ত কয়েদিদের ক্ষেত্রে যা ঘটছিল তাকে “depersonalization” বলা যেতে পারে। এটি এমন এক মানসিক অবস্থা যাতে কারো চিন্তা-ভাবনা এবং অনুভূতিকে অবাস্তব মনে হয় বা নিজের কাছে অন্তর্ভুক্ত বলে মনে হয় না। স্বপ্নের মতো সবকিছুকেই মনে হয়েছিল অবাস্তব, অসম্ভব। আমরা বিশ্বাস করতে পারছিলাম না যে তা সত্যি। বিগত বছরগুলিতে কত বারই না আমরা স্বপ্নের দ্বারা প্রতারিত হয়েছিলাম! আমরা স্বপ্ন দেখতাম যে মুক্তির দিন এসে গেছে, আমাদের অবমুক্ত করা হয়েছে, আমরা বাড়ি ফিরে গিয়েছি, আমাদের বন্ধু-বান্ধবদের অভিবাদন জানিয়েছি, আমাদের স্ত্রীদের আলিঙ্গন করেছি, টেবিলে বসে পড়েছি ও আমরা যেসবের মধ্যদিয়ে গিয়েছি তা বলতে শুরু করে দিয়েছি – এমনকি কতবার আমাদের এই মুক্তির দিনটি নিয়ে স্বপ্ন দেখেছিলাম। আর তখনই আমাদের কানে একটি বাঁশি কর্কশভাবে বেজে উঠলো, জেগে উঠার সঙ্কেত। আমাদের স্বপ্নের সমাপ্তি ঘটে। আর এখন স্বপ্ন সত্যি হয়েছে। কিন্তু তাতে কি সত্যিই বিশ্বাস করতে পেরেছিলাম?

*******

মনের চেয়ে দেহের কম inhibition বা আভ্যাসিক সংকোচন বা নিগ্রহ রয়েছে। প্রথম মুহূর্ত থেকেই তা (দেহ) নতুন মুক্তি বা স্বাধীনকে সুসম ব্যবহার করেছিল। তা রাক্ষসের মতো ঘণ্টার পর ঘণ্টা এবং দিনের পর দিন এমনকি অর্ধেক রাত পর্যন্ত খাওয়া শুরু করে দিয়েছিল। একজন মানুষ কি পরিমাণে যে খেতে পারে তা বিস্ময়কর। পাড়ার কোনো বন্ধু সুলভ কৃষক যখন কোনো কয়েদিকে নিমন্ত্রণ করতো, তখন সে খেতেই থাকতো ও কফি পান করতেই থাকতো, যা তার জিহ্বাকে ঢিলা করে দিতো আর সে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কথা বলতে থাকতো। বছর বছর ধরে যে চাপ তার মনের উপর ছিল তা অবশেষে মুক্ত করা হতো। তাকে কথা বলতে শুনে, একজন মানুষ ধারনা করতে পারতো যে লোকটির কথা বলা দরকার, আর তার কথা বলার আকাঙ্ক্ষা ছিল অপ্রতিরোধ্য। আমি এমন সব লোকদের সম্পর্কে জানতে পেরেছি যারা কেবল অল্প সময়ের জন্য জার্মান পুলিশদের মাধ্যমে জেরা করার ন্যায় একই প্রতিক্রিয়া করার জন্য প্রচণ্ড চাপের মধ্যে ছিল। অনেক দিন পার হয়ে যাওয়ার পর যে শুধু জিহ্বা ঢিলা হয়ে গিয়েছিল তা নয়, বরং নিজের মাঝে অন্য কিছুও ঢিলা হয়ে উঠেছিল। তারপর একদিন হঠাৎ করে তাকে প্রতিরোধ করে রাখা অদ্ভুত শিকল ছিঁড়ে অনুভূতি বের হয়ে পড়ে।

*******

আমাদের মুক্তির কয়েকদিন পর আমি গ্রামের মধ্য দিয়ে মাইলের পর মাইল ফুলে ভরা তৃণভূমি পার হয়ে শিবিরের পার্শ্ববর্তী শহরের বাজারের দিকে হাঁটছিলাম। ভরত পাখিগুলি আকাশে উড়ছিল আমি তাদের উৎফুল্ল গান শুনতে পেয়েছিলাম। কয়েক মাইলের ভেতরে চারপাশে দেখার মতো কেউই ছিল না; বিস্তীর্ণ ধরা আর আকাশ এবং ভরত পাখিদের উল্লাস আর অবকাশের স্বাধীনতা ব্যতীত আর কিছুই ছিল না। আমি থামলাম, চার দিকে এবং উপরে আকাশের দিকে তাকালাম – আর তারপর আমি হাঁটু গেড়ে বসলাম। সে মুহূর্তে খুব কমই আমার নিজের বা পৃথিবীর পরিচিত কিছু ছিল – আমার মনে বরাবরের মতো একটি বাক্যই ছিল: “সংক্ষীর্ণ হাজত থেকে আমি প্রভুকে ডেকেছিলাম আর অবকাশের স্বাধীনতায় (freedom of space বা অবস্থানগত স্বাধীনতা) তিনি সাড়া দিলেন”। কতক্ষণ আমি সেখানে হাটুঁ গেড়ে ছিলাম এবং বাক্যটির পুনরাবৃত্তি করছিলাম তা স্মৃতিশক্তি আর মনে করতে পারে না। কিন্তু আমি জানি যে সেদিন, সেই মুহূর্তে আমার নবজীবনের শুরু হয়েছিল। যতক্ষণ না আমি পুনরায়  একজন মানুষ হয়ে উঠলাম ততক্ষণ পদক্ষেপের পর পদক্ষেপে আমি ধাবিত হলাম।

******

শিবিরের শেষ দিনগুলির তীব্র মানসিক উত্তেজনা থেকে সেই (স্নায়ু যুদ্ধ থেকে মানসিক শান্তির দিকে) অগ্রসর হওয়া পথটি অবশ্যই বাধা-বিপত্তিহীন ছিল না। এটা চিন্তা করা ভুল হবে যে একজন মুক্ত বা স্বাধীন কয়েদির আধ্যাত্মিক স্বাস্থ্যের আর প্রয়োজন ছিল না। আমাদের বিবেচনা করতে হবে যে একজন মানুষ যে দীর্ঘ সময় ধরে এরকম প্রকাণ্ড মানসিক চাপের মধ্যে থাকে, মুক্তির পর সে স্বভাবতই তার কিছু ঝুঁকিতে থাকে। বিশেষ করে যখন সে চাপকে বেশ হঠাৎ করেই বিমুক্ত করা হতো। মনস্তাত্ত্বিক স্বাস্থ্যের বেলায় এই বিপদ হলো বক্রতার মনস্তাত্ত্বিক প্রতিমূর্তি। সেতু ইত্যাদির ভিত্তি স্থাপনকালে জলের নিচে কাজ করার জল নিবারক বৃহৎ বাক্স বা প্রকোষ্ঠের (caisson) শ্রমিকের দৈহিক স্বাস্থ্য বিপদগ্রস্ত হবে যদি সে হঠাৎ করে ডুবুরির চেম্বার বা প্রকোষ্ঠ থেকে (যেখানে সে প্রচুর atmospheric pressure বা বায়ুমণ্ডলীয় চাপের মধ্যে থাকে) বের হয়ে আসে, তাই হঠাৎ করে  মানসিক চাপ মুক্ত হওয়া বা স্বাধীনতা পাওয়া মানুষটি নৈতিক ও আধ্যাত্মিক স্বাস্থ্যের ক্ষতির সম্মুখীন হতে পারে।

এই মনস্তাত্ত্বিক বা মানসিক অবস্থার সময় লক্ষ্য করা যায় যে অধিকতর আদিম প্রকৃতির মানুষেরা শিবির জীবনে ঘিরে থাকা নির্মমতার প্রভাব থেকে রেহাই পেতনা। মুক্ত অবস্থায়, তারা মনে করেছিল তারা তাদের স্বাধীনতাকে “উচ্ছৃঙ্খলভাবে ও নির্মমভাবে” ব্যবহার করতে পারবে। শুধুমাত্র যে জিনিসটি তাদের কাছে পরিবর্তিত হয়েছিল তা ছিল নিপীড়িত হওয়ার চেয়ে তারা হয়ে উঠেছিল নিপীড়নকারী। তারা স্বেচ্ছাচারী শক্তি ও অবিচারের বস্তু না হয়ে, হয়ে উঠেছিল এর উস্কানি দাতা। তারা তাদের ভয়াবহ অভিজ্ঞতার দ্বারা তাদের আচরণকে বিচার বা সমর্থন করেছিল। তা প্রায়শই দৃশ্যমান হতো তুচ্ছ ঘটনায়। আমার এক বন্ধু আমার সাথে একটি মাঠের মধ্য দিয়ে শিবিরের দিকে হাঁটছিল। হাটতে হাটতে আমরা হঠাৎ এক সবুজ ফসলী মাঠের কাছে চলে আসি। আপনা আপনিতেই, তা আমি এড়িয়ে চললাম, কিন্তু সে আমার বাহুর ভেতর দিয়ে তার বাহু বাড়িয়ে দিয়ে মাঠটির ফসলের মধ্য দিয়ে আমাকে টেনে নিয়ে গেলো। কচি শস্য পদদলিত না করার বিষয়ে আমি কিছু বিড়বিড় করে কিছু একটা বলেছিলাম। সে বিরক্ত হলো, রাগান্বিত ভাব আমার দিকে তাকিয়ে চিৎকার করে বলে উঠল, “কি বলো এসব! আর আমাদের কাছ থেকে কি যথেষ্ট কেড়ে নেওয়া হয়নি? আমার স্ত্রী আর বাচ্চাকে গ্যাস দিয়ে মারা হয়েছে – অন্য সবকিছু আর নাই বললাম – আর তুমি আমাকে এই কয়েকটি যবের বৃন্ত মাড়াতে নিষেধ করবে”!

এসব লোকদের কেবল ধীরে ধীরে প্রচলিত সত্যে ফিরিয়ে আনা সম্ভব যে, অন্যায় করার কারো অধিকার নেই, এমনকি তাদের সাথে যদি অন্যায়ও করা হয়ে থাকে তখনও না। তাদের এই সত্যে চালিত করতে আমাদের প্রচেষ্টা চালিয়ে যেতে হয়েছিল, নতুবা তার পরিণতি কয়েক হাজার যবের বৃন্ত হারানোর চেয়ে অধিক খারাপ হতো। আমি এখনও এক বন্দীকে দেখি যে তার জামার হাতা গুটিয়ে তার ডান হাত আমার নাকের নিচে ঠেলে ধরে রেখে চিৎকার করে বলতো, “এই হাত যেন কেটে ফেলা হয় আমি যদি বাড়িতে পৌঁছার দিন তা রক্তে রঞ্জিত না করি”! আমি বিশেষভাবে বলতে চাই যে, যে লোকটি এসব কথা বলেছিল সে একজন মন্দ লোক ছিল না। শিবিরে ও পরবর্তী কালে সে ছিল সহকর্মীদের মাঝে সর্বোত্তম ব্যক্তি।  

মানসিক চাপের আকস্মিক নিস্তারের ফলে নৈতিক বিকলাঙ্গতার পাশাপাশি, আরও দু’টি মৌলিক অভিজ্ঞতা মুক্ত কয়েদিদের চরিত্রকে ক্ষতি সাধনের হুমকির মুখোমুখি করে: অতীত জীবনে ফিরে যাওয়ার পর তিক্ততা এবং মোহমুক্তি।

তার আগের নিজ শহরে বেশ কিছু জিনিসের বিরুদ্ধে তার অবস্থান নেওয়া থেকে তিক্ততার সৃষ্টি হতো। শিবির থেকে ফিরে আসার সময় যখন একজন কয়েদি দেখতে পেত সে অনেক জায়গায় কাঁধ কুঁচকানো বা উদাসীনতা আর বহুলব্যবহৃত বুলির মুখোমুখি হচ্ছে। তখন সে তিক্ততা প্রবণ হয়ে উঠে ও নিজেকে জিজ্ঞেস করে ‘কেনো তাকে ক্যাম্পে সে সবের মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছিল’। যখন সে প্রায় সবখানেই একই কথা শুনতে পায়, “আমরা তো তা জানতাম না” এবং “আমরাও কষ্ট ভোগ করেছি”, তখন সে নিজেকে জিজ্ঞেস করে, তাদের কি আসলেই এর চেয়ে ভালো কিছু আমাকে বলার জন্য নেই?

মোহমুক্তি বা হতাশার অভিজ্ঞতা আলাদা। এ পর্যায়ে এটি কারো সহকর্মী মানুষকে নয় বরং ভাগ্যকেই নিষ্ঠুর বলে মনে হয়েছিল। তার উপলব্ধিহীনতা ও অনুভূতিহীনতা এতটাই ঘৃণ্য ছিল যে অবশেষে লোকজনের কথা না শোনে বা তাদের না দেখে চুপিসারে কেউ নিজেকে গর্তে ঢুকিয়ে রাখার মতো অনুভব করতো। একজন মানুষ, যে বছর বছর ধরে ভেবেছিলো যে সে হয়তো সকল সম্ভাব্য যন্ত্রণা ভোগের একেবারে চরম সীমানায় পৌঁছেছে, সে মুক্ত হওয়ার পর বুঝতে পারে যে যন্ত্রণা ভোগের কোনো শেষ নাই। এখনও আরও যন্ত্রণা ভোগ করতে হবে, আর ভোগ করতে হবে আরও তীব্রভাবে।

শিবিরে একজন মানুষকে মানসিক সাহস দেওয়ার প্রচেষ্টার ব্যাপারে যখন আমরা কথা বলেছিলাম, আমরা বলেছিলাম যে তাকে ভবিষ্যতে প্রত্যাশা করার জন্য কিছু একটা দেখানো উচিৎ। তাকে স্মরণ করিয়ে দিতে হয়েছিল যে জীবন এখনও তার জন্য অপেক্ষা করছে, ও কেউ একজন মানুষ তার অপেক্ষায় আছে। কিন্তু মুক্তির পর কি হয়েছিল? এমনও অনেক লোক ছিল মুক্তির পর যারা আবিষ্কার করেছিল যে আসলে তাদের জন্য কেউই অপেক্ষা করছিলো না। দুর্ভাগা সে, যে আবিষ্কার করেছিল যে যার স্মৃতি তাকে শিবিরে সাহস যুগিয়েছিল সে আর বেঁচে নেই! দুর্ভাগা সে, যে, অবশেষে যখন স্বপ্নের দিনটি আসে, বুঝতে পেরেছিল যে, সে যেসবের জন্য আকুল আকাঙ্ক্ষায় দিন কাটিয়েছিল তার সবকিছুই অনেক আলাদা। সম্ভবত সে কোনো ট্রলি বাসে চড়ে যে বাড়িটি সে কয়েক বছর ধরে তার মানসপটে দেখেছিল সেখানে যাওয়ার উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়লো, ও ঠিক যেমনটি সহস্র স্বপ্নে সে করতে আকাঙ্ক্ষিত ছিল ঠিক সেইভাবে ঘরের ঘণ্টা চাপে, আর তারপর বুঝতে পারে যে যাকে দরজাটা খুলার কথা ছিল সে সেখানে নেই বা কখনও ফিরে আসার সম্ভাবনাও নাই।

শিবিরে আমরা সবাই একে অপরকে বলেছিলাম যে পৃথিবীর কোনো সুখই আমরা যা ভোগ করেছিলাম তার বিনিময় দিতে পারবে না। আমরা সুখের প্রত্যাশা করছিলাম না – কারণ আমাদের সাহসের সাথে ও আমাদের যন্ত্রণা ভোগে, আমাদের বিসর্জনে আর মৃত্যুতে অর্থ প্রদানের পেছনে সুখের কোনো সংযোগ ছিল না। তথাপি, আমরা কেউই অশান্তির জন্যও প্রস্তুত ছিলাম না। এই মোহমুক্তি বা হতাশা, যা কয়েদিদের একটি বড় অংশের জন্য অপেক্ষায় ছিল তা এমন এক অভিজ্ঞতা যা এই মানুষগুলির পক্ষে অতিক্রম করা খুবই কষ্টসাধ্য ছিল। এবং যা তাদের কাটিয়ে উঠার জন্য সাহায্য করার ক্ষেত্রে একজন মনঃরোগ বিশেষজ্ঞের পক্ষেও ছিল খুবই কষ্টকর। কিন্তু তার কাছে যেন এটি নিরুৎসাহের কারণ না হয়ে উঠে; অপরপক্ষে, এটি যেন এক বাড়তি কর্মপ্রেরণার সরবরাহ করে।

কিন্তু প্রত্যেক মুক্তিপ্রাপ্ত কয়েদির জন্য এমন এক দিন আসে যখন তার শিবির অভিজ্ঞতার দিকে ফিরে তাকাতে গেলে সে আর বুঝতে পারে না কিভাবে সে এতসব সহ্য করেছিল। অবশেষে তার মুক্তি বা স্বাধীনতার দিনটি আসে, যখন তার কাছে সবই এক সুন্দর স্বপ্নের ন্যায় মনে হয়। তদুপরি, এমনও এক দিন তার জন্য আসে যখন তার কাছে তার সব শিবির অবিজ্ঞতা কেবল এক দুঃস্বপ্ন ছাড়া আর কিছুই মনে হয় না। একজন ঘরে ফেরা মানুষের জন্য সমস্ত পুর্ণতাদায়ক অভিজ্ঞতার অপূর্ব অনুভূতি হলো যে সকল যন্ত্রণা ভোগ শেষে তার জন্য আর ভয় পাওয়ার কিছুই নেই – ঈশ্বর ব্যতীত।

দ্বিতীয় অংশ

সংক্ষেপে লগোথেরাপি*

*এই অংশটি প্রথমে Basic Concepts of Logotherapy বা লেগোথেরাপির মৌলিক ধারণা” হিসেবে Man’s Search for Meaning এর ১৯৬২ সংস্করণে প্রকাশিত হয়েছিল যাকে সংশোধিত ও হালনাগাদ করা হয়েছে।

আমার সংক্ষিপ্ত জীবনীমূলক কাহিনীর পাঠকেরা সাধারণত আমার চিকিৎসাবিদ্যা তত্ত্বের এক পূর্ণাঙ্গ ও আরও সিধাসিধি ব্যাখ্যা চেয়েছেন। ফলে, লগোথেরাপির উপর From Death-Camp to Existentialism বা মৃত্যু-শিবির থেকে অস্তিত্ববাদ এর মূল সংস্করণে সাথে আমি সংক্ষিপ্ত একটি অংশ সংযুক্ত করেছিলাম। তবুও তা যথেষ্ট ছিল না, আর আরও একটু বর্ধিত বর্ণনার জন্য আসা অনুরোধ আমাকে অবরুদ্ধ করে ফেলে। তাই, বর্তমান সংস্করণে আমি আমার বর্ণনা সম্পূর্ণরূপে পুনরায়  লিখলাম এবং প্রচুরভাবে সম্প্রসারিত করলাম।

কাজটি সহজ ছিল না। জার্মান ভাষায় লিখিত বিশ খণ্ডের সকল উপাদান সংক্ষিপ্ত পরিসরে পাঠকের কাছে তুলে ধরা অনেকটা হতাশ হওয়ার মতো কাজ। আমার মনে পড়ে একজন আমেরিকান ডাক্তার যে এক সময় ভিয়েনাতে আমার অফিসে এসে হাজির হয়ে আমাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, “ডাক্তার সাহেব আপনি এখন একজন মনঃসমীক্ষণবিদ”?  সে প্রশ্নে আমি উত্তর দিয়েছিলাম, “ঠিক মনঃসমীক্ষণবিদ নয়”। তারপর তিনি আমাকে প্রশ্ন করতে থাকলেন: “আপনি কোন্ ধারার অনুসারী”? আমি উত্তর দিলাম, “এটি আমার নিজেরই তত্ত্ব বা থিওরি; একে বলা হয় লগোথেরাপি”। আপনি কি আপনাকে এক বাক্যে বলতে পারবেন লগোথেরাপি মানে কি”? তিনি জিজ্ঞেস করেছিলেন। “অন্তত, psychoanalysis বা মনঃসমীক্ষণ ও লগোথেরাপির মধ্যে পার্থক্য কি”? “জি”, আমি বললাম, কিন্তু প্রথমেই আপনি কি আমাকে এক বাক্যে বলতে পারবেন psychoanalysis বা মনঃসমীক্ষণের সারমর্ম কি? এটা ছিল তার উত্তর: মনঃসমীক্ষণের সময় রোগীকে অবশ্যই কোনো শয্যায় শুয়ে পড়তে হয় এবং আপনার কাছে এমন কিছু বলতে হয় যা বলা খুবই  অনুপযোগী”। তারপর আমি তাৎক্ষনিকভাবে নিম্নোক্ত উত্তরে তার যথাযথ উত্তর দেয়: “এখন, লগোথেরাপির বেলায় রোগীটি হয়তো সোজা হয়ে বসে থাকতে পারে কিন্তু তাকে এমন কিছু অবশ্যই শুনতে হয় যা মাঝে মাঝে শুনতে খুবই অনুপযোগী”।

তা অবশ্য, হাসি-তামাশার মাধ্যমে বোঝানো হয়েছিল এবং লগোথেরাপির ক্যাপসুল সংস্করণ হিসেবে নয়। যাইহোক, এতে কিছু রয়েছে, যেহেতু মনো-বিশ্লেষণের তুলনায় লগোথেরাপি হচ্ছে কম অতীত-পর্যালোচনামূলক (retrospective) ও কম অন্তর্বীক্ষণিক (introspective) ( নিজের ভাবনা বা অনুভূতির বিষয়ে প্রচুর চিন্তা করা) একটি পদ্ধতি। লগোথেরাপি বরং ভবিষ্যতের দিকে নজর দেয়, তা বলতে গেলে, রোগীর দ্বারা তার ভবিষ্যতে জীবনের অর্থ পরিপূর্ণ করার দিকে নজর দেয়। (লগোথেরাপি হলো, প্রকৃতপক্ষে, এক অর্থ-কেন্দ্রিক সাইকোথেরাপি বা মনস্তাত্ত্বিক চিকিৎসা)। একই সময়, লগোথেরাপি সকল দুষ্টচক্র (vicious-circle) গঠন ও feedback mechanism (এক বক্রাক্ষর প্রণালী যাতে প্রণালী বিঘ্ন সৃষ্টির প্রতি হয় একই দিকে নতুবা বিপরীত দিকে প্রতিক্রিয়া করে) যা স্নায়ু-বৈকল্য (neurosis) বিকাশে বড় ভূমিকা পালনকে অ-কেন্দ্রীভূত করে। এভাবে, স্নায়ুবৈকল্যগ্রস্ত ব্যক্তির সাধারণ আত্মকেন্দ্রিকতাকে ক্রমাগতভাবে লালন ও দৃঢ়তর করার পরিবর্তে চূর্ণ করা হয়।

নিশ্চিন্তে, এধরনের বিবৃতি একটি অতি-সরলীকরণ; তবুও লগোথেরাপিতে রোগীকে প্রকৃতপক্ষে তার জীবনের অর্থের সম্মুখীন এবং তার পানে পুণঃপরিচালিত করা হয়। এবং এই অর্থের ব্যাপারে তাকে সচেতন করে তোলা অনেকটা তার স্নায়ু-বৈকল্য অতিক্রম করতে তাকে সামর্থ্য প্রদানে অবদান রাখতে পারে।

কেনো আমি আমার তত্ত্বের বা থিওরির নাম হিসেবে logotherapy বা লগোথেরাপি পারিভাষাটি প্রয়োগ করেছি তা আমি ব্যাখ্যা করছি। গ্রিক ভাষায় Logos মানে “অর্থ”। Logotherapy, বা The Third Viennese School of Psychotherapy’ র কয়েকজন লেখক এটিকে মানুষের সত্তা বা অস্তিত্বের ‘অর্থ’ এবং একজন মানুষের সে ‘অর্থ’কে অনুসন্ধানের দিকে নজর দেয়া” বলে আখ্যায়িত করে থাকে। লগোথেরাপি অনুযায়ী, একজন মানুষের জীবনে অর্থ অনুসন্ধানের এই প্রচেষ্টা হলো তার জন্য প্রাথমিক প্রেরণামূলক শক্তি। সেইজন্যে, আনন্দ তত্ত্বের (আমরা একে will to pleasure বা আনন্দের প্রতি  ইচ্ছাশক্তিও বলতে পারি) বিপরীতে ‘অর্থ’র প্রতি ইচ্ছাশক্তির কথা বলে থাকি যার উপর ফ্রয়ডিয় psychoanalysis বা মনঃসমীক্ষণ কেন্দ্রিভূত, এবং ভিয়েনার মনঃসমীক্ষণ এ্যাডলারের এ্যাডলারীয় মনস্তত্ত্ব ভিত্তিক will to power বা শক্তির প্রতি ইচ্ছাশক্তির বিপরীতে striving for superiority বা শ্রেষ্ঠত্বের সংগ্রাম শব্দটির দিকে নজর দেওয়া হয়েছে।

অর্থ’র প্রতি ইচ্ছাশক্তি (THE WILL TO MEANING)

একজন মানুষের অর্থ অনুসন্ধান তার জীবনের প্রাথমিক অনুপ্রেরণা এবং এটি কোনো সহজাত প্রেরণার “গৌণ যৌক্তিকতা” নয়। এই অর্থ অনুপম বা একক এবং তাতে নির্দিষ্ট যা কেবলই একজন মানুষের দ্বারা পরিপূর্ণ করা প্রয়োজন ও পরিপূর্ণ যেতে পারে। কেবল তখনই তা তাৎপর্য অর্জন করে যা তার নিজের অর্থের প্রতি ইচ্ছাশক্তিকে সন্তুষ্ট করে। অনেক লেখকের বিতর্ক মতে অর্থ আর মূল্যবোধ “defense mechanisms  বা প্রতিরক্ষা কৌশল, প্রতিক্রিয়া গঠন (reaction formation বা আপনি যা অনুভব করছেন তার বিপরীতে আচরণ করা) ও ঊর্ধ্বপাতন (sublimation বা “মন্দ তাড়না সমূহকে” ইতিবাচক এবং উৎপাদনশীল কার্যক্রমে পরিণত করা) ব্যতীত আর কিছু নয়”। কিন্তু আমার নিজের কথা বলতে গেলে, আমি কেবলমাত্র আমার defense mechanism বা “প্রতিরক্ষা কৌশল”র  নিমিত্তে বাঁচতে চাইবো না, কেবল “প্রতিক্রিয়া গঠন” এর নিমিত্তেও আমি মরতে প্রস্তুত নয়। যাইহোক, মানুষ তার আদর্শ আর মূল্যবোধের নিমিত্তে মরতেও সক্ষম!

কয়েক বছর আগে ফ্রান্সে একটি জনমত জরিপ চালানো হয়েছিল। ফলাফলে দেখা যায় যে ৮৯ শতাংশ মানুষ স্বীকার করে যে মানুষের বেঁচে থাকার জন্য নিমিত্তে “কিছু” প্রয়োজন। অধিকন্তু, ৬১ শতাংশ মানুষ স্বীকার করে যে তাদের জীবনে এমন কিছু বা এমন কেউ ছিল যার জন্য বা যাদের জন্য তারা এমনকি মরতেও প্রস্তুত ছিল। ভিয়েনার হাসপাতাল বিভাগে রোগী ও কর্মীদের মাঝে এই জরিপের পুনরাবৃত্তি করছিলাম, আর বাস্তবিকপক্ষে ফলাফল ফ্রান্সে হাজার হাজার মানুষের মানুষের মাঝে প্রদর্শিত ফলাফলের সাথে মিলে গিয়েছিল; ভিন্নতা ছিল মাত্র ২ শতাংশ।

আমেরিকার জন্স হপস্কিন্স বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজ-বিজ্ঞানীদের দ্বারা আট-চল্লিশটি কলেজের ৭,৯৪৮ ছাত্রছাত্রীদের উপর আরেকটি পরিসংখ্যানগত জরিপ চালানো হয়েছিল। তাদের প্রাথমিক প্রতিবেদনটি ন্যাশনাল ইন্সটিটিউট অফ মেন্টাল হেলথ এর অর্থায়নে একটি দু’বছর মেয়াদী গবেষণার অংশ। তাদের বিবেচনায় “সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ” কি প্রশ্ন করা হলে, ১৬ শতাংশ ছাত্রছাত্রী “অনেক অর্থ উপার্জন করা” কে বেছে নেয়; ৭৮ শতাংশ  ছাত্রছাত্রী বলেছিল তাদের প্রথম লক্ষ্য হলো “আমার জীবনে কোনো উদ্দেশ্য এবং অর্থ খুঁজে পাওয়া”।

নিঃসন্দেহে, এমন কোনো ঘটনাও থাকতে পারে যেখানে মূল্যবোধের বিষয়ে কোনো ব্যক্তির উদ্বিগ্নতা আসলে অভ্যন্তরীণ গুপ্ত দ্বন্দ্বের ছন্দ-বেশ; কিন্তু যদি তাই হয়ে থাকে তাহলে তা নিয়মের চেয়ে নিয়মের ব্যতিক্রমের প্রতিনিধিত্ব করে। এসব ঘটনায় আমাদেরকে প্রকৃতপক্ষে pseudo-value বা ভ্রান্ত-মূল্যবোধের মোকাবিলা করতে হবে, এবং সত্যিকার অর্থে তাদের মুখোশ খুলে দিতে হবে। কিন্তু একজন মানুষের মাঝে যা খাঁটি ও অকৃত্রিম – যেমন একজন মানুষের যতটা সম্ভব অর্থবহ জীবনের বাসনা – তার মুখোমুখির হওয়ার সাথে সাথেই একজন মানুষকে মুখোশ খুলে দেওয়া থামিয়ে দেওয়া উচিৎ। তখন যদি তা থামিয়ে দেওয়া না হয়, তাহলে একজন “unmasking psychologist” বা মুখোশ খুলে দেওয়ার মনোবিদ আসলে যে জিনিসটির মুখোশ খুলে দেয় তা হলো তার নিজের “গুপ্ত অভিপ্রায়” – যেমন, মানুষের মাঝে যা  কিছু অকৃত্রিম, যা কিছু অ-কৃত্রিমভাবে মানবিক তাকে অপভ্রষ্ট ও অবমূল্যায়ন করার জন্য তার চৈতন্যহীন প্রয়োজনীয়তা। 

অস্তিত্বের নিষ্ফলতা বা ব্যর্থতা  (EXISTENTIAL FRUSTRATION)

জীবনের অর্থ’র প্রতি মানুষের ইচ্ছাশক্তি হতাশও হতে পারে, যেখানে লগোথেরাপি অস্তিত্বের নিষ্ফলতা বা ব্যর্থতা সম্পর্কে কথা বলে। “existential” বা ‘অস্তিত্বগত’ শব্দটি তিনটি উপায়ে ব্যবহৃত হতে পারে: (১)স্বয়ং অস্তিত্বকে বোঝাতে, যেমন, বিশেষত মানব অস্তিত্বের অবস্থা; (২) অস্তিত্বের অর্থ বা তাৎপর্য; ও (৩) কারো অস্তিত্বে বা জীবনে মূর্ত অর্থ বা তাৎপর্য খুঁজ করার প্রচেষ্টা, তা বলতে গেলে অর্থ’র প্রতি ইচ্ছাশক্তি। অস্তিত্বের নিষ্ফলতা বা জীবনের ব্যর্থতা  স্নায়ুবৈকল্যে পরিণত হতে পারে। স্নায়ুবৈকল্য শব্দটি প্রচলিত অর্থ, যেমন psychogenic neurosis বা মস্তিষ্ক সৃষ্ট স্নায়ুবৈকল্য, এর বিপরীতে এধরনের স্নায়ুবৈকল্যের জন্য লগোথেরাপি একটি নতুন শব্দ উদ্ভাবন করেছে। যার নাম হলো “noögenic neuroses” । noögenic স্নায়ুবৈকল্যের উৎস psychological বা মনস্তাত্ত্বিক নয় বরং মানব অস্তিত্বের বা মানব জীবনের noölogical (গ্রিক শব্দ noös  মানে মন) ব্যাপ্তির মাঝে। (noology বা নওলজি হলো মন ও চিন্তা-ভাবনার সাথে সম্পৃক্ত শিক্ষার শাখা)। এটি আরেকটি লগোথেরাপিউটিক বা লগোথেরাপি চিকিৎসা বিষয়ক শব্দ যা বিশেষভাবে মানব ব্যাপ্তি সংক্রান্ত যেকোনো কিছুকে বোঝায়।

NOÖGENIC স্নায়ুবৈকল্য (NOÖGENIC NEUROSES)

প্রেরণা আর সহজাতের মধ্যে দ্বন্দ্ব থেকে NOÖGENIC স্নায়ুবৈকল্যের উত্থান হয় না, তবে অস্তিত্ত্বগত সমস্যা থেকে তার উত্থান হয়। এরকম সমস্যার মধ্যে জীবনরে অর্থ’র প্রতি ইচ্ছাশক্তির ব্যর্থতা এক বড় ভূমিকা পালন করে।

এটা স্পষ্ট যে নওজেনিক ঘটনায় যথাযথ ও পর্যাপ্ত থেরাপি বা চিকিৎসা সাধারণ অর্থে psychotherapy বা  মনস্তাত্ত্বিক চিকিৎসা নয় কিন্তু লগোথেরাপি (অর্থ-চিকিৎসা); এটি এমন এক থেরাপি বা চিকিৎসা যা বিশেষভাবে মানব ব্যাপ্তিতে প্রবেশের সাহস করে।

আমি নিচের ঘটনাটি উল্লেখ করছি: একজন উচ্চ-পদস্থ আমেরিকান কূটনৈতিক ভিয়েনায় আমার অফিসে এসেছিলেন যাতে তিনি psychoanalytic বা মনঃসমীক্ষণমূলক চিকিৎসা চালিয়ে যেতে পারেন যা তিনি পাঁচ বছর পূর্বে নিউ ইয়র্কের একজন বিশ্লেষক দিয়ে শুরু করেছিলেন। শুরুতেই আমি তাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম কেনো তিনি নিজেকে বিশ্লেষণ করার চিন্তা করেছেন, প্রথম দিকে তার বিশ্লেষণ কেনো শুরু করা হয়েছিল। বোঝা গেলো যে রোগী তার ক্যারিয়ার নিয়ে অসন্তুষ্ট ছিলেন এবং আমেরিকান পররাষ্ট্র নীতি মেনে চলা ছিল তার পক্ষে সবচেয়ে কষ্টকর। যদিও তার বিশ্লেষক তাকে বার বার বলেছিলেন যে তার বাবার সাথে তার সম্পর্কের পুঃস্থাপনের চেষ্টা করা উচিৎ; কারণ তার কাছে যুক্তরাষ্ট্র সরকার এবং তার ঊর্ধ্বতন ব্যক্তিরা তার পিতার “চিত্র ব্যতীত” আর কিছুই ছিল না। ফলশ্রুতিতে, তার চাকরীর সাথে তার অসন্তোষের কারণ ছিল তার বাবার প্রতি অবচেতনভাবে লালিত ঘৃণা। পাঁচ বছর ধরে চলতে থাকা এক বিশ্লেষণের মধ্য দিয়ে রোগীকে তার বিশ্লেষকের ব্যাখ্যাকে গ্রহণ করার জন্য বার বার অনুরোধ করা হয়েছিল যতক্ষণ না অবশেষে তিনি বাস্তবতাকে বুঝতে সমর্থ হয়েছিলেন। কয়েকটি সাক্ষাৎকারের পর পরিষ্কার হয়ে উঠেছিল যে অর্থ’র প্রতি তার ইচ্ছাশক্তি তার পেশার দরুন ব্যর্থ হয়েছিল, এবং তিনি আসলে অন্য কোনো কাজের সাথে নিয়োজিত করার আকাঙ্খা করছিলেন। ভিন্ন চাকরী শুরু করার জন্য যেহেতু তার বর্তমান চাকরী ছেড়ে না দেওয়ার পেছনে কোনো কারণ ছিল না, তাই তিনি চাকরীটি ছেড়ে দিয়ে নতুন চাকরী শুরু করলেন, যা তিনি সবচেয়ে সন্তোষজনক ফলাফল নিয়েই তা করেছিলেন। তার এই নতুন পেশায় তিনি পাঁচ বছরেরও অধিক সময় সন্তুষ্ট থাকেন, যেমনটি তিনি সাম্প্রতিক বিবৃতিতে বলেছিলেন। এক্ষেত্রে আমি সন্দেহ করি যে, আমি কোনো না কোনোভাবে কোনো এক স্নায়ুবৈকল্য রোগীর অবস্থার সাথে বোঝাপড়া করছিলাম, আর সেইজন্য আমি ভেবে নিয়েছিলাম যে তার কোনো psychotherapy বা  মনস্তাত্ত্বিক চিকিৎসা, বা এমনকি লগোথেরাপির প্রয়োজন নাই।

কারণ প্রকৃতপক্ষে তিনি কোনো রোগী ছিলেন না। সব সংঘাতই অবধারিতভাবে স্নায়ুবৈকল্য রোগ নয়; কিছুটা সংঘাত স্বাভাবিক ও স্বাস্থ্যকর। একই অর্থে যন্ত্রণাভোগ সব সময়ই একটি pathological phenomenon বা রোগগত ঘটনা নয়। বরং স্নায়ুবৈকল্যের কোনো উপসর্গের চেয়ে যন্ত্রণাভোগ হতে পারে মানুষের এক ভালো অর্জন, বিশেষকরে সে যন্ত্রণাভোগ যদি অস্তিত্বের ব্যর্থতা থেকে সৃষ্টি হয়। আমি কঠোরভাবে অস্বীকার করবো যে কারো অস্তিত্ব বা জীবনের অর্থ’র সন্ধান, বা এ সম্পর্কে তার সন্দেহ, সব ক্ষেত্রে যেকোনো অসুস্থতার ফলে বা অসুস্থতা থেকে নির্গত নয়। স্বয়ং অস্তিত্বের নিষ্ফলতা বা ব্যর্থতা প্যাথোলজিকল বা pathogenic বা রোগ সৃষ্টিতে সক্ষম নয়। একজন মানুষের জীবনের সার্থকতা সম্পর্কে উদ্বিগ্নতা, এমনকি তার হতাশাও একটি অস্তিত্ত্বগত বেদনা বা যন্ত্রণা কিন্তু কোনোভাবেই একটি মানসিক রোগ নয়। এটা এমন হতে পারে যে হতাশাকে উদ্বিগ্নতার নিরিখে ব্যাখ্যা একজন চিকিৎসক তার রোগীর অস্তিত্বের হতাশাকে প্রশান্তিদায়ক এক ঔষধের স্তূপের নিচ করব দিতে অনুপ্রাণিত করে। এটা বরং তারই কাজ যে তিনি রোগীকে তার বিকাশ ও উন্নয়নের অস্তিত্বের সংকটের মধ্যদিয়ে পথপ্রদর্শন করবেন।

লগোথেরাপি এর কাজকে কোনো রোগীকে তার জীবনের অর্থ সন্ধানের সহায়তা করা হিসেবে বিবেচনা করে। লগোথেরাপি যতটা না তাকে তার অস্তিত্বের বা জীবনের গুপ্ত logos বা অর্থ সম্পর্কে সচেতন করে তুলে, তারচেয়েও এটি একটি বিশ্লেষণধর্মী প্রক্রিয়া। এই পরিসরে লগোথেরাপির সাথে মনঃসমীক্ষণের মিল রয়েছে। তবে, কোনো কিছু সম্পর্কে পুনরায় আত্মসচেতন করে তোলার জন্য লগোথেরাপি প্রচেষ্টার কর্মকাণ্ড কোনো ব্যক্তির মধ্যে অবচেতন সহজাত বাস্তবতার মধ্যে সীমিত থাকে না কিন্তু অস্তিত্বগত বাস্তবতার দিকেও মনোযোগ দেয়, যেমন তার অস্তিত্বের বা জীবনের সম্ভাব্য অর্থ এবং অর্থ’র প্রতি ইচ্ছাশক্তিকে সিদ্ধ করা। যাহোক, যে কোনো বিশ্লেষণ তার সত্তার গভীরে সে প্রকৃতপক্ষে কিসের আকাঙ্ক্ষা করে তার সম্পর্কে রোগীকে সচেতন করে তোলার চেষ্টা করে, এমনকি যখন তা থেরাপিউটিক বা চিকিৎসাগত প্রক্রিয়ায় (noölogical) নওলজিকল ব্যাপ্তিকে সংযুক্ত থেকে বিরত থাকে  তখনও। মনঃসমীক্ষণ বা মনঃ-বিশ্লেষণ থেকে লগোথেরাপির বিচ্যুতি ঘটে যতটা তা মানুষকে এক সত্ত্বা হিসেবে যার প্রধান উদ্বেগ বরং নিছক পরিতৃপ্তি ও প্রেরণা আর প্রবৃত্তির সন্তুষ্টি চেয়ে কোনো অর্থ পরিপূর্ণতায় নিহিত থাকে বলে বিবেচনা করে, বা  নিছকভাবে id (মনের যে অংশে নিজ সহজাত তাড়না ও প্রাথমিক প্রক্রিয়া সমূহ  প্রকাশ পায়), ego (অহংবোধ) ও superego বা অধ্যহং (বা মনের যে অংশ বিবেক ও নীতিবোধের আহ্বানে সাড়া দেয়) এর সাংঘর্ষিক দাবি সমূহের পুনঃস্থাপনের মধ্যে বলে বিবেচনা করে, বা বিবেচনা করা নিছক সমাজ আর পরিবেশের প্রতি অভিযোজন ও সমন্বয়সাধনে মধ্যে বলে। 

 নো ডাইনামিক্স (NOÖ-DYNAMICS)

নিশ্চয়ই, মানুষের অর্থ সন্ধান আভ্যন্তরীণ ভারসাম্যের চেয়ে অভ্যন্তরীণ স্নায়বিক চাপকে জাগ্রত করতে পারে। যদিও, এরকম অবিকল স্নায়বিক চাপ মানসিক স্বাস্থ্যের এক অপরিহার্য পূর্বশর্ত। আমি সাহস করে বলতে চাই যে কারো জীবনে যে অর্থ রয়েছে সে সম্পর্কে অবগত হওয়ার মতো পৃথিবীতে আর কোনো কিছুই নাই যা কোনো মানুষকে এমনকি সবচেয়ে খারাপ পরিস্থিতিতেও বেঁচে থাকার জন্য কার্যকরভাবে সাহায্য করতে পারে। এই সম্পর্কে ফ্রেড্রিক নিৎসের কথায় অনেক প্রজ্ঞা রয়েছে। তিনি বলেন, “যার ‘কেন’ বেঁচে থাকতে হবে তার কারণ রয়েছে সে প্রায় যে কোন ‘উপায় বা কিভাবে’কে সহ্য করতে সক্ষম”। এই বাক্যগুলিতে আমি একটি মন্ত্র দেখতে পায়, যাতে যেকোনো মনস্তাত্ত্বিক চিকিৎসার সত্যতা রয়েছে। নাৎসি বন্দী শিবিরে কেউ লক্ষ্য করে থাকবে যে, যে সব লোক বুঝতে পেরেছিল যে শেষ করার মতো কোনো কাজ তাদের জন্য অপেক্ষা করছিল তারাই বেঁচে থাকার জন্য সবচেয়ে বেশি উপযুক্ত ছিল। বন্দী শিবিরের উপর লিখা অন্যান্য পুস্তকের লেখকেরাও একই সিদ্ধান্তে পৌঁছান তখন থেকে। জাপান, উত্তর কোরিয়া ও দক্ষিণ ভিয়েতনামের যুদ্ধ-বন্দীদের শিবিরে মনোচিকিৎসা বিষয় অনুসন্ধানও একই উপসংহারে পৌঁছাতে সক্ষম হয়।

আমার বেলায়, আমাদের যখন অশউইৎসের বন্দী শিবিরে নেওয়া হয়েছিল, প্রকাশের জন্য প্রস্তুত আমার এক পাণ্ডুলিপি আমার কাছ থেকে ছিনিয়ে নেওয়া হয়েছিল। নিঃসন্দেহে এই পাণ্ডুলিপিকে নতুন করে লিখার গভীর বাসনা আমাকে শিবিরে আমি যে কঠোরতার মধ্যে ছিলাম তা থেকে বেঁচে থাকতে সাহায্য করেছিল। উদাহরণসরূপ, বাভারিয়া শিবিরে যখন আমি টাইফাস রোগে আক্রান্ত হয়ে অসুস্থ হয়ে পড়েছিলাম, তখন পাণ্ডুলিপিটি পুনরায় লিখতে নিজেকে সক্ষম করার উদ্দেশ্যে ছোট ছোট কাগজের টুকরায় আমি অসংখ্য মন্তব্য-মতামত সংক্ষেপে টুকে রেখেছিলাম, মুক্তির দিন পর্যন্ত আমাকে বাঁচতে হবে। আমি নিশ্চিত যে বাভারিয়ান এক বন্দী শিবিরের ছাউনির অন্ধকারে আমার হারিয়ে যাওয়া পাণ্ডুলিপির পুনর্গঠন আমাকে হৃদযন্ত্র-জনিত কারণে ভেঙ্গে পড়ার বিপদ অতিক্রম করায় সাহায্য করেছিল।

এভাবে, দেখা যায় যে মানসিক স্বাস্থ্য এক নির্দিষ্ট মাত্রার স্নায়ুবিক চাপের উপর নির্ভর করে, একজন মানুষ যা ইতিমধ্যে অর্জন করেছে এবং এখনও সম্পাদন করা উচিৎ তাদের মাঝে, অথবা একজন মানুষ এখন কে এবং তাকে কি হওয়া উচিৎ তার মধ্যে বিভেদের স্নায়ুবিক চাপ। এধরনে চাপ বা টেনশন মানুষের মধ্যে বিদ্যমান সহজাত আর সেজন্যে মানসিক কল্যাণের জন্য তা অপরিহার্য। মানুষকে তার সম্ভাব্য অর্থ পূর্ণ করার প্রক্রিয়ার মুখোমুখি করাতে আমাদের দ্বিধাগ্রস্ত হওয়া উচিৎ নয়। কেবল এভাবেই আমরা জীবনের অর্থ’র প্রতি তার ইচ্ছাশক্তিকে সুপ্তাবস্থা থেকে জাগিয়ে তুলতে পারি। প্রথমেই মানুষের যা প্রয়োজন তা হলো ভারসাম্য এরকম অনুমানকে আমি এক মানসিক স্বাস্থ্যবিধির মারাত্মক ভুল ধারণা হিসেবে বিবেচনা করি বা, জীববিজ্ঞানে যাকে বলা হয় homeostasis (হোমিওস্টেসিস বা ব্যুৎপত্তি ) যে প্রক্রিয়ার মাধ্যমে দেহের ভেতরের অবস্থাকে একই রাখার জন্য দেহ পরিবর্তনের প্রতি যে প্রতিক্রিয়া করে, যেমন, চাপহীন অবস্থা। মানুষের আসলে যা প্রয়োজন তা চাপহীন অবস্থা বা homeostasis নয় কিন্তু এক সার্থক লক্ষ্যের জন্য প্রচেষ্টা ও সংগ্রাম করা, যা একটি মুক্তভাবে নির্বাচিত কর্ম। তার যা প্রয়োজন তা যেকোনো মূল্যে স্নায়ুবিক চাপ থেকে মুক্তি পাওয়া নয়, কিন্তু তার দ্বারা পূর্ণ হওয়ার অপেক্ষমাণ এক সম্ভাব্য অর্থ’র আহ্বান শোনা। মানুষের যা প্রয়োজন তা homeostasis নয় বরং তার যা প্রয়োজন তা হলো, যাকে আমি noödynamics বলি, যেমন, চাপের বিপরীতধর্মী ক্ষেত্রে অস্তিত্বগত বা অস্তিত্বের সক্রিয় শক্তি যেখানে এক মেরুকে পূর্ণ করার জন্য অর্থ দ্বারা প্রতিনিধিত্ব করা হয়েছে এবং অন্য মেরুকে প্রতিনিধিত্ব করা হয়েছে যে অর্থ’কে পূর্ণ করবে সে মানুষটি দ্বারা। আর কারো চিন্তা করা উচিৎ নয় যে এটি কেবল স্বাভাবিক পরিস্থিতির জন্য সত্য। স্নায়ুবৈকল্য ব্যক্তিদের মাঝে তা আরও বেশি সু-যুক্তিপূর্ণ। যদি স্থপতিরা কোনো জরাজীর্ণ তোরণকে শক্তিশালী করতে চাই, তাহলে তারা এর উপর স্থাপন করা বোঝা বৃদ্ধি করে, কারণ তাতে করে অংশ সমূহকে অধিকতর দৃঢ়ভাবে একত্রে সংযুক্ত করা হয়। তাই, থেরাপিস্টরা যদি তাদের রোগীদের মানসিক স্বাস্থ্যকে লালন করতে চাই, তাহলে তাদের কারো জীবনের অর্থ’র দিকে পুণঃঅভিমুখীকরণের মাধ্যমে এক নির্ভরযোগ্য পরিমাণের চাপ সৃষ্টি করাকে ভয় পাওয়া উচিৎ নয়।

অর্থ অভিমুখীকরণের উপকারী প্রভাব দেখিয়ে, আমি সেই অনুভূতির ক্ষতিকারক প্রভাব, যার সম্পর্কে আজ অনেক রোগী অভিযোগ করে, তার দিকে ফিরবো, যেমন তাদের জীবনের সর্বাত্মক ও চূড়ান্ত অর্থ-হীনতার অনুভূতি। তারা বেঁচে থাকার যোগ্য অর্থ সম্পর্কে সচেতনতা নয়। তাদের অভ্যন্তরীণ শূন্যতার অভিজ্ঞতা দ্বারা তারা ভূতগ্রস্ত, নিজেদের মধ্যকার এক শূন্যতা; তারা এমন এক পরিস্থিতি দ্বারা ধরাশায়ী যাকে আমি existential vacuum বা “অস্তিত্বগত শূন্যতা” আখ্যা দিয়েছি।            

অস্তিত্ত্বগত শুন্যতা (THE EXISTENTIAL VACUUM)

অস্তিত্বগত শূন্যতা বা অস্তিত্বের শূন্যতা বিংশ শতাব্দীর এক সুদূরপ্রসারী ঘটনা। বিষয়টি বোঝা যায়। একজন মানুষের মানুষ হয়ে উঠার পর থেকেই তাকে যে দ্বিগুণ ক্ষয়-ক্ষতির মধ্যদিয়ে যেতে হয় হয়তো তাই তার কারণ। মানব ইতিহাসের শুরুতেই মানুষ কিছু মৌলিক জৈবিক সহজাত-প্রবৃত্তি হারিয়ে ফেলে, যেখানে জৈবিক আচরণ বিদ্যমান এবং যার মাধ্যমে তা সুরক্ষিত থাকে। এরকম সুরক্ষা, স্বর্গের ন্যায়, সারাজীবন মানুষের কাছাকাছি রয়েছে। তার জন্য মানুষকে সিদ্ধান্ত নিতে হয়। যদিও, তার পাশাপাশি মানুষ তার সাম্প্রতিক বিকাশে আরও এক ক্ষতির সম্মুখীন হয় যতটা ক্ষতির সম্মুখীন হয় তার আচার-আচরণ গড়ে তোলা ঐতিহ্যের দ্রুত হ্রাস পাওয়ার কারণে। কোনো সহজাত-প্রবৃত্তি আর তাকে কি করতে হবে তা জানান দেয় না, আর কোনো ঐতিহ্যই তাকে বলে না তাকে কি করা উচিৎ; মাঝে মাঝে সে জানে না সে আসলে কি করতে চাই। তার চেয়ে বরং সে হয় অন্য লোকেরা যা করে তার অনুকরণ করতে চাই (conformism), নতুবা অন্য লোকেরা তাকে যা করাতে চাই তাই সে করে (totalitarianism)।

সম্প্রতি এক পরিসংখ্যান তদন্তে প্রকাশ করেছে যে আমার ইউরোপীয় ছাত্রছাত্রীদের মাঝে, ২৫ শতাংশ ছাত্রছাত্রী কম-বেশী এক চিহ্নিত মাত্রার অস্তিত্বগত শূন্যতা বা জীবনের অর্থ-হীনতা লক্ষ্য করা যায়। আমার আমেরিকান ছাত্রছাত্রীদের মাঝে তা ২৫ নয়, বরং ৬০ শতাংশ ছিল। 

একঘেয়েমি পরিস্থিতিতেই অস্তিত্বগত শূন্যতা স্বয়ং পরিলক্ষিত হয়। এখন আমরা জার্মান দার্শনিক আর্থার শওপেনহাওয়ারকে বুঝতে পারি যখন তিনি বলেছিলেন যে মানবজাতি স্পষ্টতই চিরকাল মর্মপীড়া আর একঘেয়েমির দু’টি প্রান্তের মাঝে আন্দোলিত করার বা দোদুল্যমান থাকার ভাগ্য নির্ধারিত হয়ে গেছে। প্রকৃত সত্যে, মর্মপীড়ার চেয়ে একঘেয়েমি এখন সমাধানের আরও সমস্যার সৃষ্টি করছে, এবং নিঃসন্দেহে মনঃচিকিৎসকের দ্বারস্থ করছে। আর এ সমস্যা ক্রমবর্ধমানভাবে গুরুতর হয়ে উঠছে, কারণ ক্রমবর্ধমান যন্ত্রপাতি এবং তার ব্যবহার (automation) সম্ভবত সাধারণ শ্রমিকদের জন্য সহজলভ্য অবসর সময়ের প্রকাণ্ড বৃদ্ধির দিকে ধাবিত করবে। দুঃখের বিষয় হলো এদের অনেকেই তাদের সমস্ত নতুন করে পাওয়া অবসর সময় নিয়ে কি করতে হবে তা জানবে না।

উদাহরণ সরূপ আমরা বিবেচনা করতে পারি, Sunday neurosis বা “রবিবারের স্নায়ুবৈকল্য”, যখন সপ্তাহের ব্যস্ততার হিড়িক শেষ হয়ে যায় ও নিজেদের মাঝে শূন্যতা সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে তখন যারা তাদের জীবনের সন্তুষ্টিহীনতা সম্পর্কে সচেতন হয়ে উঠে তাদের এ ধরনের হতাশা পীড়িত করে। অনেক আত্মহত্যার ঘটনার পেছনে রয়েছে অস্তিত্বগত শূন্যতা বা জীবনের অর্থ-হীনতা। বিষণ্ণতা, আগ্রাসন আর মাদকাসক্তির মতো বিস্তৃত ঘটনা বোধগম্য নয় যদি না আমরা তাদের পেছনে অস্তিত্বগত শূন্যতাকে অনুধাবন করতে পেরেছি। আর এটি কয়েদী এবং বয়োবৃদ্ধি লোকদের সংকটের বেলায়ও সত্যি।

অধিকন্তু, অস্তিত্বগত শূন্যতা প্রকাশের বিভিন্ন মুখোশ ও ছদ্মবেশ রয়েছে। মাঝে মধ্যে জীবনের অর্থ’র প্রতি হতাশ ইচ্ছাশক্তি (will to meaning) প্রাতিনিধিকভাবে ‘শক্তি’র প্রতি ইচ্ছাশক্তি (will to power) দ্বারা ক্ষতিপূরণ করা হয়, অর্থের (টাকা-পয়সা) প্রতি ইচ্ছাশক্তি (will to power) হলো সবচেয়ে আদিম প্রকৃতির ‘শক্তি’র প্রতি ইচ্ছাশক্তি। অন্যান্য ক্ষেত্রে, সুখের/আনন্দের প্রতি ইচ্ছাশক্তি অর্থ’র প্রতি হতাশ ইচ্ছাশক্তির স্থান দখল করে। সেইজন্যে, অস্তিত্বগত হতাশা প্রায়শই যৌন খেসারতে রূপ নেই। এরকম ঘটনায় আমরা লক্ষ্য করি যে অস্তিত্বগত শূন্যতায় যৌন কামেচ্ছা (sexual libido) অনিয়ন্ত্রিত হয়ে উঠে।

স্নায়ুবৈকল্যজনিত ঘটনায় এক অনুরূপ ঘটনা ঘটে। নির্দিষ্ট কিছু feedback mechanism ও দুষ্টচক্র (vicious-circle) বিন্যাস রয়েছে, যার সম্পর্কে আমি পরবর্তীতে আলোচনা করবো। যাহোক, কেউ বার বার লক্ষ্য করে থাকতে পারে যে, এই লক্ষণ-বিদ্যা (symptomatology) এক অস্তিত্বগত শূন্যতাকে আক্রমণ করেছে, যেখানে তারপর তা বৃদ্ধি পেতে থাকে। এধরনের রোগীদের মধ্যে যে জিনিসটির সাথে আমাদের মোকাবিলা করতে হবে তা কোনো নওজেনিক স্নায়ুবৈকল্য (noögenic neurosis) নয়। যাইহোক, রোগীকে তার অবস্থা অতিক্রম করাতে আমরা কখনও সফল হবো না, যদি না আমরা লগোথেরাপির সাথে সাইকোথেরাপিউটিক চিকিৎসার সংযোজন করে থাকি। কারণ অস্তিত্বগত শূন্যতা বা জীবনের শূন্যতাকে পূর্ণ করার মাধ্যমে, রোগীকে রোগের অধিকতর পুনরাক্রমণ পীড়া থেকে বিরত রাখা হয়। সেজন্যে, লগোথেরাপি কেবল নওজেনিক ঘটনা বা পরিস্থিতিতে নির্দেশিত করা হয় না, যেমনটি উপরে ইঙ্গিত করা হয়েছে, বরং psychogenic বা মস্তিষ্ক সৃষ্ট রোগের ক্ষেত্রেও নির্দেশিত। আর মাঝে মাঝে somatogenic (pseudo-ছদ্মবেশী স্নায়ুবৈকল্য) neuroses বা শরীরে উৎস, শরীরকে আক্রান্ত বা শরীরের মাধ্যমে কাজ করা স্নায়ুবৈকল্যের জন্যও নির্দেশিত। এই দৃষ্টিকোণ থেকে দেখে, এক সময় অস্ট্রিয়ান মনোবিজ্ঞানী মাগদা বি. আরনল্ড বলেছিলেন, “প্রতিটি থেরাপিকেই কোনো না কোনো উপায়ে, কতোটা সীমাবদ্ধ তা কোনো বিষয় নয়, হতে হবে লগোথেরাপি”। 

তার জীবনের অর্থ কি জানতে চাওয়া এমন এক রোগীর জন্য আমরা কি করতে পারি এখন তা বিবেচনা করা যাক।

জীবনের অর্থ (THE MEANING OF LIFE)

সাধারণ অর্থে একজন ডাক্তার এ প্রশ্নের উত্তর দিতে পারবে কিনা সে সম্পর্কে আমার সন্দেহ রয়েছে। কারণ ভিন্ন মানুষের কাছে, ভ্ন্নি দিনে ও ভিন্ন মুহূর্তে জীবনের অর্থও ভিন্ন হয়ে থাকে। তাই, যে জিনিসটি আসল বিষয় তা কিন্তু সাধারণ অর্থে জীবনের অর্থ নয় বরং প্রদত্ত কোনো বিশেষ মুহূর্তে একজন মানুষের জীবনের নির্দিষ্ট অর্থ’ই আসল বিষয়। সাধারণ অর্থে প্রশ্নটি একজন দাবা বিজয়ীর কাছে ছুড়ে মারার সমতুল্য: “গুরু,আমাকে বলুন তো পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ (দাবার) চাল কোনটি”? কোনো খেলায় নির্দিষ্ট এক অবস্থা এবং কারো প্রতিপক্ষের নির্দিষ্ট বৈশিষ্ট্য (বা ব্যক্তিত্ব) ব্যতীত শ্রেষ্ঠ বা এমনকি ভাল চাল বলতে আসলে কিছুই নেই। মানব অস্তিত্ব বা মানব জীবনের বেলাও একই হয়ে থাকে। কারো উচিৎ না জীবনের বিমূর্ত অর্থ বা মানের (abstract meaning of life) সন্ধান করা। প্রত্যেকেরই জীবনে মূর্ত কাজ সম্পাদনের জন্য তার নিজের নির্দিষ্ট বৃত্তি (vocation) বা উদ্দেশ্য (mission) রয়েছে যা পূর্ণতার দাবি করে। সেখানে তাকে প্রতিস্থাপন করা যাবে না, যাবেন না জীবনকে পুনরাবৃত্ত করা। এভাবে, প্রত্যেকের কাজই অনুপম, অনুপম তার কাজের বাস্তবায়নের নির্দিষ্ট সুযোগও।

প্রতিটি পরিস্থিতি যেহেতু একজন মানুষের কাছ প্রতিবন্ধকতার প্রতিনিধিত্ব করে এবং সমাধানের জন্য কোনো সমস্যা উপস্থিত করে, জীবনের অর্থ সম্পর্কিত প্রশ্নটিকে প্রকৃতপক্ষে উল্টিয়ে করা যেতে পারে। অবশেষে, মানুষকে তার জীবনের অর্থ কি জিজ্ঞেস করা উচিৎ নয়, বরং তাকে অনুধাবন করতে হবে যে যেন প্রশ্নটা তাকেই করা হয়েছে। এক বাক্যে বলতে গেলে, প্রত্যেক মানুষই তার জীবন দ্বারা প্রশ্নবিদ্ধ। এবং কেবল তার নিজের জীবনের জন্য উত্তর দেওয়ার মাধ্যমে সে জীবনের সেই প্রশ্নের প্রতি সাড়া দিতে পারে; কেবল দায়বদ্ধ হওয়ার মাধ্যমে জীবনের প্রতি সে সাড়া দিতে পারে। এভাবে, লগোথেরাপি দায়বদ্ধতার মাঝে মানব অস্তিত্বের (জীবনের) একান্ত সারমর্ম দেখতে পায়।

অস্তিত্বের (জীবনের) সারমর্ম (THE ESSENCE OF EXISTENCE)

দায়বদ্ধতার উপর এই জোর লগোথেরাপির স্পষ্ট আশু-কর্তব্যে প্রতিফলিত হয়েছে, যা হচ্ছে: “বেঁচে থাকুন যেন আপনি ইতিমধ্যেই দ্বিতীয় বারের মতো জীবন-যাপন করছেন এবং আপনি যেমন এখন ভুলভাবে আচরণ করতে যাচ্ছেন ঠিক একই আচরণ যেন আপনি প্রথমবার করেছিলেন”! আমার কাছে মনে হয় এমন কোনো কিছুই নাই যা একজন মানুষের দায়বদ্ধতা বোধকে এই প্রবাদবাক্যের চেয়ে বেশি উদ্দীপ্ত করবে, যা প্রথমত তাকে কল্পনা করতে আহ্বান জানায় যে বর্তমান আসলে অতীত এবং, দ্বিতীয়ত, যে অতীত এখনও পরিবর্তিত ও সংশোধিত হতে পারে। এরকম এক হিতোপদেশ তাকে জীবনের সসীমতা’র এবং সে তার জীবন ও নিজের মধ্য থেকে কি উৎপন্ন করে তার চূড়ান্ত অবস্থার মুখোমুখি করে।

লগোথেরাপি রোগীকে তার নিজের দায়বদ্ধতা সম্পর্কে পরিপূর্ণভাবে সচেতন করে তোলার চেষ্টা করে; তাই, কি জন্য, কিসের প্রতি, বা কার কাছে সে নিজেকে দায়বদ্ধ ভাবে তার উপায় তার কাছে রাখা উচিৎ। সেজন্যে একজন লগোথেরাপিষ্ট বা লগোথেরাপি চিকিৎসক সকল সাইকোথেরাপিস্টদের মাঝে তার রোগীর উপর ভালো-মন্দের রায় চাপিয়ে দিতে সবচেয়ে কম প্রলোভিত, কারণ সে কখনওই রোগীকে চিকিৎসকের কাছে বিচার করার দায় স্থানান্তরের অনুমতি দেয় না।

তাই সমাজের প্রতি বা তার নিজের বিবেকের কাছে দায়বদ্ধ থেকে সে তার জীবনের কাজকে ব্যাখ্যা করা প্রয়োজন কিনা তা সিদ্ধান্ত নেওয়া রোগীর উপর নির্ভর করে। যাইহোক, এমন লোকও আছে যারা কেবল নিজেদের জীবনকে তাদের কাছে নিযুক্ত করা কোনো কাজের বিষয়ে ব্যাখ্যা করে না বরং তাদের কাছে কাজের বরাদ্দ দেওয়া কঠোর কর্মদাতা সম্পর্কেও জীবনকে ব্যাখ্যা করে। 

লগোথেরাপি যেমন কোনো শিক্ষা না, তেমনি ধর্মপ্রচারও না। এটি যেমন যৌক্তিক বিচার থেকে অনেক দুরে, তেমনি নৈতিক উপদেশ দেওয়া থেকেও অনেক দূরে। রুপক অর্থে বলতে গেলে, একজন লগোথেরাপিষ্ট কর্তৃক লালন করা ভূমিকা একজন চিত্রশিল্পীর চেয়ে একজন চক্ষু-বিশেষজ্ঞের ভূমিকার মতো। একজন চিত্রশিল্পী সে পৃথিবীকে যেভাবে দেখে তার চিত্র আমাদের কাছে উপস্থাপন করার চেষ্টা করে; একজন চক্ষু বিশেষজ্ঞ আমাদেরকে পৃথিবীকে এর প্রকৃত রূপে দেখার সমর্থ করে তোলার চেষ্টা করে। লগোথেরাপিষ্টের ভূমিকা রোগীর দৃষ্টি-নির্ভর ক্ষেত্রকে বিস্তার ও সম্প্রসারণে নিহিত যাতে সম্ভাব্য অর্থ’র পূর্ণাঙ্গ বিস্তৃত পরিসর তার কাছে বোধগম্য ও দৃশ্যমান হয়ে উঠে।

মানুষ যে তার জীবনের সম্ভাব্য অর্থ’র জন্য দায়বদ্ধ ও তাকে অবশ্যই তা বাস্তবায়ন করতে হবে, এই ঘোষণা দেওয়ার মাধ্যমে জোর দিয়ে বলতে চাই যে জীবনের সত্যিকারের অর্থ’কে মানুষের মধ্যে বা তার নিজের মনের মধ্যে না খুঁজে পৃথিবীতেই তাকে তা আবিষ্কার করতে হয়, যেন তা এক (closed system) একটি বন্ধ প্রক্রিয়া। আমি এই গঠনমূলক বৈশিষ্ট্যকে “the self-transcendence of human existence” বা মানবজীবনের আত্ম-সীমাতিক্রমী অস্তিত্ব (বা জীবন) বলে থাকি। এটার মানে এই যে, মানুষ হওয়া মানে সবসময় কোনো কিছুর ইঙ্গিত করা এবং কোনো কিছুর প্রতি বা নিজের চেয়ে কারো অন্য প্রতি পরিচালিত হওয়া – হোক তা কোনো পূর্ণ করার এক অর্থ বা মুখোমুখি হওয়ার জন্য কোনো মানুষ। যত-বেশি একজন মানুষ নিজেকে ভুলে যায় – নিজেকে কোনো অর্থপূর্ণ সেবা কাজে উৎসর্গ করার মাধ্যমে বা অন্য ব্যক্তিকে ভালবেসে উৎসর্গের মাধ্যমে – ততবেশি সে মানুষ হয়ে উঠে ও ততবেশি সে নিজেকে বাস্তবায়ন (self-actualisation) করে। আত্ম-বাস্তবায়ন (self-actualisation) বিষয়টি খুব একটি সাধারণ কারণে কোনোভাবেই অর্জনীয় নয়, কারণ যত-বেশি একজন মানুষ তাকে পাওয়ার জন্য সংগ্রাম করবে, ততবেশি সে তাকে হারাবে। অন্য অর্থে, আত্ম-বাস্তবায়নকে কেবল self-transcendence বা আত্ম-সীমাতিক্রমীর পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়া হিসেবেই অর্জন করা সম্ভব।

এ পর্যন্ত আমরা দেখালাম যে জীবনের অর্থ সবসময় পরিবর্তন হয়, কিন্তু তা (জীবনের অর্থ) কখনই থেমে যায় না। লগোথেরাপি অনুসারে, জীবনের এই অর্থ তিনটি ভিন্ন উপায়ে আবিষ্কার করতে পারি: (১) কোনো কাজ সৃষ্টি বা কোনো কাজ করা মাধ্যমে; (২) কোনো কিছুর অভিজ্ঞতা লাভ বা কারো সাথে সাক্ষাত হওয়ার মাধ্যমে; ও (৩) অবশ্যম্ভাবী যন্ত্রণাভোগের প্রতি আমাদের মনোভাবের মাধ্যমে। প্রথমটি হলো কিছু অর্জন বা সফলতা লাভের উপায়, যা বেশ স্পষ্ট। কিন্তু দ্বিতীয় ও তৃতীয়টির আরও বিশদ বর্ণনার প্রয়োজন। 

জীবনের অর্থ সন্ধানের দ্বিতীয় উপায় হলো কোনো কিছুর অভিজ্ঞতা লাভ করা- যেমন সদ্‌গুণ, সত্য ও সৌন্দর্য – প্রকৃতি ও সংস্কৃতির অভিজ্ঞতার মাধ্যমে, বা তার একান্ত অনন্যতায় অন্য মানুষ সম্পর্কে অভিজ্ঞতার লাভের মাধ্যমে – তাকে ভালোবাসার মাধ্যমে।

ভালোবাসার অর্থ (THE MEANING OF LOVE)

মানুষেকে তার ব্যক্তিত্বের গভীরতম অন্ত:সারে গিয়ে বোঝার জন্য ভালোবাসাই হলো একমাত্র উপায়। কোনো মানুষই অন্য একজন মানুষের একান্ত গুরুত্বপূর্ণ গুণাবলি সম্পর্কে সম্পূর্ণরূপে অবগত হতে পারবে না যদি না সে তাকে ভালোবাসে। তার ভালোবাসার মাধ্যমে সে ভালোবাসার মানুষটির মাঝে সম্ভাব্য বৈশিষ্ট্য এবং উপাদান দেখতে সমর্থ হয়; তার চেয়েও, সে তার মাঝে এখনও বাস্তবায়িত হয়নি ও বাস্তবায়ন করা উচিৎ এমন সম্ভাবনাকে দেখে। অধিকন্তু, তার ভালোবাসার দ্বারা, ভালোবাসা ব্যক্তিটি ভালোবাসার মানুষের এই সম্ভাবনাকে বাস্তবায়নে সম্ভবপর করে তোলো। সে কি হতে সক্ষম ও তার কি হওয়া উচিৎ সে সম্পর্কে তাকে অবগত করার মাধ্যমে এই সম্ভাবনা সত্যে পরিণত করে।

লগোথেরাপিতে, ভালোবাসাকে যৌন বাসনা ও তথাকথিত ঊর্ধ্বপাতন (sublimation) অর্থে সহজাত প্রবৃত্তির এক নিছক ঘটনা  হিসেবে ব্যাখ্যা করা হয়নি। যৌনতার মতো ভালোবাসা একটি প্রাথমিক ঘটনা। স্বাভাবিকভাবে, যৌনতা হলো প্রেম বা ভালোবাসা প্রকাশের একটি প্রক্রিয়া। যৌনতাকে প্রতিপাদন বা যুক্তিযুক্ত করা হয়, এমনকি পবিত্রকরণ করা হয়, যেইমাত্র, কিন্তু যদি, তা ভালোবাসার মাধ্যম হয়। এভাবে, ভালোবাসা বা প্রেমকে যৌনতার নিছক এক পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হিসেবে বোঝানো হয়নি, বরং, যৌনতা হলো সেই চুড়ান্ত একত্ববোধ, যাকে ভালোবাসা বা প্রেম বলা হয় তার অভিজ্ঞতা প্রকাশের উপায়। জীবনে অর্থ খুজে পাওয়ার তৃতীয় উপায় হলো যন্ত্রণা ভোগ করা।

যন্ত্রণাভোগের অর্থ (THE MEANING OF SUFFERING)

আমাদের কখনো ভুলে যাওয়া উচিৎ নয় যে এমনকি আমরা যখন কোনো হতাশাপূর্ণ পরিস্থিতির মুখোমুখি হই তখনও আমরা জীবনের অর্থ খুজে পেতে পারি, যখন আমাদের নিয়তিকে পরিবর্তন যায় না। কারণ তখন যে জিনিসটি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠে তা হলো সর্বোৎকৃষ্ট উপায়ে অনন্যভাবে মানব সম্ভাবনার প্রতি সাক্ষ্য বহন করা, যা হলো ব্যক্তিগত সংকটকে এক বিজয়ে রূপান্তর করা, কারো দুর্দশাকে এক মানব সফলতায় পরিণত করা। আমরা যখন কোনো পরিস্থিতিকে আর পরিবর্তন করতে সমর্থ নই, তখন আমরা নিজেদের পরিবর্তনের চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয় – কেবল অস্ত্রোপচার-অসাধ্য ক্যান্সারের মতো এক দুরারোগ্য ব্যাধির কথা ভাবুন।

একটি সুস্পষ্ট উদাহরণ দেওয়া যাক: একসময় এক বয়স্ক সাধারণ চিকিৎসক তার গুরুতর বিষণ্ণতার জন্য আমার কাছে পরামর্শ নেন। যাকে তিনি সমস্ত কিছুর উর্ধে ভালবেসেছিলেন সেই স্ত্রী দুই বছরে আগে মৃত্যু বরণ করার কারণে তিনি বেদনা কাটিয়ে উটতে পারছিলেন না। এখন, তাকে আমি কিভাবে সাহায্য করতে পারি? তাকে আমার কি বলা উচিৎ? যাইহোক, তাকে কিছু বলা থেকে আমি নিজেকে বিরত রাখলা ববং তাকে আমি একটি প্রশ্নের মুখোমুখি করলাম আর জিজ্ঞেস করলাম, “ডাক্তার সাহেব, আপনিই যদি প্রথমে মারা যেতেন তাহলে কি হতো, এবং আপনাকে ছাড়া যদি আপনার স্ত্রীকে একা থাকতে হতো”? “উহ্”, তিনি বললেন, “তার জন্য তা অনেক ভয়াবহ হতো; তাকে কতইনা যন্ত্রণা পেতে হতো”! যাতে আমি উত্তর দিয়েছিলাম, “ডাক্তার সাহেব, দেখুন, তিনি মৃত্যু বরণ করার কারণে এ ধরনের যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পেয়েছেন, আর আপনিই তাকে এ ধরনের যন্ত্রণা থেকে মুক্তি দিয়েছেন – নিশ্চয়। এখন তার মূল্য হিসেবে আপনাকে বেঁচে থাকতে হচ্ছে ও তার জন্য শোক করতে হচ্ছে”। তিনি কোনো কথা বললেন না কিন্তু আমার সাথে হাত মিলালেন এবং শান্তভাবে আমার অফিস থেকে চলে গেলেন। যে মুহুর্তে আমরা যন্ত্রনার কোনো অর্থ খুজে পায় তখন তা আর যন্ত্রনা থাকে না, হতে পারে কোনো ত্যাগ বা হারানোর অর্থ।

সত্যিকার অর্থে এটি কোনো থেরাপি বা চিকিৎসা ছিল না, যেহেতু, প্রথমত, তার হতাশা আসলে কোনো রোগ ছিলনা; দ্বিতীয়ত, আমি তার নিয়তিকে পরিবর্তন করতে পারতাম না। আমি তার স্ত্রীকে পুনরূজ্জীবিত করতে পারতাম না। কিন্তু সেই মুহুর্তে আমি তার অপরিবর্তনীয় নিয়তির প্রতি তার মনোভাব পরিবর্তন করতে সফল হয়, যেমনটা সে মুহুর্ত থেকে তিনি অন্তত তার যন্ত্রনাভোগে এক অর্থ দেখতে পেতে শুরু করেন। লগোথেরাপির এটি একটি নীতি হলো মানুষের প্রধান উদ্বিগ্নতা কিন্তু আনন্দ লাভ করা বা যন্ত্রনা এড়িয়ে যাওয়া নয়, বরং তার জীবনে অর্থ নির্ণয় করা। সেজন্যে, তার যন্ত্রণাভোগের মাঝে কোনো অর্থ রয়েছে বলে মানুষ সে যন্ত্রণা ভোগ করতেও প্রস্তুত।

বিষয়টিকে পুরোপুরিভাবে পরিষ্কার করে বলতে হলে আমি বলব যে, জীবনের অর্থ খুজে পেতে কোনেভাবেই যন্ত্রণাভোগের প্রয়োজন নেই। আমি কেবল জোর দিয়ে বলতে চাই যে এমনকি যন্ত্রণাভোগ সত্ত্বেও জীবনের অর্থ সম্ভব – অবশ্য যন্ত্রণাভোগ যদি অনিবার্য হয়ে থাকে। তবে, যদি তা অনিবার্য হয়ে থাকে, তাহলে এর কারণ অপসারণই হবে অর্থবহ কোনো কিছু করা, হোক তা মনস্তাত্ত্বিক, জৈবিক বা রাজনৈতিক। অকারণে যন্ত্রণাভোগ বীরত্বের চেয়ে বরং ধর্ষকামী।

জর্জিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞানের প্রফেসর এডিথ ওয়েইকপফ-জুয়েলসন তার মৃত্যুর আগে লগোথেরাপির উপর তার নিবন্ধে মত দিয়েছিলেন যে, “আমাদের সমসাময়ীক মানসিক স্বাস্থ্য দর্শন ধারণা জোর দেয় যে মানুষকে খুশি হওয়া উচিৎ, কারণ অশান্তি বা অখুশি হওয়া হলো সমম্বয়হীনতার (maladjustment) লক্ষণ। এরকম এক ভালো-মন্দ বিচারের প্রক্রিয়া (value system) সম্ভবত অখুশি হওয়া সম্পর্কে অশান্তির কারণই অনিবার্য অশান্তির বোঝা বৃদ্ধি পাওয়ার জন্য দায়ী। অন্য আরেক গবেষনায় তিনি আশা ব্যক্ত করেন যে লগোথেরাপি, “যুক্তরাষ্ট্রের বর্তমান সংস্কৃতিতে নির্দিষ্ট অস্বাস্থ্যকর প্রবণতাকে ব্যর্থ করে দিতে পারে, যেখানে দুরারোগ্য রোগের ভুক্তভোগীকে তার যন্ত্রণাভোগ সম্পর্কে গর্বিত হওয়ার এবং একে মর্যাদা-হানিকরের বদলে মর্যাদাসম্পন্ন বিবেচনা করার খুব কমই সুযোগ দেওয়া হয়” যাতে “সে কেবল অখুশি নয়, বরং অখুশি হওয়ার কারণে লজ্জিত”। 

এমন পরিস্থিতিও আছে যেখানে কেউ তার কাজ করার সুযোগ থেকে বা তার জীবন উপভোগ করা থেকে বঞ্চিত; কিন্তু যে জিনিসটি কখনওই উড়িয়ে দেওয়া যায় না তা হলো যন্ত্রনাভোগের অনিবার্যতা। সাহসীকতার সাথে যন্ত্রনাভোগের এই প্রতিবন্ধকতা বা চ্যালেঞ্জ গ্রহনের মাঝে শেষ মুহুর্ত অবধি জীবনের অর্থ বজায় থাকে, এবং আক্ষরিক অর্থে শেষ পর্যন্ত এই অর্থ বজায় থাকে। অন্য অর্থে, জীবনের অর্থ একটি নিঃশর্ত বিষয়, কারণ তা এমনকি অনিবার্য যন্ত্রনাভোগের সম্ভাব্য অর্থ’কে অন্তর্ভুক্ত করে।

বন্দী শিবিরে সম্ভবত সবচেয়ে গভীরতম যে অজ্ঞিতা আমার হয়েছিল তা স্মরণ করছি। শিবিরে বেঁচে থাকার অস্বাভাবিকতা প্রকি আটাশ জনে একজনের বেশি ছিল না, যা সহজেই সঠিক পরিসংখ্যান দ্বারা যাচাই করা যেতে পারে। তবুও, আমার বইয়ের যে পাণ্ডুলিপিটি  অশউইৎস শিবিরে আমার প্রথম আগমনের পর আমার কোটের ভেতর লুকিয়ে রেখেছিলাম তা কখনো উদ্ধার করা সম্ভব হবে বলে মনে হয়নি। এভাবে, আমার মানসিক উদ্ভাবনকে হারানো সহ্য করতে এবং তার যন্ত্রনা কাটিয়ে উঠতে হয়েছিল। আর তারপর আমার কাছে মনে হয়েছিল যেন কোনো কিছু এবং কেউই আমার উপর টিকে থাকতে পারবে না; নয় কোনো আমার নিজের দৈহিক বা মানসিক সন্তান! তাই, আমি নিজেই এরকম পরিস্থিতিতে আমার জীবন চুড়ান্তভাবে অর্থশুন্য ছিল কিনা সে প্রশ্নের মুখোমুখি হয়।

আমি তখনও লক্ষ্য করিনি যে এই প্রশ্নের যে উত্তর যার সাথে আমি এত আসক্তির সাথে যুদ্ধ করছিলাম তা ইতিমধ্যেই আমার অপেক্ষায় ছিল, আর তারপর শীঘ্রই এই উত্তর আমাকে দেওয়া হবে। ঠিক একই জিনিসটি ঘটে যখন আমাকে আমার কাপড়-চোপর সমর্পন করতে হয়েছিল এবং তার বদলে এক বন্দী যাকে অশউইৎস ট্রেন ষ্টেশনে পৌঁছার পরপরই ইতিমেধ্য গ্যাস চেম্বারে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছিল তার জরাজীর্ণ নেকড়া পেয়েছিলাম। আমার পাণ্ডুলিপির বহু পৃষ্ঠার পরিবর্তে নতুন পাওয়া কোটের পকেটে আমি ইব্রিয় ভাষার প্রার্থনা বইয়ের ইহুদিদের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রার্থনা ‘শেমা ইসরায়েল’ সম্বলিত একটি ছেড়া পৃষ্ঠা খুজে পাই। কেবল তা কাগজে লিখে রাখার চেয়ে আমার চিন্তা-ভাবনাতে বেঁচে থাকার এক চ্যালেঞ্জ ব্যতীত এরকম একটি “কাকতালীয়” ঘটনাকে আমার কিভাবে ব্যাখ্যা করা উচিৎ?

আমার মনে পড়ে, একটু পর আমার মনে হয়েছিল আমি যেন অদুর ভবিষ্যতে মারা যাবো। যদিও এই বিপজ্জনক অবস্থায় আমার অধিকাংশ সহ-কর্মিদের চেয়ে আমার উদ্বেগ ছিল ভিন্ন। তাদের প্রশ্ন ছিল, “আমরা কি শিবির থেকে জীবিত ফিরে যেতে পারবো? কারণ, যদি না পারা যায়, তাহলে তার সমস্ত যন্ত্রনাভোগের কোনো মানে হয় না”। যে প্রশ্নটি আমাকে পরিবেষ্টিত করে রেখেছিল তা ছিল, “এসব যন্ত্রনাভোগের, আমাদের চার পাশে এই মৃত্যুর কোনো অর্থ আছে কি? কারণ তার যদি কোনো অর্থই না থাকে, তাহলে শেষ পর্যন্ত দেখা যাবে যে বেঁচে থাকায় কোনো অর্থ নেই; কারণ এমন এক জীবন যার অর্থ এরকম ঘটনার উপর নির্ভর করে – যেমন কেউ এ থেকে রেহায় পায় কিনা – শেষ পর্যন্ত মোটেও যাপনের উপযুক্ত হবে না ।

মেটা-ক্লিনিকল সমস্যা (META-CLINICAL PROBLEMS)

অনেক রোগী আজ স্নায়ুবৈকল্যের লক্ষনের চেয়ে মানবিক সমস্যা নিয়ে একজন মনঃচিকিৎসকের শরণাপন্ন  হয় অধিক পরিমাণে। কিছু কিছু লোক যারা ইদানিং মনঃচিকিৎসকের শরণাপন্ন  হচ্ছে তারা পূর্বে কোনো ধর্মীয় প্রচারক, প্রিষ্ট বা রেবাইয়ের সাথে সাক্ষাৎ করেছিলেন। এখন তারা প্রায়শই কোনো ধর্মীয় যাজকের কাছে হস্তান্তরিত হতে অস্বীকৃতি জানায় আর বরং “আমার জীবনের অর্থ কি”? এমন সব প্রশ্ন নিয়ে একজন চিকিৎসকের শরণাপন্ন হয়।

লগোড্রামা A LOGODRAMA

আমি নিচের উদাহরণটি উদ্বৃতি করতে চাই: এক সময়, এগার বছর বয়সে মারা হওয়া এক বালকের মায়ের এক আত্মহত্যা প্রচেষ্টার পর আমার হাসপাতাল বিভাবে ভর্তি করা হয়েছিল। ড. কার্ট ককৌরেক তাকে একটি থেরাপিউটিক দলে অংশ গ্রহনের আমন্ত্রন করেছিলেন, ঘটনাক্রমে আমি যে রুমে তিনি সাইকোড্রামা পরিচালনা করছিলেন সেখানে ডুকে পড়ি। মহিলাটি তার কাহিনী বলছিলেন। তার বাচ্চার মৃত্যুর পর সে তার আরেক বড় ছেলের সাথে একাকী হয়ে পড়েছে। শিশু বয়সে পক্ষাঘাতের প্রভাবে ভোগে বড় ছেলে পঙ্গু হয়ে গিয়েছিল। অসহায় ছেলেটিকে হুইল চেয়ারে করে নাড়াচাড়া করতে হতো। তার মা, যাহোক, তার নিয়তির বিরুদ্ধে বিদ্রুহ করেছিলো। কিন্তু যখন তার বড়ছেলে সহ একসাথে আত্মহত্যার চেষ্টা করে, তখন পঙ্গু ছেলেটিই তাকে আত্মহত্যা থেকে প্রতিহত করেছিলে; ছেলেটি বেঁচে থাকা পছন্দ করেছিল! তার কাছে জীবন অর্থবহ রয়ে যায়। তাহলে কেনো একই জিনিসটি তার মায়ের জন্যও ছিল না? কিভাবে তার জীবন এখনও অর্থ লাভ করতে পারে? আর আমরা তাকে এর ব্যাপারে সচেতন হওয়ার জন্য কিভাবে সাহয্য করতে পারি?

তাৎক্ষণিক প্রস্তুতিতে, আমি আলোচনায় অংশগ্রহন করলাম, এবং দলের অন্য মহিলাকে প্রশ্ন করলাম। আমি তাকে তার বয়স জিজ্ঞেস করলে, তিনি উত্তর দিলেন, “ত্রিশ”। আমি বললাম, “না, আপনার বয়স ত্রিশ নয় বরং আর মৃত্যু শয্যায় আপনি মিথ্যে বলছেন। এখন আপনি আপনার জীবনের দিকে ফিরে তাকাচ্ছেন, যে জীবন ছিল সন্তানহীন কিন্তু অর্থনৈতিক ও সামাজিক মর্যাদায় ভর্তি”। আর তারপর আমি তাকে এই পরিস্থিতিতে তিনি কি অনুভব করতেন তা কল্পনা করতে আহ্বান করলাম। “সে সম্পর্কে আপনি কি ভাববেন? নিজেকে আপনি কি বলবেন? প্রকৃতপক্ষে তিনি কি বলেছিলেন সে পর্বের সময় ধারকৃত টেপ রেকর্ড থেকে আমি তার উদ্বৃতি করছি।“ উহ, আমি একজন কোটিপতিকে বিয়ে করেছিলাম, ধন-সম্পদে ভর্তি আমার এক সহজ জীবন ছিল, ও আমি প্রত্যানুশারে জীবন যাপন করেছিলোম! আমি মানুষের সাথে ফষ্টিনষ্টি করেছিলাম; আমি তাদের বিব্রত করতাম! কিন্তু, এখন আমার বয়স আশি; আমার নিজের কোনো সন্তান নেই। একজন বৃদ্ধা হিসেবে আমি যখন পেছনে তাকায়, আমি তার সকল কিছুর কোনো মানে দেখি না; আসলে, আমি বলব আমার জীবন ছিল এক ব্যর্থতা”!

আমি তখন পঙ্গু ছেলেটির মাকে নিজেকে একইভাবে তার পেছনের জীবনের দিকে তাকিয়ে কল্পনা করার আন্ত্রন জানালাম। আসুন টেপ রেকর্ডার চালু করার পর শুনি তার কি বলার ছিল: “আমি সন্তানের আকাঙ্খা করছিলাম আর আমার আকাঙ্খা মঞ্জুর করা হয়; এক ছেলে মারা যায়; অন্যটি, পঙ্গু ছেলেটিকে কোনো এক প্রতিষ্ঠানে পাঠিয়ে দেওয়া হতো আমি যদি তার যত্ন না নিতাম। যদিও সে পঙ্গু আর অসহায়, সর্বোপরি সে আমার ছেলে। আর তাই আমি তার জন্য এক পুর্ণাঙ্গ জীবনের সম্ভাবনা তৈরি করি; আমি আমার ছেলেকে এক উত্তম মানুষ হিসেবে তৈরি করি”। এই মুহুর্তে অশ্রুজলের এক বিস্ফোরণ দেখা দেয়, সে কাঁদতে থাকে: আমার বেলায়, আমি শান্তিপূর্ণভাবে আমার পেছনের জীবনের দিকে তাকাতে পারি; আমি বলতে পারি যে আমার জীবন অর্থপূর্ণ ছিল এবং আমি তা পূর্ণ করার চেষ্টা করেছি; আমি সর্বোচ্চটা করেছি – আমি আমার ছেলের উত্তমটাই করেছি। আমার জীবন ব্যর্থ ছিল না”! যেন তাকে তার মৃত্যুসয্যা থেকে দেখে মনে হলো, হঠাৎ যেন সে তার জীবনে অর্থ দেখতে পাচ্ছিল, তার সমস্ত যন্ত্রনাভোগে যে অর্থ সম্পৃক্ত। তদুপরি, একই প্রজ্ঞানে এটাও পরিষ্কার হয়ে উঠছিলো যে তার মৃত ছেলের সংক্ষিপ্ত আয়ুর জীবন আনন্দ আর ভালোবাসায় এত সমৃদ্ধ হতে পারে যে হতে পারে যে তা আশি বছর বেঁচে থাকা এক জীবনের চেয়ে বেশি অর্থ অন্তর্ভুক্ত করতে পারে।

কিছুক্ষন পর আমি অন্য প্রশ্নে অগ্রসর হলাম, এ সময় আমি নিজেকে পুরো দলে লিপ্ত করি। প্রশ্ন ছিল একটি, বানর যাকে পলিও রোগের সিরাম উন্নয়নে ব্যবহৃত হচ্ছিল, আর একারনে বার বার বিদ্ধ করা হয়েছিল, সে কখনও তার যন্ত্রনাভোগের অর্থ উপলব্ধি করতে সক্ষম কিনা। সর্বসম্মতিক্রমে, দলটি উত্তর দেয় যে বানরটি নিশ্চয় উপলব্ধি করবে না; এর সীমিত বুব্ধিমত্তার কারণে সে মানুষের জগতে প্রবেশ করতে পারবে না, কেবলমাত্র জগৎ সেখানে এর যন্ত্রনা বোধগম্য হয়। তারপর পরবর্তী প্রশ্ন নিয়ে এগিয়ে যায়: আর মানুষের কি অবস্থা? আপনারা কি নিশ্চিত যে মানব জগৎ বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের বিবর্তনে প্রান্তিক স্থান? এটা কি বোধগম্য নয় যে তারপরও অন্য একটি ব্যাপ্তি রয়েছে, মানব জগতের বাইরে এক জগৎ; যে জগতে মানব যন্ত্রনাভোগের চুড়ান্ত অর্থ সম্পর্কিত প্রশ্নের উত্তর খুজে পায়?

চমৎকার অর্থ (THE SUPER-MEANING)

এই চুড়ান্ত অর্থ মানুষের সীমিত intellectual বা বুদ্ধিবৃত্তিক সামর্থকে অপরিহার্যভাবে অতিক্রম ও ছাড়িয়ে যায়; লগোথেরাপিতে, আমরা এই প্রসঙ্গে এক super-meaning বা চমৎকার অর্থ সম্পর্কে কথা বলি। মানুষের কাছ থেকে যা প্রত্যাশা করা হয় তা কিন্তু জীবনের অর্থহীনতাকে সহ্য করা নয়, যেমনটা অস্তিত্ববাদী দার্শনিকরা শিক্ষা দেয়, ববং যুক্তিসঙ্গত শর্তে  জীবনের নিঃশর্ত অর্থপূর্ণতাকে অনুধাবনে তার অক্ষমতাকে সহ্য করা। লগোস যুক্তির চেয়ে গভীর।

একজন মনঃচিকিৎসক যে চমৎকার অর্থ সম্পর্কিত ধারণার বাইরে যায় সে আগে আর পরে শীঘ্রই তার রোগীর দ্বারা বিব্রত হবেন, ঠিক যেমনটি আমার ছয় বছরের কন্যার প্রশ্নে আমি হয়েছিলাম, “আমরা কেনো ভালো প্রভু সম্পর্কে কথা বলি”? যার উত্তরে আমি বলেছিলাম, “কয়েক সপ্তাহ আগে তুমি হাম রোগ ভুগছিলে, আর তারপর উত্তম প্রভু তোমাকে পুর্ণ রোগমুক্তি প্রেরণ করেন”। যাহোক, ছোট মেয়েটি সন্তুষ্ট হয়নি, তাই সে যুক্তি খণ্ডন করে বলে, ভালো, কিন্তু বাবা দয়াকরে ভুলে যাবেন না: প্রথমে কিন্তু তিনি আমার কাছে হাম পাঠিয়েছিলেন”।

যাহোক, একজন রোগী যখন ধর্মীয় বিশ্বোসে ভিত্তিকে শক্ত হয়ে দাঁড়ায়, তার ধর্মীয় বিশ্বাসের থেরাপিউটিক প্রভাবকে ব্যবহার করে তদনুযায়ী তার আধ্যাত্মিক সম্বলকে কাজে লাগানোর পেছনে কোনো আপত্তি থাকতে পারে না। তা করার জন্য, মনঃচিকিৎসক নিজেকে রোগীর জায়গায় অবস্থান করাতে পারে। ঠিক তাই আমি এক সময় করেছিলাম, উদহারণসরূপ, যখন পূর্ব ইউরোপ থেকে একজন রেবাই (ইহুদি ধর্মীয় শিক্ষক) আমার কাছে এসে তার কাহিনী বলেছিলেন। তিনি তার প্রথম স্ত্রীকে হায়েছিলেন এবং অশউইৎসের বন্দী শিবিরে হারিয়েছেন তাদের ছয় সন্তানকে যেখানে তাদের গ্যাস দিয়ে মারা হয়েছিল, আর এখন শেষ পর্যন্ত দেখা গেল যে তার স্ত্রী বন্ধা। আমি লক্ষ্য করলাম যে, প্রজননই জীবনের কেবলমাত্র অর্থ নয়, কারণ তখন জীবন এমনিতেই অর্থহীন হয়ে যাবে, এবং প্রকৃতিগতভাবে অর্থহীন এমন কিছুকে নিছক এর ধারাবাহিকতার মাধ্যমে অর্থপূর্ণ করা যায় না। অবশ্য, রেবাই একজন সনাতন ইহুদি হিসেবে তার নিজের কোনো ছেলেই যে তার মৃত্যুর পর তার জন্য কখনও কাদিশ[1] পড়ার জন্য বেঁচে নেই সে হতাশার আলোকে তার দুর্দশাকে মূল্যায়ন করেছিলেন।

কিন্তু আমি ছেড়ে দেওয়ার মানুষ নই। তাকে সাহায্য করার জন্য তিনি পুণরায় তার সন্তানদের সাথে স্বর্গে দেখা করার আশা করেন কিনা জানতে চেয়ে আমি শেষ প্রচেষ্টা করলাম। তবে, আমার প্রশ্নের কারণে সে কান্নায় ফেটে পড়েন, আর এখন তার হতাশার আসল কারণ বেরিয়ে আসে: তিনি বর্ণনা করলেন যে তার সন্তানেরা যেহেতু নিষ্পাপ শহীদ[2] হিসেবে মৃত্যু বরণ করে, তারা স্বর্গে সর্বোচ্চ স্থানের উপযুক্ত বিবেচিত হয়েছে, কিন্তু একজন বৃদ্ধ, পাপী মানুষ হিসেবে তিনি আশা করতে পারেন না যে তার জন্য একই স্থান ধার্য করা হবে। আমি ছেড়ে না দিয়ে প্রতিক্ষেপণ করলাম, এটা বোধগম্য নয়, রেবাই, ঠিক এটাই ছিল আপনার সন্তানদের চেয়ে বেশি আপনার বেঁচে থাকার অর্থ: যেন আপনি এই কয়েক বছরের যন্ত্রনার মাধ্যমে নিজেকে বিশুদ্ধ করতে পারেন, যাতে অবশেষে আপনিও, যদিও আপনার সন্তানদের মতো নিষ্পাপ নয়, স্বর্গে তাদের সাথে মিলনের উপযুক্ত হয়ে উঠতে পারেন? দাউদের পরমগীতে[3] কি লেখা নাই যে ঈশ্বর তোমার সকল কিছু সংরক্ষণ করেন? তাই সম্ভবত আপনার কোনো যন্ত্রনাভোগই ব্যর্থতায় পরিণত না হয়”। বহু বছরে প্রথম বারের মতো নতুন দৃষ্টিকোণ যা আমি তার কাছে এক নতুন পৃথিবীকে খুলে ধরতে সমর্থ হয়েছিলাম যাতে তার মাধ্যমে তিনি তার যন্ত্রনা থেকে নিস্তার পান।

জীবনের ক্ষণস্থায়ীত্ব  (LIFE’S TRANSITORINESS)

যে জিনিসগুলি মানব জীবন থেকে অর্থ ছিনিয়ে নিয়ে যায় বলে মনে হয় তার মধ্যে কেবল যন্ত্রনাভোগই নয় বরং মৃত্যুও অন্তর্ভুক্ত। আমি কখনও একথা বলে ক্যান্ত হবো না যে, জীবনের প্রকৃত ক্ষণস্থায়ী দিকগুলি হলো কেবল সম্ভাবনা সমূহ; কিন্তু যখনই সম্ভাবনা সমূহ বাস্তবায়িত হয়, তা সেই মুহুর্তেই বাস্তবতায় রুপান্তরিত হয়; তাদের সংরক্ষিত করা হয় ও অতীতের মাঝে সরবরাহ করা হয়, যেখানে তাদের উদ্ধার করা হয় এবং ক্ষণস্থায়ীত্ব থেকে সংরক্ষণ করা হয়। কারণ, অতীতের মাঝে, কোনো কিছুই উদ্ধার করা অসম্ভব উপায়ে হারিয়ে যায়নি বরং সবকিছুই চূড়ান্ত এবং অপরিবর্তনীয়ভাবে সংরক্ষিত রয়েছে।

এভাবে, আমাদের অস্তিত্ত্বের বা জীবনের ক্ষণস্থায়ীত্ব কোনো ভাবেই একে অর্থহীন করে না। কিন্তু তা আমাদের দায়বদ্ধতাকে স্থাপন করে; কারণ সবকিছু আমাদের অপরিহার্যভাবে ক্ষণস্থায়ী সম্ভাবনাকে অনুধাবন করার উপর নির্ভর করে।

মানুষ ক্রমাগতভাবে বিদ্যমান সম্ভাবনার পরিমান সংক্রান্ত সিদ্ধান্ত নেয়; এসব সম্ভাবনার কোনটিকে অ-সত্তায় দোষারোপ এবং কোনটি বাস্তবায়িত করা হবে? কোন সিদ্ধান্তকে একবার ও চিরজীবনের জন্য এক বাস্তবতায় রুপান্তর করা হবে, এক চিরস্থায়ী সময়ের বালিতে পদচিহ্ন” হিসেবে? যে কোনো মুহুর্তে, মানুষকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে, হোক ভালো বা মন্দ, তার জীবনের স্মৃতিচিহ্ন কি হবে।

সাধারণত, মানুষ কেবল ক্ষনস্থায়িত্বের নাড়া ক্ষেত্রকে বিবেচনা করে এবং অতীতের পুর্ণ শস্যভাণ্ডারকে তাচ্ছিল্য করে, যেখানে সে শেষবারের মতো তার কর্ম রক্ষা করেছিল, তার আনন্দ আর যন্ত্রনাভোগও। কোনো কিছুকেই পূর্বাবস্থায় ফেরানো যাবে না, এবং কোনো কিছুকে বাতিল করা যাবে না। আমি বলব অতীত বা গত হওয়া হচ্ছে সবচেয়ে নিশ্চিত অস্তিত্ব বা সত্তা।

মানব অস্তিত্ত্বের অত্যাবশ্যকীয় ক্ষণস্থায়ীত্ব মনে ধারণ করে বলে, লগোথেরাপি নৈরাশ্যপূর্ণ নয় বরং সক্রিয়তাপূর্ণ। রূপকভাবে বিষয়টি প্রকাশ করতে আমরা বলতে পারি: pessimist বা নৈরাশ্যবাদী মানুষ হলো এমন এক ব্যক্তি যে ভয় আর দুঃখের সাথে পর্যবেক্ষণ করে যে তার দেয়াল পঞ্জিকা, যেখান থেকে সে প্রতিদিন একটি করে পাতা ছেঁড়ে, প্রতিটি অতিক্রান্ত দিনে তা পাতলা হয়ে উঠছে। অন্য দিকে, যে ব্যক্তি সক্রিয়ভাবে তার জীবনের সমস্যাকে আক্রমন করে সে হলো এমন এক ব্যক্তির মতো যে তার পঞ্জিকা থেকে ধারাবাহিকভাবে পাতা অপসারণ করবে এবং প্রথমে এর পেঁছনে সংক্ষেপে কয়েকটি ডায়রি মন্তব্য টুকে রাখার পর তা পরিষ্কারভাবে ও সতর্কতার সাথে এর পুর্বর্তীদের সাথে লিপিবদ্ধ করে। সে গর্ব আর আনন্দের সাথে এই মন্তব্যগুলিতে লিখে রাখা সকল চমৎকারিত্বের সাথে, যে সম্পূর্ণ জীবন সে ইতিমধ্যে পুর্নতার সাথে যাপন করেছে তাতে প্রতিফলন করতে পারে। যদি সে বুঝতে পারে যে সে বৃদ্ধ হয়ে যাচ্ছে তাহলে তা কিসের কাজে আসবে? যুবক লোকদের দেখে তার হিংসা করা বা তার নিজের হারিয়ে যাওয়া যৌবনের উপর স্মৃতিবিধুরতা বৃদ্ধি পাওয়ার পেছনে তার কোনো যুক্তি আছে? একজন যুবককে হিংসা করার তা কি যুক্তি আছে? একজন যুবক ব্যক্তির সম্ভাবনা থাকার কারনে, তার ভাগ্যে কি ভবিষ্যৎ রয়েছে? “না, ধন্যবাদ আপনাকে”, সে চিন্তার করবে।  কারণ “সম্ভাবনার চেয়ে, আমার অতীতে রয়েছে বাস্তবতা, কেবল সম্পন্ন কর্মের ও লালিত প্রেমের বাস্তবতা নয়, বরং সাহসের সাথে ভোগ করা যন্ত্রনাভোগের। এই যন্ত্রনা সমূহ এমনকি যার বিষয়ে আমি সবচেয়ে বেশি গর্বিত, যদিও এসব জিনিস হিংসার উদ্রেগ করে না।

কৌশল হিসেবে লগোথেরাপি (LOGOTHERAPY AS A TECHNIQUE)

মৃত্যু ভয়ের মতো বাস্তববাদী ভয়কে এর সাইকোডাইনামিক[4] ব্যাখ্যা দিয়ে প্রশান্ত করা যাবে না; অন্য ভাবে, কোনো স্নায়ুবৈকল্য ঘটিত ভয়কে, যেমন খোলা জায়গার ভয় (agoraphobia), দর্শনগত বোধগম্যতার মাধ্যমে নিরাময় সম্ভব না। তবে,এরকম ঘটনা মোকাবিলায়ও লগোথেরাপি এক বিশেষ পদ্ধতির বিকাশ করেছে। যখনই এ পদ্ধতি ব্যবহৃত হয় তখন কি হচ্ছে তা অনুধাবনের জন্য, প্রারম্ভিক প্রস্তাব হিসেবে এক পরিস্থতিকে গ্রহন করি যা প্রায়শই স্নায়ুবৈকল্য ব্যক্তিদের মাঝে লক্ষ্য করা যায়, যেমন, (anticipatory anxiety) পূর্বাভাসজনি উদ্বেগ বা আশংকা। এই ভয়ের বৈশিষ্ট্য হলো যে, এটি ঠিক সেই ভয়কে উৎপন্ন করে যার সম্পর্কে রোগী সন্ত্রস্ত থাকে। উদহারণসরূপ, একজন ব্যক্তি যখন বৃহাদাকার কক্ষে প্রবেশের পর এবং অনেক লোকজনের মুখোমুখি হলে লজ্জা পাওয়ার ভয় করে, তকে তার প্রকৃতপক্ষে এরকম পরিস্থিতিতে আরও বেশি লজ্জা পাওয়ার প্রবণতা থাকে। এই প্রসঙ্গে কেউ হয়তো “আমরা সম্ভবত তাই বিশ্বাস করি যা সত্যি হোক বলে আমরা কামনা করি” কে “আমরা যাই ভয় করি তাই আমাদের ঘটে থাতে” তে রুপান্তর করতে পারি।

যতেষ্ট হাস্যকরভাবে, একইভাবে একজন মানুষ যা ভীত থাকে তাই ভয় তার জন্য নিয়ে আসে, যেমনিভাবে কোনো জবরদস্তি করা অভিপ্রায় যা একজন মানুষ জবরদস্তিভাবে প্রত্যাশা করে অসম্ভব করে তোলে। অতিরিক্ত অভিপ্রায় বা ইচ্ছা অথবা “hyper-intention” তাকে আমি যেভাবে বলে থাকি, আমরা বিশেষভাবে যৌন স্নায়বৈকল্যজনিত ঘটনায় লক্ষ্য করে থাকি। একজন মানুষ যতবেশি তার যৌন শক্তিকে প্রদর্শন করার চেষ্টা করে বা্ একজন মহিলা যতবেশি তা যৌন উত্তেজনা (orgasm) লাভের সামর্থকে প্রদর্শন করার চেষ্টা করে, তত কম তারা তাতে সফল হয়। আনন্দ হলো এক পার্শপ্রতিক্রিয়া বা উপজাত, তাকে অবশ্যই পার্শপ্রতিক্রিয়া বা উপজাত হিসেবে রাখা চাই, আর যে পরিমানে আনন্দকে স্বয়ং লক্ষ্য হিসেবে পরিণত করা হয় ততটা তাকে ধ্বংশ ও নষ্ট করা হয়।

উপরোল্লেখিত অতিরিক্ত অভিপ্রায় বা ইচ্ছার পাশাপাশি, অতিরিক্ত মনোযোগ, বা hyper-reflection বা অত্যাধিক প্রতিফলন, লগোথেরাপিতে এত যেভাবে নামকরণ করা হয়েছে, pathogenic বা রোগ সৃষ্টির কারণও হতে পারে ( যা অসুস্থতার দিকে পরিচালিত করে)। পরবর্তী ক্লিনিকল প্রতিবেদন আমি যা বলতে চাই তা নির্দেশ করবে: যৌনতাকে উপভোগ করতে না পারার অভিযোগ নিয়ে এক যুবতী আমার কাছে এসেছিল। ঘটনার ইতিহাসে দেখা যায় যে বাল্য বয়সে তাকে তার পিতার দ্বারা যৌন নির্যাতিত হয়েছিল। যদিও তা এত দুঃখজনক অভিজ্ঞতা ছিল না যা তার যৌন স্নায়ুবৈকল্যে পরিণত হয়, যেমনটি সহজেই অনুমেয়। কারণ দেখা যায় যে, জনপ্রিয় মনঃবিশ্লেষণধর্মী সাহিত্য পড়ার মাধ্যমে রোগী ক্রমাগতভাবে ভয়ানক সম্ভাবনায় জীবন-যাপন করেছে যে একদিন তার দুঃখজনক অভিজ্ঞতা মাসুল নেবে। এই পূর্বাভাসজনি উদ্বেগ বা আশংকা তার মেয়েলিপনাকে দৃঢ় করতে অতিরিক্ত অভিপ্রায় বা ইচ্ছা এবং তার সঙ্গীর পরিবর্তে তা নিজের উপর আবর্তিত অতিরিক্ত মনোযোগ উভয়ের জন্ম দেয়। এটি রোগীকে যৌন আনন্দের সবোচ্চ অভিজ্ঞতা লাভে অক্ষম করে তোলার জন্য যতেষ্ট, যেহেতু যৌন উত্তেজনাকে অপ্রতিফলিত ত্যাগ আর সঙ্গীর প্রতি অত্মসমর্পনের এক অনিচ্ছাকৃত প্রভাব হিসেবে রাখার পরিবর্তে এক অভিপ্রায় বা ইচ্ছার ও মনোযোগের বস্তুতে রুপান্তর করা হয়েছিল। সংক্ষিপ্ত সময়ের জন্য লগোথেরাপির মধ্যদিয়ে যাওয়ার পর, তার যৌন উত্তেজনা অভিজ্ঞতা লাভে রোগীর অতিরিক্ত মনোযোগ ও অভিপ্রায়ের সামর্থকে বিপ্রতিফলিত বা de-reflected[5] করা হয়েছিল, আরও একটি লগোথেরাপিউটিক মেয়াদ পরিচয় করিয়ে দিতে। যখন তার মনোযোগকে যথাযথ বস্তুর দিকে, যেমন তার সঙ্গি, পুনঃস্থিরকৃত বা refocused করা হয়, তখন তার যৌন উত্তেজনা স্বঃতস্পূর্তভাবে আপনিতেই প্রতিষ্টিত হয়ে যায়।[6]

একজন মানুষ যাকে ভয় পায় সে ভয়ের কারণে যা সংঘটিত হয়ে থাকে এবং অধ্যধিক অভিপ্রায় একজন মানুষ যা করতে চাই তাকে অসম্ভব করে তোলে তার দ্বিগুনা সত্যের উপর লগোথেরাপির paradoxical intention বা বৈপরিত অভিপ্রায় পদ্ধতি ভিত্তি করে। ১৯৩৯ সালের দিকে জার্মান ভাষায় আমি বৈপরিত অভিপ্রায়ের বর্ণনা করি।[7] এ পদক্ষেপে ভয়ার্ত বা ফোবিক রোগীকে একদম যে জিনিসকে সে ভয় করে তা করতে মনস্থ করার আমন্ত্রন করা হয়, হোক তা এক মুহুর্তের জন্য।


[1] মৃতদের জন্য প্রার্থনা।

[2] ইলকিদ্দুশ বাসবেম, যেমন, ঈশ্বরের নাম পবিত্রকরণের জন্য।

[3] “তুমি আমার ভ্রমণ গণনা করিতেছ; আমার নেত্রজল তোমার কুপাতে রাখ; তাহা কি তোমার পুস্তকে লিখিত নাই”? (পরমগীত ৫৬: ৮ পদ)

[4] বিস্তৃত অর্থে Psychodynamics হলো মনস্তত্ত্বের পন্থা যা মানব আচরণের অধিনে যেমন অনুভূতি, আবেগ ‍এবং তা প্রারম্ভিক অভিজ্ঞতার সাথে কিভাবে সম্পৃক্ত হয় তা মনস্তাত্ত্বিক শক্তির পদ্ধতিগত শিক্ষাকে জোর দেয়। এটি বিশেষভাবে সচেতন প্রেরনা আর অচেতন প্রেরনার মধ্যে গতিশীল সম্পর্কে আগ্রহী।

[5] অত্যধিক প্রতিফলকে রোগীদের মনোযোগকে নিজেদের মধ্য থেকে এবং নিজেদের কাজ থেকে ফিরিয়ে আনার মাধ্যমে বাধাগ্রস্ত করতে লগোথেরাপির এক পরিকল্পিত পদ্ধতি।

[6] অত্যধিক মনোযোগ ও অত্যধিক প্রতিফলন থিওরি’র উপর ভিত্তি করে যৌন অক্ষমতার ঘটনা চিকিৎসা করতে এক বিশেষ লগোথেরাপিউটিক পদ্ধতির উন্নতি করা হয়েছে, উপরে যেমন বর্ণনা করা হয়েছে (ভিক্টর ই. ফ্রাঙ্কল, The Pleasure Principle and Sexual Neurosis বা আনন্দ তত্ত্ব ও যৌন স্নায়ুবৈকল্য The International Journal of Sexology, Vol. 5, No. 3 [1952], pp. 128-30). যদিও তা নিয়ে লগোথেরাপি তত্ত্ব সম্পর্কে এই সংক্ষিপ্ত উপস্থাপনায় তার বিবরণ অসম্ভব।

[7] Viktor E. Frankl, “Zur medikamentosen Unterstützung der Psychotherapie bei Neurosen,” Schweizer Archiv für Neurologie und Psychiatrie, Vol. 43, pp. 26-31.

একটি ঘটনা স্মরণ করছি। এক যুব চিকিৎসক তার ঘেমে যাওয়ার ভয় সম্পর্কে আমার সাথে পরামর্শ করেছিলেন। যখনই তার কোনো ঘেমে যাওয়ার প্রকোপ দেখা দিতো, এই (anticipatory anxiety) পূর্বাভাসজনি উদ্বেগ বা আশংকা প্রচণ্ডবেগে অতিরিক্ত ঘেমে যাওয়ার কারণ হতো। এই আকৃতি গঠনকে ছিন্ন করতে আমি রোগীকে ঘাম হওয়ার মুহুর্তে তিনি কতটা ঘামতে পারেন তা মানুষকে দেখিয়ে সুচিন্তিতভাবে সমাধানের উপদেশ দিয়েছিলাম। এক সপ্তাহ পর তিনি আমাকে তার ফলাফল জানাতে ফিরে এসে বলেন যে যখনই তিনি তার পূর্বাভাসজনি উদ্বেগের সূত্রপাত করে এমন কারো সাথে সাক্ষাত করেন তখ তিনি নিজেকে বলেছিলেন, “আমি আগে কেবল এক কোয়ার্টার ঘামতাম, কিন্তু এখন আমি অনন্তত দশ কোয়ার্টার ঘাম ঝরাবো”! ফলাফল এমন ছিল যে, চারবছর ধরে ঘামের আতঙ্কে কাটার পর তিনি অবশেষে কেবল এক পর্বের চিকিৎসায় সে নিজেকে এক সপ্তাহর মধ্যে তা থেকে চিরতরে মুক্ত করতে সমর্থ হন।

পাঠকেরা লক্ষ্য করে থাকবে যে এই প্রক্রিয়া রোগীর মনোভাবের বৈপরিত্যের মধ্যে নিহিত, যতটা এক বৈপরিত আকাঙ্খা বা প্রত্যাশা দ্বারা তার ভয়ের স্থানাস্তরিত হয়েছিল। এই চিকিৎসার দ্বারা দুঃচিন্তার পাল থেকে হাওয়া বের করে নেওয়া হয়।

তবে, এমন একটি প্রক্রিয়াকে অবশ্যই সুনির্দিষ্টভাবে আত্ম-বিচ্ছিন্নতার জন্য রাসাত্ববোধে সহজাত মানব সামর্থকে ব্যবহার করেতে হবে। একজন মানুষের নিজেকে বিচ্ছিন্ন করণের এই সামর্থ বাস্তবায়িত হয় যখনই বৈপরিত অভিপ্রায় (paradoxical intention) নামক লগোথেরাপিউটিক পদ্ধতিকে প্রয়োগ করা হয়। একই সময়ে, রোগীকে তার নিজের স্নায়ুবৈকল্য থেকে নিজেকে দুরে রাখার সমর্থ করে তোলা হয়। এর সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ একটি বিবৃতি পাওয়া যায় আমেরিকার মনঃবিজ্ঞানী গর্ডন ডব্লিউ. এ্যালপুর্ট এর বই, The Individual and His Religion এ: স্নায়ুবৈকল্য ব্যক্তি, যে নিজের কাছে হাসতে শেখে সম্ভবত সে আত্ম-পরিচালনার পথে আছে, সম্ভবত সুস্থ করতে”। [1]

এ্যালপুর্টের বিবৃতিতে বৈপরিত অভিপ্রায় (paradoxical intention) এ প্রায়োগিক বৈধতা এবং ক্লিনিকল প্রয়োগ রয়েছে।

এ পদ্ধতিকে আরও ব্যাখ্যার জন্য আরও কয়েকটি ঘটনার বিবরণ দেওয়া যায়। নিচে উল্লেখিত রোগী ছিলেন অনেক ডাক্তার দ্বারা ও কোনো থেরাপিউটিক সফলতা ছাড়াই কয়েকটি ক্লিনিকে চিকিৎসা নেওয়া একজন হিসাবরক্ষক। যখন তাকে আমার হাসপাতাল বিভাগে ভর্তি করানো হয়েছিল, তখন তিনি ছিলেন প্রচণ্ড হতাশায় ও আত্ম-হত্যার কাছাকাছি ছিলেন বলে স্বীকার করেছিলেন। কয়েক বছর ধরে তিনি Writer’s cramp[2] রোগে ভুগছিলেন যা  সম্প্রতি এতই তীব্র হয়ে উঠেছিল যে তিনি তার চাকরি হারাতে বসেছিলেন। তাই, কেবল তাৎক্ষনিক থেরাপিই তার এই পরিস্থিতি প্রশমিত করতে পারে। চিকিৎসার শুরুতে, ডাক্তার ইভা কযডেরা রোগীকে প্রস্তাব করেন যে সে সাধারণত যা করেছিল ঠিক তার উল্টো কাজ করতে; যেমন, যতটা সম্ভব পরিষ্কার ও সুস্পষ্টভাবে লিখতে চেষ্টা করার পরিবর্তে, সে যেন যতটা সম্ভব সবচেয়ে খারাপভাবে হিজিবিজি লিখতে চেষ্টা করে। নিজেকে বলার জন্য তাকে উপদেশ দেওয়া হয়েছিল, “এখন আমি লোকজনকে দেখাব আমি একজন কতো বাজে লেখক”! আর সেই মুহুর্তে যখন সে ব্যাপরোয়াভাবে হিজিবিজি করে লিখতে চেষ্টা করেছিল, তখন তার হিজিবিজি করে লিখা অসম্ভব হয়ে উঠে। “আমি হিজিবিজি করে লিখতে চেষ্টা করি, কিন্তু আমি তা কেবলই পেরে উঠছিলাম না”, পরের দিন সে বলেছিল। আটচল্লিশ ঘন্টার মধ্যেই রোগী এভাবে তার writer’s cramp থেকে মুক্ত করে, এবং চিকিৎসার পর পর্যাবেক্ষণ কালে তা থেকে মুক্ত থাকে। সে এখন পুরাটাই একজন সুখি মানুষ একং পরিপূর্ণভাবে কাজ করতে সমর্থ।

লিখতে সমস্যার পরিবর্তে, কথা বলার সমস্যা নিয়ে একই রকম ঘটনা সম্পর্কে ভিয়েনা পলিক্লিনিক হাসপাতের আমার এক সহকর্মি আমাকে বলেন। এটা ছিল এক তীব্র তোতলামীর ঘটনা যা তিনি তার বহু চিকিৎসা জীবনে প্রথমবারের মতো মুখোমুখি হন। তোতলামী ব্যক্তির মতে সে তার জীবনে কখনও কথা বলার সমস্যা থেকে এক মুহুর্তর জন্যও মুক্ত করতে পারেনি, একবার ছাড়া। ব্যপারটা ঘটেছিল তার বয়স যখন বারো বছর এবং এক ট্রাম বাসে চড়ার সময় সটকে পড়ে। বাসের কন্ডাক্টরের কাছে ধরা পড়লে, সে ভাবলো যে তা থেকে পালানোর একমাত্র উপায় হলো সহানুভুতি আদায় করা, আর তাই সে নিজেকে এক অসহায় রাস্তার ছেলে হিসেবে উপস্থাপন করার চেষ্টা করে। সে মুহুর্তে যখন সে তোতলাতে চেষ্টা করলেও পারে নি। অর্থহীন, সে বৈপরিত অভিপ্রায় বা (paradoxical intention) অনুশীলন করেছিল, যদিও থেরাপিউটিকল উদ্দেশ্যে নয়।

যাহোক, এই উপস্থাপনের প্রভাব এমনটা হওয়া উচিৎ নয় যে, বৈপরিত অভিপ্রায় বা (paradoxical intention) কেবল একক উপসর্গ যুক্ত রোগের ক্ষেত্রে কার্যকর। এই লগোথেরাপি পদ্ধতিকে কাজে লাগিয়ে, ভিয়েনা পলিক্লিনিক হাসপাতালে আমার কর্মচারী সবচেয়ে মারাত্বক মাত্রার ও সময়ের মাত্রাতিরিক্ত বাধ্যকরণক্ষম স্নায়ুবৈকল্য (obsessive-compulsive neuroses) রোগে নিরাময় আনয়নে সফল হয়েছিল। উদহারণসরূপ আমি পঁয়শট্টি বছরের এক মহিলার কথা বলতে পারি যে ষাট বছর ধরে washing compulsion[3] বৈকল্যে ভোগছিল। বৈপরিত অভিপ্রায়ের মাধ্যমে ডাক্তার ইভা কযডেরা লগোথেরাপিউটিক চিকিৎসা শুরু করেন, আর দুই মাস পর রোগী স্বাভাবিক জীবন যাপনে সমর্থ হয়। ভিয়েনা পলিক্লিনিক হাসপাতালের স্নায়ুবিক বিভাগে ভর্তি হওয়ার পুর্বে রোগী স্বীকারোক্তি করেছিলো, “আমার জন্য জীবন ছিল নরকের মতো”। তার এহেন বাধ্যবাধকতা ও অতিরিক্ত জীবানু ভীতি আচ্ছন্নতার দরুন অক্ষম হয়ে পড়লে, সে গৃহাস্থ্যলীর কোনো ধরনের কাজ করতে অক্ষম হয়ে অবশেষে সারাদিন বিছানায় শুয়ে থাকতে শুরু করে। এটা বলা সঠিক হবে না যে সে এখন পরিপূর্নভাবে তার উপসর্গ থেকে মুক্ত, কারণ তার মনে কোনো অবসেশন বা আচ্ছন্নতা আসতে পারে। তবে, সে এখন “তা নিয়ে রসিকতা করে”; সংক্ষেপে, বৈপরিত অভিপ্রায় প্রয়োগে।

নিদ্রা ব্যাঘাতের ক্ষেত্রেও Paradoxical intention বা বৈপরিত অভিপ্রায় প্রয়োগ করা যেতে পারে।

নিদ্রহীনতার[4] ভয় ঘুমিয়ে পড়ার বেলায় hyper-intention বা অত্যধিক-অভিপ্রায়ে রূপ নেয়, যা, পক্ষান্তরে, রোগীকে ঘুমিয়ে পড়ায় অক্ষম করে তোলে। এই বিশেষ ভয়কে অতিক্রম করতে, আমি সাধারণত রোগীকে ঘুমি পড়ার চেষ্টা না করে বরং ঠিক উল্টোটা করার, মানে যতটা সম্ভব জেগে থাকতে চেষ্টা করার উপদেশ দেই। অন্য অর্থে, ঘুমাতে না পারার anticipatory anxiety বা পূর্বাভাসজনি উদ্বেগ বা আশংকা থেকে সৃষ্ট ঘুমিয়ে পড়ার hyper-intention বা অত্যধিক-অভিপ্রায়কে অবশ্যই ঘুমিয়ে না পড়ার Paradoxical intention বা বৈপরিত অভিপ্রায় দ্বারা প্রতিস্থাপন করতে হবে, যা দ্রুত ঘুম নিয়ে আসবে।

Paradoxical intention বা বৈপরিত অভিপ্রায় সব ধরনের রোগ নিরাময়কারী ওষুধ নয়। মাত্রাতিরিক্ত বাধ্যকরণক্ষম স্নায়ুবৈকল্য ও ফোবিক অবস্থা, বিশেষ করে anticipatory anxiety বা পূর্বাভাসজনি উদ্বেগ জনিত রোগের চিকিৎসায় দরকারী উপকরণ হিসেবে ব্যবহৃত হয়। অধিকন্তু, এটি হলো সংক্ষিপ্ত মাত্রার থেরাপিউটিক কৌশল। যাহোক, কারো এটা ভাবা উচিৎ নয় যে এরকম এক সংক্ষিপ্ত সময়ের থেরাপি অবশ্যম্ভাবিভাবে কেবল ক্ষণস্থায়ী থেরাপিউটিক ফলাফলে রুপান্তরিত হবে। “ফ্রয়ডিয় প্রচলিত প্রথার এক সাধারণ ভ্রম হলো”, আমেরিকার প্রয়াত মনঃচিকিৎসক এমিল আর্থার গোটেইলের উদ্বৃতিতে, “যে ফলাফলের স্থায়িত্বের সাথে থেরাপির ব্যপ্তির সাথে সঙ্গতি রয়েছে”।[5] আমার নথিতে, উদহারণ হিসেবে, এমন এক রোগীর বিষয়ে উল্লেখ রয়েছে যার কাছে বিশ বছরেরও বেশি আগে paradoxical intention বা বৈপরিত অভিপ্রায়  প্রয়োগ করা হয়েছিল; তা সত্ত্বেও, থেরাপিউটিক প্রভাবের স্থায়ীত্ব প্রমানিত হয়েছে।

সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বিষয়টি হলো যে paradoxical intention বা বৈপরিত অভিপ্রায় সংশ্লিষ্ট ঘটনার etiological বা কারণতত্ত্বগত ভিত্তি নির্বিশেষে কার্যকর। আর তা একদা ইডিথ ওয়েসকপফ-জোয়েলসন কর্তৃক করা এক বিবৃতিকে নিশ্চিত করে: “যদিও প্রচলিত মনঃচিকিৎসা জোর দিয়ে বলে যে থেরাপিউটিক অনুশীলন হতে হবে রোগের কারণতত্ত্বের অনুসন্ধানের পর প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে, এটি সম্ভব যে নির্দিষ্ট কোনো উপাদান শিশু বয়সে স্নায়ুবৈকল্য সৃষ্টি করতে পারে এবং সম্পূর্ণভাবে আলাদা কোনো উপাদান প্রাপ্ত বয়সে স্নায়ুবৈকল্যের উপশম হতে পারে”। [6]

স্নায়ুবৈকল্যের প্রকৃত সংশ্লিষ্ট কারনের ক্ষেত্রে, কাঠামোগত উপাদান ব্যতীত, হোক তা স্বভাবে শারিরীক বা মানসিক, anticipatory anxiety বা পূর্বাভাসজনি উদ্বেগ হিসেবে ফিডব্যাক মেকানিজমকে একটি প্রধান pathogenic বা রোগের কারণ হতে পারে এমন উপাদান বলে মনে হয়। ভয় বা ফোবিয়ার মাধ্যমে কোনো নির্দিষ্ট উপসর্গের প্রতি সাড়া দেওয়া হয়, যে ভয় উপসর্গের সূত্রপাত করে, আর উপসর্গ পর্যায়ক্রমে ভয়কে জোরদার করে। একই ধরনের কোনো ঘটনাক্রম কিন্তু মাত্রাতিরিক্ত বাধ্যকরণক্ষম বা obsessive-compulsive বৈকল্যের ক্ষেত্রেও লক্ষ্য করা যায় যেখানে রোগী তাকে হানা দেওয়া বা বারংবার ফিরে আসা ধারনার সাথে সংগ্রাম করে করে[7]। যার ফলে, সে তাকে বিশৃঙ্খল করার জন্য তাদের শক্তিকে বৃদ্ধি করে, কারণ মানসিক চাপ counter-pressure বা বিপরীত মাননিক চাপকে ত্বরান্বিত করে। আবারও, উপসর্গকে জোরদার করা হয়! অন্যদিকে, রোগী যখনই তার অবসেশন বা আচ্ছন্নতার বিরুদ্ধে সংগ্রাম থামিয়ে দেয় এবং শ্লেষপূর্ণ উপায়ে তাদের মোকাবিলা করার মাধ্যমে আচ্ছন্নতাকে উপহাস করার চেষ্টা করে – বৈপরিত অভিপ্রায় প্রয়োগের মাধ্যমে – তাহলে দুষ্টচক্রকে ছেদ করা হয়, উপসর্গের হ্রাস পায় এবং অবশেষে ক্ষয় হয়ে যায়। উপসর্গের আমন্ত্রন ও উদব্রেগ করে এমন অস্তিত্ত্বগত শুন্যতাহীন সৌভাগ্যজনক ঘটনায়, রোগী তার স্নায়ুবৈকল্যজনিত ভয়কে উপহাস করায় সফল হবে না তবে অবশেষে সম্পুর্নরুপে তাকে উপেক্ষা করায় সফল হবে।

আমরা যেমনটি লক্ষ্য করি, anticipatory anxiety বা পূর্বাভাসজনি উদ্বেগকে paradoxical intention বা বৈপরিত অভিপ্রায়ের মাধ্যমে ব্যর্থ করতে হবে; অত্যধিক-অভিপ্রায় বা hyper-intention ও অত্যধিক-প্রতিফলনকে বিপ্রতিফলন de-reflection বা দিয়ে প্রতিহত করতে হবে; তবে, শেষপর্যন্ত রোগীর জীবনকে বিশেষ বৃত্তি ও লক্ষ্যের দিকে পরিচালিত হওয়া ছাড়া de-reflection বা বিপ্রতিফলন সম্ভব নয়[8]

স্নায়ুবৈকল্য রোগীর আত্ম-উদ্বেগ নয়, হতে পারে অনুকম্পা বা ঘৃনা, যা প্রক্রিয়া গঠনে বিঘ্ন ঘটায়; আত্ম-সীমাতিক্রমী শক্তিই হলো সুস্থতার সূত্র!

সমষ্টিগত স্নায়ুবৈকল্য (THE COLLECTIVE NEUROSIS)

প্রতিটি বয়সেই তার নিজস্ব সমষ্টিগত স্নায়ুবৈকল্য রয়েছে, আর প্রতিটি বয়সই তার সাথে খাপ খাইয়ে নেওয়ার জন্য এর নিজস্ব মনোঃচিকিৎসার দরকার হয়। বর্তমান সময়ের গণ-স্নায়ুবৈকল্য হচ্ছে অস্তিত্ত্বের শুন্যতা যাকে একান্ত ও ব্যক্তিগত নাস্তিবাদের আকার হিসেবে বর্ণনা করা যেতে পারে, কারণ নাস্তিবাদকে সত্তা বা অস্তিত্ত্বের কোনো অর্থ নাই যুক্তিতে সংজ্ঞায়িত করা যেতে পারে। যাহোক, সাইকোথেরাপি বা মনোঃচিকিৎসার ক্ষেত্রে এটি এ বৃহত্তর পরিস্থিতির সাথে কখনও ঠিকে থাকতে পারবে না যদি না তা সমসাময়িক নাস্তিবাদ দর্শনের প্রবণতার প্রভাব ও প্রতাপ থেকে নিজেকে মুক্ত রাখে; অন্যথায় তা এর সম্ভাব্য নিরাময়ের চেয়ে বৃহৎ স্নায়ুবৈকল্যের উপসর্গকে উপস্থান করে। সাইকোথেরাপি বা মনোঃচিকিৎসা কেবল নাস্তিবাদী দর্শনকে প্রতিফলিত করবে তা না, কিন্তু, যদিও অনিচ্ছাকৃতভাবে ও অজ্ঞাতসারে, প্রকৃতপক্ষে কোনো মানুষের সত্যিকারের চিত্রেরের চেয়ে এক ব্যঙ্গচিত্রকেও রোগীর কাছে সঞ্চারিত করবে।

সর্বাগ্রে, মানুষের “nothingbutness” বা ‘কিছুনাবরংত্ব’ এর মাঝে এক সহজাত বিপদ রয়েছে, এমন এক থিওরী বা তত্ত্ব যা মানুষকে জৈবিক, মনস্তাত্ত্বিক ও সমাজতাত্ত্বিক পরিস্থির ফল, বা বংশগতি আর প্রতিবেশের উৎপন্নদ্রব্য ব্যতীত কিছুই মনে করে না। মানুষের এহেন দৃষ্টিভঙ্গি একজন স্নায়ুবৈকল্য ব্যক্তিকে তার যা বিশ্বাস করার প্রবণতা রয়েছে তা বিশ্বাস করতে বাধ্য করে, যেমন, তার বিশ্বাস যে সে দাবার বড়ে এবং বাহ্যিক প্রভাবের বা আভ্যন্তরীণ পরিস্থিতির শিকার। এই স্নায়ুবৈকল্যগত অদৃষ্টবাদকে, মানুষ যে মুক্ত তা বিশ্বাস করতে অস্বীকৃতি জানায় এমন সাইকোথেরাপি দ্বারা লালিত এবং জোরদার করা হয়।

নিশ্চয়, একজন মানুষ এক সসীম সত্ত্বা, এবং তার স্বাধীনতাও সীমিত। পরিস্থিতি থেকে এ স্বাধীনতা নয়, বরং পরিস্থিতির প্রতি পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য এ স্বাধীনতা। আমি যেমন এক সময় বলেছিলাম: “স্নায়ুবিজ্ঞান ও মনোচিকিৎসা ক্ষেত্রের একজন প্রফেসর হয়ে আমি যথাযথভাবে জানি মানুষ কতটুকু জৈবিক, মনস্তাত্ত্বিক ও সমাজতাত্ত্বিক পরিস্থিতির মুখাপেক্ষি। কিন্তু দু’টি ক্ষেত্রের একজন প্রফেসর হওয়ার পাশাপাশি আমি চারটি বন্দী শিবির থেকে বেঁচে আসা একজন মানুষ এবং একইভাবে অপ্রত্যাশিত মাত্রায় মানুষ এমনকি অনুমেয় সবচেয়ে খারাপ পরিস্থিতিকে অস্বীকার এবং মোকাবিলা করতে কতটুকু সক্ষম আমি তারও সাক্ষী বহন করি[9]

প্যান-পরিনামবাদের সমালোচনা (Critique of Pan-Determinism)

মনঃসমীক্ষণ প্রায় সময় তথাকথিত প্যান-যৌনতা হিসেবে সমালোচিত হয়েছে। আমি নিজেও এই নিন্দা বৈধ ছিল কিনা তা সন্দেহ করি। যাহোক, আমার কাছে এমনকি আরও বেশি এক ভ্রান্ত ও বিজ্জনক ধৃষ্টতা রয়েছে বলে মনে হয়, যেমন, যাকে আমি প্যান-পরিনামবাদ বা Pan-Determinism বলে আখ্যায়িত করি। তাতে আমি মানুষের এমন দৃষ্টিভঙ্গিকে বোঝায় যা যেকোনো পরিস্থিতিতে তার পদক্ষেপ নেওয়ার সামর্থকে উপেক্ষা করে। মানুষ সম্পূর্ণভাবে শর্তযুক্ত এবং নির্ধারিত নয় বরং সে পরিস্থিতির প্রতি নিজেকে সপে দেবে কিনা বা তাতে স্থির হয়ে দাঁড়াবে কিনা তার নির্ধারন করে। অন্য অর্থে, মানুষ শেষ পর্যন্ত আত্ম-নির্ধারণকারী। মানুষ কেবলই ঠিকে বা বেঁচে থাকে তা নয় কিন্তু সে সময়ই তার অস্তিত্ব বা বেঁচে থাকা কি হবে, পরবর্তী মুহুর্তে সে কি হয়ে উঠবে তার সিদ্ধান্ত নেয়।

একই নিশ্চয়তার মাধ্যমে, যে কোনো ক্ষণে পরিবর্তীত হওয়ার স্বাধীনতা মানুষের রয়েছে। তাই, এক পূর্ণাঙ্গ দলের উপর কেবল এক পরিসংখ্যানগত জরিপের উল্লেখ করে বৃহৎ কাঠামোর ভেতর দিয়ে আমরা তার ভবিষ্যৎ সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বাণী করতে পারি; যদিও স্বতন্ত্র ব্যক্তিত্ব মূলত ভবিষ্যদ্বাণীর বাইরে রয়ে যায়। যেকোনো ভবিষ্যদ্বাণীর ভিত্তিকে জৈবিক, মনস্তাত্ত্বিক বা সমাজতাত্ত্বিক পরিস্থিতির দ্বারা তুলে ধরা হবে। তবুও, মানুষের অস্তিত্ত্বের বা জীবনের একটি বৈশিষ্ট্য হলো এহেন পরিস্থিতির উর্ধে উঠার তার ক্ষমতা, তার উর্ধে বেড়ে উঠা।  সম্ভব হলে পৃথিবীকে ভালোর জন্য পরিবর্তনে সক্ষম মানুষ, এবং দরকার হলে নিজেকে ভালোর জন্য পরিবর্তন করতে সক্ষম।


[1] New York, The Macmillan Co., 1956, p. 92.

[2] Writer’s cramp হলো এক বিশেষ ধরনের অধিশ্রয়ণিক ব্যাধি বা নাড়াচাড়া করার ব্যাধি যা আপনার আঙ্গুল, হাত, বাহুকে আক্রান্ত করে। হাতের অধিশ্রয়ণিক ব্যাধি হলো এক স্নায়ুবিক নাড়াচাড়া ব্যাধি। 

[3] বাধ্যবাধকতামূলক (হাত) ধৌতকরণ ব্যাধিতে ভোগা লোকেরা মাত্রাতিরিক্ত ও পুনরাবৃত্তিমূলকভাবে সংক্রমনের অতিরিক্ত ও অযৌক্তিক ভয়ের সাথে সম্পৃক্ত তীব্র যন্ত্রনা থেকে মুক্তির প্রচেষ্টায় হাত ধোয়া সম্পাদন করে।

[4] অধিকাংশ ক্ষেত্রে, নিদ্রাহীতার ভয়, প্রাণী যে নিজেকে নিজে সর্বনিম্ন পরিমানের প্রকৃত পক্ষে প্রয়োজনীয় ঘুম সরবরাহ করে সে সম্পর্কে রোগীর অজ্ঞতার কারণেই হয়ে থাকে।

[5] American Journal of Psychotherapy, 10(1956), p. 134.

[6] ভিয়েনার মনঃচিকিৎসা ধারার উপর কিছু মন্তব্য (Some Comments on a Viennese School of Psychiatry)

[7] এটি প্রায়শই রোগীর ভয়ের মাধ্যমে অনুপ্রাণিত হয় যে তার অবসেশন কোনো আসন্ন বা এমনকি প্রকৃত মনঃবৈকল্যকে নির্দেশ করে; রোগী প্রায়োগিক বিষয়টি সম্পর্কে অবগত নয় যে obsessive-compulsive neurosis বা মাত্রাতিরিক্ত বাধ্যকরণক্ষম স্নায়ুবৈকল্য কোনো আনুষ্ঠানি মনোবৈকল্যর বিরুদ্ধে তাকে এই দিকে বিপদগ্রস্ত করার চেয়ে অনাক্রম্য করছে।

[8] এই বিশ্বাসকে এ্যাপোর্ট সমর্তন দিয়েছেন যিনি একদা বলেছিলেন, “লড়ায়ের লক্ষ্য যখন সংঘাত থেকে স্বার্থহীন উদ্দেশ্যে পরিবর্তন হয়, জীবন তখন সামগ্রিকভাবে আরও সুন্দর হয়ে উঠে এমনকি যদিও স্নায়ুবৈকল্য কখনও সম্পুর্ণভাবে উদাও নাও হতে পারে” (op. cit., p. 95)।

[9] “Value Dimensions in Teaching,” a colour television film produced by Hollywood Animators, Inc., for the California Junior College Association.

ডাক্তার জে. এর একটি ঘটনা উল্লেখ করছি। আমার পুরো জীবনে সাক্ষাৎ পাওয়া সকল মানুষের মধ্যে তিনি ছিলেন কেবণমাত্র মানুষ যাকে আমি একজন ম্যাফিস্টোফেলিয়ান (শয়তানিক অবয়ব) বা মন্দ সত্ত্বা ডাকতে সাহক করি। সে সময়টাতে তাকে সাধারণভাবে “স্টেইনফের গণ-হত্যাকারী” (স্টেইনফ-ভিয়েনার বৃহৎ মানসিক হাসপাতাল) হিসেবে আখ্যায়িত করা হচ্ছিল। নাৎসি বাহিনী যখন তাদের ইউথেইনেযিয়া (euthanasia) কর্মসূচি শুরু করেছিল তখন তিনি তার হাতে সমস্ত ক্ষমতা ধরে রেখেছিলেন এবং তিনি তার নিযুক্ত কাজে এতই কট্টর ছিলেন যে তিনি চেষ্টা করেছিলেন যেন কোনো মনোব্যাধিগ্রস্ত ব্যক্তি গ্যাস চেম্বার থেকে পালিয়ে না যায়। যুদ্ধের পর, আমি যখন ভিয়েনায় চলে এসেছিলাম তখন আমি ডাক্তার জে. কে কি ঘটেছিল সে বিষয়ে প্রশ্ন করেছিলাম।“রাশিয়ানদের দ্বারা তাকে স্টেইনফের এক নির্জন কক্ষে আমাকে বন্দী করা হয়েছিল”, সে আমাকে বলেছিল। পরের দিন যদিও তার কক্ষের দরজাটি খোলা অবস্থায় পাওয়া যায় এবং ডাক্তার জে. যাকে আর কখনও পুণরায় দেখা যায় নি”। পরে আমি বুঝেতে পেরেছিলাম যে, অন্যান্যদের ন্যায়, তার সহকর্মিদের সহযোগিতায় সে দক্ষিন আমেরিকায় চলে যায়। আরও সম্প্রতি, যদিও, যাকে ইউরোপকে দু’ভাগে ভাগ করা রাজনৈতিক সীমানার পূর্ব দিকে বহু বছর ধরে কারাবন্দী থাকা এক সাবেক অস্ট্রিয়ান কুটনৈকিত আমার সাথে পরামর্শ করেন, প্রথমে তিনি সাইবেরিয়া এবং তারপর মস্কোর বিখ্যাত লুবিয়াঙ্কা জেলে বন্দী ছিলেন।  আমি যখন তাকে স্নায়বিকভাবে পরীক্ষা করছিলা, তিনি হঠাৎ করে আমি ডাক্তার জে. কে চিনি কিনা জিজ্ঞেস করলেন। আমার হ্যাঁ সুচক জবাবের পর তিনি বলতে থাকলেন: “তার সাথে আমার পরিচয় হয় লুবিয়াঙ্কা জেলে। সেখানে চল্লিশ বছর বয়সে মূত্রথলির ক্যান্সারে তিনি মারা যান। যদিও, তার মৃত্যুর পূর্বে তিনি নিজেকে শ্রেষ্ঠ কমরেড হিসেবে প্রমান করে গিয়েছেন! তিনি সবাইকে সান্ত্বনা দিয়েছিলেন। সর্বোচ্চ অনুমেয় নৈতিক মানদণ্ডে জীবন-যাপন করেছিলেন। আমার দীর্ঘ কারাবাসে তাকেই আমি বিশ্বস্ত বন্ধু হিসেবে পায়”!

এটাই ডাক্তার জে. সম্পর্কে কাহিনী, যাকে মানুষ “স্টেইনফের গণ-হত্যাকারী” হিসেবে চিনতো। কিভাবে আমরা মানুষের আচরণের ভবিষ্যদ্বাণী করতে পারি? আমরা হয়তো কোনো ইঞ্জিনের, যন্ত্রমানবের গতিবিধির ভবিষ্যদ্বাণী করতে পারি; তার চেয়েও অধিক আমরা এমনকি ভবিষ্যদ্বাণী করতে চেষ্টা করি মানুষের মনের নির্মাণকৌশল বা “গতিশীলতা” বা dynamism সম্পর্কে। কিন্তু মানুষতো মনের চেয়েও বেশী কিছু।

যাইহোক, স্বাধীনতা বা মুক্তি কিন্তু শেষ কথা নয়। স্বাধীনতা কেবল গল্পের অংশ ও অর্ধেক সত্য। স্বাধীনতা সমস্ত ঘটনার নেতিবাচক দিক ব্যতীত আর কিছুই নয় যার ইতিবাচক দিক হলো দায়বদ্ধতা। বস্তুত, স্বাধীনতা  নিছক স্বেচ্ছাচারিতায় পর্যবসিত হওয়ার বিপদ আছে যদি না তা দায়বদ্ধতার শর্তে বেঁচে থেকেছে। তাই আমি পূর্ব উপকুলের স্বাধীনতা স্তম্ভ বা স্টেচু অভ নিবার্টি’কে পশ্চিম উপকূলের দায়বদ্ধতার স্তম্ভ বা স্টেচু অভ রেসপন্সেবিলিটি’র মাধ্যমে সম্পূরণ করার সপক্ষে কথা বলি।

মনঃচিকিৎসাগত  মতবাদ THE PSYCHIATRIC CREDO

একজন মানুষকে নিয়ন্ত্রন করার মাধ্যমে একেবারে স্বাধীনতাহীন করে দিয়ে যাবে এমন অনুমেয় কিছুই নাই। তাই, তা যতই সীমিত হোক না কেনো স্বাধীনতার একটি অবশিষ্ট অংশ একজন স্নায়ুবৈকল্য কিম্বা এমনকি মনোব্যাধিগ্রস্ত মানুষের কাছে রয়ে যায়। আসলে, রোগীর গভীরতম অংশটি কিন্তু এমনকি কোনো মনোবৈকল্য দ্বারা স্পর্শিত হয় না। এক দুরারোগ্য মনোবৈকল্যগ্রস্ত ব্যক্তি সম্ভবত তার উপযোগিতা হারাতে পারে কিন্তু তবুও সে একজন মানুষের আত্ম-মর্যাদা ধরে রাখতে পারে। আর এটিই হলো মনঃচিকিৎসাগত  মতবাদ। এটি ব্যতীত একজন মনঃচিকিৎসক হওয়ার কোনো যোগ্যতা আছে বলে আমি মনে করি না। কার নিমিত্বে? কেবলই কি অসংস্কারযোগ্য এক ক্ষতিগ্রস্ত মস্তিষ্ক ইঞ্জিনের নিমিত্ত্বে? রোগী যদি স্পষ্টতই বেশি না হতো, তাহলে ইউথেনেইযিয়াকে সমর্থন দেওয়া হতো।

পূণর্মানবিকৃত মনঃচিকিৎসা (PSYCHIATRY REHUMANIZED)

দীর্ঘ সময় ধরে – বস্তু অর্ধ শতাব্দি ধরে – মানষের মনকে মনোচিকিৎসা নিছক এক নির্মাণকৌশল হিসেবে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেছে, আর ফলশ্রুতিতে মানসিক রোগের থেরাপি বা চিকিৎসাকে কেবল এক পদ্ধতি নির্ভর হিসেবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে। আমি বিশ্বাস করি এই স্বপ্ন দেখা হয়ে গিয়েছে। দিগন্তে এখন যা আভির্ভুত হতে শুরু করেছে তা কোনো এক মনস্তত্ত্বকৃত ওষুধ নয় বরং তা হলো পূণর্মানবিককৃত মনঃচিকিৎসা।

একজন ডাক্তার, যাইহোক, যে তারপরও তার নিজের ভুমিকাকে বিশেষভাবে একজন প্রকৌশলী বা যন্ত্রকারিগর এর ভুমিকায় ব্যাখ্যা করে সে স্বীকার যে, সে রোগীকে রোগের পেছনে একজন মানুষকে দেখার পরিবর্তে এক যন্ত্রের চেয়ে বেশি কিছু দেখে না!

একজন মানুষ কখনও অন্যান্য বস্তুর মধ্যে একটি বস্তু নয়; বস্তুরা একে অন্যকে নির্ধার করে, কিন্তু মানুষ  চুড়ান্তভাবে আত্ম-নির্ধারণকারী। সে যা হয়ে উঠে – জন্মগত গুণ আর পরিবেশের পরিধির ভেতরে – তা সে নিজের মধ্য থেকে নির্মাণ করে। বন্দী শিবিরের, উদহারণ সরূপ, এই জীবন্ত পরীক্ষাগারে ও এই পরীক্ষা ক্ষেত্রে, আমরা দেখেছি ও তার সাক্ষি রয়েছি কিভাবে আমাদের কোনো কোনো সহকর্মি শুকরের মতো আচরণ করেছিল, আর অন্য কেউ কেউ আচরণ করেছিল পীরের ন্যায়। মানুষ তার নিজের মাঝে উভয় বৈশিষ্টই ধারণ করে; কোন্ বৈশিষ্টটি বাস্তবায়ন করা হবে তা নির্ভর করে সিদ্ধান্তের উপর কিন্তু কোনো পরিস্থিতির উপর নয়।

আমাদের প্রজন্ম বাস্তববাদি, কারণ আমরা একজন মানুষকে সে আসলেই কি জানতে পেরেছি। সর্বোপরি, মানুষই হলো সেই স্বত্বা যে অশউইৎয এর গ্যাস চেম্বার উদ্ভাবন করেছে; তথাপি, সমুন্নত শীরে প্রভুর প্রার্থনা বা শ্যামা ইসরাইল মুখে যারা সেই গ্যাস চেম্বারে প্রবেশ করেছে তারাও সে একই স্বত্বা।

পুনশ্চ ১৯৮৪

আশাবাদের দুঃখজনক ঘটনা* Tragic Optimism

* অধ্যায়টি বিশ্ব তৃতীয় লগোথেরাপি সম্মেলন, রেজেনবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়, পশ্চিম জার্মানী, জুন ১৯৮৩’তে আমার দেওয়া লেকচারের উপর ভিত্তি করে রচিত।

এডিথ ওয়েসকপফ জুয়েসনের স্মৃতিতে উৎসর্গকৃত, যার অগ্রণী প্রচেষ্টায় ১৯৫৫ সালের দিকে যুক্ত রাষ্ট্রে লগোথেরাপি শুরু এবং যার অবদান এ ক্ষেত্রে মূল্যবান অবদান রাখে।

প্রথমেই আমাদের নিজেদের জিজ্ঞেস করতে হবে “a tragic optimism” বা ‘দুঃখজনক আশাবাদ’ এর দ্বারা কি অনুধাবন করা উচিৎ। সংক্ষেপের এর মানে হলো যে কোনো ব্যক্তি tragic triad বা ‘দুঃখজনক ত্রয়ী’ সত্ত্বেও আশাবাদী, এবং আশাবাদী থাকেন। লগোথেরাপি অনুযায়ী tragic triad বা ‘দুঃখজনক ত্রয়ী’তে মানব অস্তিত্ত্বের সে সমস্ত দিকগুলিকে (১) যন্ত্রনা, (২) অপরাধবোধ, এবং (৩) মৃত্যু দ্বারা পরিবেষ্টিত করা যেতে পারে। বস্তুত, এই অধ্যায় ‘সে সব সত্ত্বেও জীবনের প্রতি কিভাবে হ্যাঁ বলা সম্ভব?’ সে প্রশ্নসমুহ উত্থাপন করে। কিভাবে, প্রশ্নটিকে ভিন্নভাবে উপস্থাপন করতে গেলে, দুঃখজনক দিক সমূহ (১. যন্ত্র, ২. অপরাধবোধ ও ৩. মৃত্যু ) সত্ত্বে জীবন কিভাবে তার সম্ভাব্য অর্থ ধরে রাখতে পারে? সর্বোপরি, “সবকিছু সত্ত্বেও জীবনের প্রতি হ্যাঁ বলা”, যে বাক্যাংশের ভিত্তিতে জার্মান ভাষায় লিখা আমার এক বইয়ের শিরোনাম প্রকাশ করা হয়েছিল, থেকে অনুমান করে নেওয়া হয় যে, যেকোনো পরিস্থিতিতে জীবন সম্ভাবনীয়রূপে অর্থবহ, এমনকি সবচেয়ে দুর্বিষহ পরিস্থিতিতেও। আর এটি বদলে সৃজনশীলভাবে নেতিবাচক দিকগুলিকে ইতিবাচক বা গঠনমূলক কোনো কিছুতে রূপান্তর করার মানব সামর্থকে অনুমান করে। অন্য অর্থে, যা আসলেই ব্যাপার তা হলো নির্দিষ্ট অবস্থার সর্বোচ্চ সদ্ব্যবহার করা। যাহোক, “সর্বোত্তম” কে ল্যাটিন ভাষায় বলা হয় optimum বা সবচেয়ে অনুকূল – সুতরাং সেজন্যে আমি এক দুঃখজনক আশাবাদ, তা হলো মর্মান্তিক ঘটনার মুখে এক দুঃখজনক আশাবাদ ও মানব সম্ভাবনার লক্ষ্যে যা সর্বোত্তম উপায়ে সবসময়ই (১) যন্ত্রনাকে মানব সফলতা এবং অর্জনে রুপান্তর করার, (২) অপরাধবোধ থেকে নিজেকে ভালোর জন্য পরিবর্তনের সুযোগ আহরণ করার জন্য, আর (৩) জীবনের ক্ষনস্থায়ীত্ব থেকে দায়বদ্ধ পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য উদ্দীপনা আহরন করার অনুমোদন দেয়।

সুতরাং মনে রাখা দরকার যে, আশাবাদ কোনো আদেশ বা নির্দেশ করার মতো কিছু নয়। সমস্ত বৈষম্যের বিরুদ্ধে, সকল আশার বিরুদ্ধে নির্বিচারে কেউ নিজেকে বলপূর্বকভাবে আশাবাদী করতে পারে না। আর যে জিনিসটি আশার ক্ষেত্রে সত্যি, তা একইভাবে সত্যি ত্রয়ীর অন্য দুই উপাদানের ক্ষেত্রেও যেমনটি বিশ্বাস আর ভালোবাসাকে আদেশ বা নির্দেশ করা যায় না।

ইউরোপীয়দের কাছে আমেরিকান সংস্কৃতির একটি এক বৈশিষ্ট্য যে “সুখি হওয়ার” জন্য কাউকে বার বার আদেশ বা নির্দেশ করা হয়। কিন্তু সুখকে অন্বেষণ করা যায় না; তাকে সংঘটিত বা ঘটাতে হয়। “সুখি হওয়ার” জন্য কারো কোনো কারণ থাকা চাই। যখনই তার কারণ আবিষ্কৃত হয়, যাইহোক, সে আপনাআপনিতেই সুখি হয়ে উঠে। আমরা যেমন লক্ষ্য করি, কেউ সুখের অন্বেষণে একজন মানুষ নন বরং, শেষ কিন্তু ছোট নয়, এক প্রদত্ত পরিস্থিতিতে সম্ভাব্য সহজাত ও সুপ্ত অর্থ’কে বাস্তবায়নের মাধ্যমে সুখি হওয়ার কারণ সন্ধানে সে।

কারণ বা হেতুর এই প্রয়োজনীয়তা বিশেষভাবে অন্য এক মানবীয় ঘটনা ‘হাসি’র বেলায় একই জিনিস লক্ষ্য করা যায়। আপনি যদি কাউক হাসাতে চান তাহলে তাকে আপনার হাসার কারণ সরবরাহ করতে হবে, যেমন, তাকে আপনি কোনো কৌতুক বলবেন। অন্য কোনোভাবেই তাকে অনুরোধের মাধ্যমে বা নিজেকে হাসার অনুরোধ করে প্রকৃত হাসির উদ্রেগ করা সম্ভব নয়। তা করতে গেলে কোনো ক্যামেরার সামনে দাঁড়িয়ে “ছিয” (cheese) বলার জন্য অনুরোধ করার সমতুল্য হবে; তাতে কেবল দেখা যাবে চুড়ান্ত ছবিতে কৃত্রিম হাসিতে তাদের হিমায়িত অবয়ব সমূহ।

লগোথেরাথিতে এধরনের আচরণকে বলা হয় hyper-intention বা অত্যধিক অভিপ্রায়। যৌন স্নায়ুবৈকল্য হওয়ার পেছনে এটি এক গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করে, হতে পারে তা কামশীতলতা বা যৌন অক্ষমতা। নিজেকে ভুলে যাওয়ার পরিবর্তে নিজেকে সমর্পনের মাধ্যমে রোগী যত বেশি সরাসরিভাবে যৌন উত্তেজনার চেষ্টা করে, যেমন, যৌন সুখ, ততবেশি যৌন সুখের এই অন্বেষণ আত্ম-পরাজয়মূলক হয়ে উঠে। প্রকৃত পক্ষে, যাকে আমরা pleasure principle বা সুখ তত্ত্ব বলি, সেটাই বরং এক fun-spoiler বা আনন্দ ধ্বংশকারী।

যখন জীবনের অর্থ সন্ধান করায় কোনো ব্যক্তি সফল হয়, তখন তা কেবলই তাকে সুখি করে না বরং যন্ত্রনাভোগের সাথে খাপ খাইয়ে নেওয়ার সামর্থও তাকে দান করে। কি হবে যদি কারো অর্থ’র জন্য হাতড়ে বেড়ানো প্রচেষ্টায় সে ব্যর্থ হয়? তা সম্ভবত কোনো মারাত্ব অবস্থায় উপনিত হতে পারে। উদাহরণ সরুপ আমরা যুদ্ধ-বন্দীদের শিবিরে বা বন্দী শিবিরের মতো চরম পরিস্থিতিতে মাঝে মাঝে কি ঘটেছিল তা স্মরণ করা যেতে পারে। প্রথমে দিকে, আমেরিকান সৈনিকদের কর্তৃক আমাকে বলা হয়েছিল এক ধরনের আচরণ-বিধি দানা বাঁধে যাকে তারা give-up-itis হিসেবে আখ্যায়িত করতো। বন্দী শিবিরে এই আচরনের সাথে তুলনা করা হতো সকাল পাঁচটায় উঠতে এবং কাজে যাওয়ার অস্বীকৃতি জানিয়ে ছাউনিতে মল-মুত্রে সিক্ত খড়ের উপর রয়ে যাওয়া লোকদের। কোনো কিছুই – কোনো সতর্কতা বা হুমকি তাদের মন পরির্তন করাতে পারতো না। আর তারপর সাধারণ কিছু একটা ঘটে: তারা তাদের পকেটেরে গভীর থেকে লুকিয়ে রাখার একটি সিগারোট বের করে আনে আর টানতে থাকে। সেই মুহুর্তে আমরা জানতাম যে পরবর্তী আটচল্লিশ ঘন্টা বা তারও অধিক সময়ের মধ্যে আমরা তাদের মরে যেতে দেখবো। অর্থ’র সন্ধানে ছুটে চলার চেষ্টা প্রশমিত হয়ে পড়তো, আর অবশেষে তাৎক্ষনিক সুখের সন্ধান তাদের পেয়ে বসতো।

এটা কি অন্য এক সাদৃশ্যতার স্মারক নয়, এমন এক সাদৃশ্যতা যা প্রাত্যহিক জীবনে আমাদের মুখোমুখি করে? আমি সেসব যুকদের কথা ভাবি যারা বিশ্বের দরবারে নিজেদেরকে no future generation বা ভবিষ্যৎহীন প্রজন্ম হিসেবে পরিচয় দেয়? বস্তুত, কেবল বন্দীদের মতো একটি সিগারেটেরে প্রতিই তারা আশ্রয় নেয় না; তারা আসলে আশ্রয় নেয় নেশা বা মানকদ্রব্যে।

প্রকৃতপক্ষে, মাদক পরিস্থিতি হলো গণ-ঘটনা প্রবাহের এক সাধারণ দিক, যেমন আমাদের অস্তিত্ত্বগত প্রয়োজনের হতাশার ফলে সৃষ্ট অর্থহীনতার অনুভূতি যা পালাক্রমে আমাদের শিল্প সমাজে এক সার্বজনিন ঘটনায় রুপ নিয়েছে। আজ কেবল লগোথেরাপিষ্টরাই অর্থহীনতার অনুভূতিকে স্নায়ুবৈকল্যের কারণ হিসেবে ক্রমবর্ধমান ভুমিকা পালন করছে বলে দাবি করছে তা নয়। যুক্তরাষ্ট্রের স্ট্যান্টফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের আরভিন ডি. ইয়ালুম Existential Psychotherapy বা “অস্তিত্ত্বগত মনোচিকিৎসা”য় বলেন: “মনঃচিকিৎসার বহিঃরোগী ক্লিনিকে থেরাপির জন্য আবেদন করা চল্লিশজন রোগীর মাঝে..বারজন (৩০ শতাংশ) মানুষের জীবনের অর্থ সম্পর্কিত কিছু প্রধান সমস্যা ছিল (আত্ম-নির্ধারন, থেরাপিষ্ট, বা স্বাধীন বিচারক থেকে সাব্যস্ত)”। [1]কালিফোর্নিয়ার পালো আল্টো থেকে হাজার হাজার মাইল পশ্চিশে পরিস্থিতির ভিন্নতা কেবল ১ শতাংশ; সবেচেয়ে সাম্প্রতিক প্রাসঙ্গিক জরিপে দেখা যায় যে ভিয়েনার ২৯ শতাংশ জনগণ অভিযোগ করে যে তাদের জীবন থেকে অর্থ হারিয়ে গেছে।

অর্থহীন অনুভূতির কারণ হিসেবে, যদিও অতিসরলীকরণ মেজাজে কেউ বলতে পারে যে জীবন ধারণের জন্য মানুষের যতেষ্ট রয়েছে কিন্তু , যার জন্য তাদের বেঁচে থাকা উচিৎ এমন কোনো কিছুই তাদের নেই; তাদের জীবন ধারনের উপায় রয়েছে তবে অর্থ নেই। নিঃসন্দে, অনেকের এমনকি স্বপ্নও নেই। বিশেষকরে, আমি আজকের দিনের বেকার বহু সংখ্যক মানুষের কথা চিন্তা করি। পঞ্চাশ বছর আগে, আমি যুবক বয়সের রোগীদের মাঝে আমার নির্ণনয় করা unemployment neurosis বা বেকারত্ব স্নায়ুবৈকল্য নামের এক বিশেষ ধরনের হতাশায় নিবেদিত একটি গবেষণা প্রকাশ করেছিলাম”।[2] আমি দেখাতে পারি যে unemployment neurosis বা বেকারত্ব স্নায়ুবৈকল্যের উৎস আসলেই এক দ্বিগুনা/দ্বিমূখী ভ্রান্ত সনাক্তকরণে: তাতে কাজহীনতাকে নিষ্ফল হওয়ার সমান বিবেচনা করা হয়েছিল, আর নিষ্ফল হওয়াকে অর্থহীন জীবনের সমান বিবেচনা করা হয়েছিল। ফলশ্রুতিতে আমি যখন রোগীদের এক যুব সংঘে, বয়স্ক শিক্ষায়,গণ-পাঠাগারে ও এরকম সেবামূলক প্রতিষ্ঠানে স্বেচ্চাসেবা দানে উদ্বুদ্ধ করতে সফল হয় – বা অন্য অর্থে, যখনই তারা তাদের পর্যাপ্ত অবসর সময় কিছু অবৈতনিক কিন্তু অর্থবহ কাজের মাধ্যমে পূর্ণ করতে পারে – তাদের অর্থনৈতিক অবস্থার কোনো পরিবর্তন না হলেও এবং ক্ষুধা একই রয়ে গেলেও তাদের হতাশা দূর হয়ে যায়। সত্যি কথা হলো যে মানুষ কেবলই কল্যাণমূলক কাজে বাচে না।

কারো আর্থসামাজিক অবস্থা দ্বারা সৃষ্ট বেকারত্ব স্নায়ুবৈকল্যের পাশাপাশি সাইকোডাইনামিক বা জৈবরসায়নিক অবস্থার দ্বারা সৃষ্ট অন্য প্রকার হতাশাও রয়েছে। তদনুসারে, সাইকোথেরাপি এবং ফার্মাসিউটিকল প্রতিষেধকের মাধ্যমে ফার্মাকোথেরাপি যথাক্রমে নির্দেশিত। যতদুর অর্থহীনতার অনুভূতি বিবেচ্য, আমাদের উপেক্ষা ও ভুলে যাওয়া উচিৎ নয় যে, স্বতন্ত্রভাবে, এটি কোন রোগবিজ্ঞানের বিষয় নয়; বরং এক স্নায়ুবৈকল্যের চিহ্ন এবং উপসর্গ হওয়ার চেয়ে, আমি বলবো এটি কারো মনুষ্যত্ব বা মানবতার প্রমান। কিন্তু, যদিও এটি রোগবিদ্যাগত কোনো কিছুর দ্বারা সৃষ্ট নয়, তা এক রোগবিদ্যাগত প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করতে পারে; অন্য অর্থ এটি সম্ভাব্যভাবে রোগজনক বা রোগ ‍সৃষ্টিকারী। কেবল তরুন প্রজন্মের মাঝে বিস্তৃত গণ-স্নায়ুবৈকল্যজনিত লক্ষণকে বিবেচনা করুন: যতেষ্ট গবেষণামূলক প্রমান রয়েছে যে এই উপসর্গের তিনটি দিক – হতাশা, আগ্রাসন, আসক্তি – সমূহ লগোথেরাপি অনুযায়ী শুন্যতা আর অর্থহীনতার অনুভূতি “অস্তিত্ত্বগত শুন্যতা”র কারণে হয়ে থাকে।

এটা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, প্রতিটি হতাশার জন্য অর্থহীনতার অনুভূতি দায়ী নয়, আত্ম-হত্যাও সবসময় অস্তিত্ত্বগত শুন্যতা থেকে সৃষ্ট নয় – যাতে মাঝে মাঝে হতাশা ঘটে। কিন্তু যদি প্রতিটি আত্ম-হত্যার ঘটনা অর্থহীনতার অনুভূতি থেকে ধারণ করা না হয়, তাহলে ব্যাপারটা এমন হতে পারে যে কোনো ব্যক্তির জীবন নেওয়ার তাড়নাকে অতিক্রম করা সম্ভব হতো, যদি তাকে কোনো অর্থ এবং বেঁচে থাকারযোগ্য উদ্দেশ্য সম্পর্কে সচেতন করা হতো ।

যদি, এভাবে, আত্ম-হত্যা প্রতিরোধে কোনো ‘অর্থ স্থিতিকরণ’ সিদ্ধান্তমূলক ভুমিকা পালন করে, তাহলে আত্মহত্যার ঝুঁকি আছে এমন ক্ষেত্রে হস্তক্ষেপে কি হবে? একজন যুবক ডাক্তার হিসেবে আমি অস্ট্রিয়ার সবচেয়ে বৃহৎ হাসপাতালে চারবছর কাঠিয়েছিলাম করেছিলাম যেখানে আমি মারাত্মকভাবে হতাশ রোগীদের আবাসিত করা শিবিরের দায়িত্বে ছিলাম – যাদের অনেককে আত্মহত্যার প্রচেষ্টার পর সেখানে ভর্তি করা হয়েছিল। আমি একদা হিসেব করে দেখেছিলাম যে সে চার বছরে আমি বারো হাজার রোগী পরীক্ষা করেছিলাম। পুঞ্জীভূত হওয়ার মধ্যে ছিল অভিজ্ঞতার ভাণ্ডার যেখান থেকে আত্মহত্যার প্রবণ কারো মুখোমুখি হলেই আমি এখনও আহরণ করি। এরকম কোনো ব্যক্তির কাছে আমি বর্ণনা করি যে আত্মহত্যার চেষ্টা সফল না হওয়াই তারা কতো খুশি ছিল তা রোগীরা আমাকে বারংবার ব্যক্ত করেছিল; বহু সপ্তাহ, বহু মাস, বহু বছর পরে তারা আমাকে বলে যে, তাদের সমস্যার সমাধান ছিল, উত্তর ছিল তাদের প্রশ্নের, আর অর্থও ছিল তাদের জীবনে। “এমনকি যদি বিষয়াধি কেবল এক হাজার ঘটনা থেকে একটি ঘটনার ক্ষেত্রে ভালোর দিকে মোড় নেয়”, আমার বর্ণনা অব্যাহত থাকে, কে নিশ্চয়তা দিতে পারে যে আপনার ক্ষেত্রে একদিন, আগে বা পরে, তা ঘটনবেনা? কিন্তু প্রথমে, আপনাকে যেদিন তা ঘটতে পারে সে দিনকে দেখার জন্য বেঁচে থাকতে হবে, তাই আপনাকে সেই ভোর দেখতে বাঁচতে হবে, আর এখন থেকে বেঁচে থাকার দায়বদ্ধতা আপনাকে ছেড়ে যাবে না”।

গণ-স্নায়ুবৈকল্যজনিত উপসর্গের দ্বিতীয় দিকের -আগ্রাবসন- সম্পর্কে এক সময় ক্যারলিন উড শেরিফ কর্তৃত পরিচালিত অনুসন্ধানের উল্লেখ করছি। তিনি বালক স্কাউট দলের মধ্যে কৃত্রিমভাবে পারস্পরিক আগ্রাসন বা বৈরি আচরণ তৈরিতে সফল হওয়ার পর লক্ষ্য করেছিলেন যে আগ্রাসন কেবল তখনই প্রশমিত হয় যখন তরুণরা নিজেদের কোনো সামগ্রিক উদ্দেশ্যে উৎসর্গ করেছে – তা হলো তাদের ক্যাম্পে খাদ্য পবিরহন করা গাড়িটি কাদা থেকে টেনে বের করার মতো যৌথ কাজ । তাৎক্ষনিকভাবে, তারা যে কেবলই প্রতিকুলতার সম্মুখিন হয়েছিল তা নয় কিন্তু পূর্ণ করার এক অর্থ’র দ্বারা একত্রিতও হয়ে উঠেছিল তারা। [3]

গণ-স্নায়ুবৈকল্যজনিত উপসর্গের তুতীয় দিক -আসক্তি’র ব্যাপারে বলতে গেলে আমার এ্যানিমেরি ভন ফর্সটম্যায়ারের উপস্থাপন করা গবেষণার কথা মনে পড়ে, তিনি পরীক্ষা আর পরিসংখ্যান প্রমান থেকে লক্ষ্য করেছিলেন যে, তার গবেষণা করা ৯০ শতাংশ মাদক সেবনকারীরা এক ভয়ানক অর্থহীনতা অনুভূতিতে ভুগছিলো।  মাদক সেবিদের মাঝে আমেরিকান মনোবিজ্ঞানী ‍স্ট্যানলি ক্রিপার কর্তৃক করা গবেষণা মতে ১০০ শতাংশ মাদকসেবী বিশ্বাস করেছিলেন যে তাদের “সবকিছুকে অর্থহীন মনে হতো”। [4]

এখন চলুন আমরা স্বয়ং অর্থ’র প্রশ্নে দিকে ফিরে যায়।  শুরু করতেই, আমি পরিষ্কার করে দিতে চাই যে, সর্বাগ্রে, একজন মানুষকে তার জীবনজুড়ে যে সমস্ত পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হয় তাতে সম্ভাব্য সহজাত ও সুপ্ত অর্থ সম্পর্কে একজন লগোথেরাপিষ্ট উদ্বিগ্ন থাকেন। এতএব, কারো জীবনের সর্বোপরি অর্থ সম্পর্কে এখানে আমি বিস্তারিত বলছি না, যদিও আমি অস্বীকার করি না যে এরকম দীর্ঘমেয়াদি অর্থ’র অস্তিত্ত্ব নাই।  উপমা হিসেবে একটি চলচ্চিত্রের কথা চিন্তা করুন: একটি চলচ্চিত্র হাজার হাজার স্বতন্ত্র ছবি নিয়ে গঠিত, আর এর প্রত্যেক ছবিরই একটি বোধ রয়েছে এবং প্রত্যেক ছবিই একটি অর্থ বহন করে এবং চলচ্চিত্রটির শেষ অনুক্রমটি প্রদর্শনের পুর্বে চলচ্চিত্রটির পুর্ণাঙ্গ অর্থ বোঝা যাবে না। সুতরাং, প্রথমে চলচ্চিত্রটির প্রতিটি উপাদান, সকল স্বতন্ত্র ছবি না বোঝা আগে সম্পুর্ণ চলচ্চিত্রটি আমরা বুঝতে পারবো না। জীবনের ক্ষেত্রেও কি একই ব্যাপার নয়? জীবনের চুড়ান্ত অর্থও কি স্বয়ং প্রকাশ হয় না, যদি আদৌ হয়ে থাকে, কেবল তার শেষান্তে, মৃত্যুর সন্ধিক্ষনে? জীবনের এই চুড়ান্ত অর্থও কি প্রতিটি স্বতন্ত্র পরিস্থিতির সম্ভাব্য অর্থ স্ব স্ব ব্যক্তির জ্ঞান আর বিশ্বাস অনুযায়ী সর্বোত্তম বাস্তবায়ন হয়েছে কিনা তার তার উপর নির্ভর করে না?

আসল কথা হলো যে অর্থ, আর এর ধারণা, লগোথেরাপিউটিক দৃষ্টিকোণ থেকে যেমন দেখা হয়, বাতাসে ভাসমান বা গজদন্তমিনার বা নিভৃত স্থানের বাসিন্দার চেয়ে সম্পূর্ণরূপে বন্ধুসূলভ বিষয়। সুদূরপ্রসারীভাবে, আমি অর্থ’র চেতনা শনাক্ত করবো- মূর্ত অবস্থানের ব্যক্তিগত অর্থ’র- জার্মাণ মনোবিজ্ঞানী কার্ল বুঁহল্যার’র ধারণা এবং গ্যাষ্টাল্ট সাইকোলজির (Gestalt) উপলব্ধির পাশাপাশি, বলতে পারেন, মনোবিজ্ঞানী ম্যাক্স ওয়েরথেইমারের তত্ত্বের পাশাপাশি “আহা” অভিজ্ঞতার মাঝামাঝি স্থানে । অর্থ’র উপলব্ধি চিরায়ত গ্যাষ্টাল্ট সাইকোলজির ধারণা থেকে ভিন্ন, যতদুর গ্যাষ্টাল্ট সাইকোলজি কোনো “আয়তন”এ “আকার” সম্পর্কে আকস্মিক সতেচনতাকে বোঝায়, যেখানে অর্থ’র উপলব্ধি, আমি যেমনটা লক্ষ্য করি, আরও সুনির্দিষ্টভাবে, বাস্তবতার পটভুমির সম্ভাবনা সম্পর্কে সচেতন হয়ে উঠাকে বোঝায়, বা সহজ কথায় ব্যক্ত করতে হলে, প্রদত্ত কোনো পরিস্থিতিতে কি করা যেতে পারে সে সম্পর্কে সচেতন হয়ে উঠাকে বোঝায়।

এবং একজন মানুষ কিভাবে অর্থ খুঁজার কাজ শুরু করে? চার্লট বুঁহল্যার যেমনটি বলেছিলেন: “আমরা যা করতে পারি তা হলো যারা মনে করে অবশেষে মানব জীবনের উদ্দেশ্য কি যারা খুজে পায়নি তাদের বিপরীতে তার উত্তর খুজে পেয়েছে সেসব মানুষের জীবন অধ্যয়ন করা”। [5] এরকম এক জীবনীমূলক অভিগমনের পাশাপাশি, অবশ্য, আমরা জৈবিক অভিগমনেও আরোহণ করতে পারি।  লগোথেরাপি বিবেকবোধকে এক স্মারক হিসেবে ধারণ করে যা, প্রয়োজনে, প্রদত্ত জীবন পরিস্থিতিতে আমাদের অগ্রসর হতে হয় এমন দিককে নির্দেশ করে। এরকম একটি কাজ চালিয়ে নেওয়ার জন্য, বিবেকবোধকে মুখোমুখি হওয়া পরিস্থিতিতে এক পরিমাপের লাঠি হিসেবে প্রয়োগ করতে হবে, আর এই পরিস্থিতিকে এক সেট মানদণ্ডের আলোকে, মূল্যবোধের ক্রমাধিকারতন্ত্রের আলোকে মূল্যায়ীত করতে হবে। এই মূল্যবোধ সমূহকে, যাইহোক, সচেতন পর্যায়ে আমাদের দ্বারা সমর্থনদান এবং গ্রহন করা যেতে পারেনা- তারা এমন কিছু যা আমরা।  তারা আমাদের মানবপ্রজাতির বিবর্তনের গতিপথে দানা বেঁধেছে; তারা আমাদের জৈবিক অতীতে স্থাপিত এবং আমাদের জৈবিক গভীরতায় দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত। অস্ট্রিয়ার প্রাণিবিজ্ঞানী কনরাড লোরেঞ্জ যখন জৈবিক a priori[6] এর ধারণার বিকাশ করেছিলেন তার মনেও হয়তো একই রকম কিছু ছিল, আর আমরা দু‘জনেই যখন সম্প্রতি মূল্যবোধ প্রক্রিয়ার জৈবিক ভিত্তির উপর আমার নিজের ধারণা সম্পর্কে আলাপ করছিলাম, তখন তিনি উত্সাহের সাথেই তার সঙ্গতি ব্যক্ত করেন।  কোনো ক্ষেত্রে, যদি কোনো পূর্ব-প্রতিফলিত অ্যাক্সিওলজিকল[7] আত্ম-অনুধাবনের অস্তিত্ত্ব থাকে, তাহলে আমরা ধারণা করে নিতে পারি যে তা চুড়ান্তভাবে আমাদের জৈবিক ঐতিহ্যে নোঙরবদ্ধ।

লগোথেরাপি যেমন শিক্ষা দেয়, জীবনের অর্থে পৌঁছার জন্যে তিনটি প্রধান উপায় রয়েছে।  প্রথমটি হলো কোনো কর্ম সৃষ্টির মাধ্যমে বা কোনো কর্ম সাধনের দ্বারা। দ্বিতীয়টি হলো কোনো কিছুর অভিজ্ঞতা লাভের মাধ্যমে বা কারো মুখোমুখি হওয়ার মাধ্যমে; অন্য অর্থে জীবনের অর্থ কেবল কর্মে পাওয়া যায় না বরং ভালোবাসা বা প্রেমেও জীবনের অর্থ খুজে পাওয়া যেতে পারে। এডিথ ওয়েসকপফ জুয়েলসন এই প্রসঙ্গে লক্ষ্য করেছিলেন যে লগোথেরাপিউটিক অভিমত, “অভিজ্ঞতা লাভ যে অর্জনের ন্যায় মূল্যবান হতে পারে, তা থেরাপিউটিক বা চিকিৎসাসম কারণ তা অভিজ্ঞতার আভ্যন্তরীণ জগতের বিনিময়ে সফলতার বাহ্যিক জগতের উপর আমাদের এক তরফা গুরুত্বের ভারসাম্য রক্ষা করে”। [8]


[1] Basic Books, New York, 1980, p. 448.

[2]Wirtschaftskrise und Seelenleben vom Standpunkt des Jugendberaters,” Sozialärztliche Rundschau, Vol. 4 (1933), pp. 43-46.

[3] এ গবেষনার উপর আরও তত্ত্বের জন্য দেখুন Viktor E. Frankl, The Unconscious God (অবচেতন ঈশ্বর ), New York, Simon and Schuster, 1978, p. 140; and Viktor E. Frankl, The Unheard Cry for Meaning, (অর্থের জন্য না শুনা ক্রমন্দন) New York, Simon and Schuster, 1978, p. 36

[4] For further information, see The Unconscious God, pp. 97-100; and The Unheard Cry for Meaning, pp. 26-28.

[5] “Basic Theoretical Concepts of Humanistic Psychology,” American Psychologist, XXVI (April 1971), p. 378.

[6] সম্ভাব্য প্রভাবের বিষয় সম্পর্কে ধারণা দানের নীতি।

[7] Axiology– মূল্যবোধের প্রকৃতি, ধরণ, এবং মানদণ্ড এবং বিশেষত নীতিবিদ্যায় মূল্যবোধ নির্ধারণ সম্পর্কে শিক্ষা ।

[8] “The Place of Logotherapy in the World Today,” The International Forum for Logotherapy, Vol. 1, No. 3 (1980), pp. 3-7.

তবে জীবনের অর্থ’র তৃতীয় উপায়টি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ: অ্সহায় পরিস্থিতির একমনকি অসহায় ভোক্তভুগিও, তার পক্ষে পরিবর্তন করা অসম্ভব নিয়তির মুখোমুখ হয়ে, নিজেকে উর্ধে উত্থিত করতে পারে, তার নিজের উর্ধে বিকশিত হতে পারে, আর তার সম্পাদনের মাধ্যমে পারে নিজেকে পরিবর্তন করতে। সে নিজের ব্যক্তিগত দুর্দশাকে এক বিজয়ে পরিণত করতে পারে। পুণরায়, এডিথ ওয়েসকপফ জুয়েলসন, যিনি এক সময় আশা ব্যক্ত করেছিলেন যে লগোথেরাপি, “যুক্তরাষ্ট্রের বর্তমান সংস্কৃতিতে নির্দিষ্ট অস্বাস্থ্যকর প্রবণতাকে ব্যর্থ করে দিতে পারে, যেখানে একজন দুরারোগ্য ভুক্তভোগীকে তার যন্ত্রনাভোগ সম্পর্কে গর্বিত হওয়ার এবং একে মর্যাদা হানিকরের বদলে মর্যাদাসম্পন্ন বিবেচনা করার খুব কমই সুযোগ দেওয়া হয়” যার কারণে, “সে কেবল অসুখি নয় বরং অসুখি হওয়া সম্পর্কে লজ্জিতও হয়”।

পঁচিশ বছর সময় ধরে, আমি সাধারণ হাসপাতালের স্নায়ুতাত্ত্বিক বিভাগ পরিচালনা করেছিলাম এবং আমার রোগীদের সামর্থ কিভাবে তাদের দুরবস্থাকে মানব সফলতায় রুপান্তর করেছিল তার সাক্ষী ছিলাম। এরকম বাস্তব অভিজ্ঞতার পাশাপাশি, এমন গবেষণামূলক প্রমানও রয়েছে যা একজন মানুষ যে তার যন্ত্রনাভোগে জীবনের অর্থ খুঁজে পেতে পারে তার সম্ভাবনাকে সমর্থন করে। ইয়েইল ইউনিভার্সিটি অব মেডিসিন এর গবেষকেরা ভিয়েতনাম যুদ্ধের যুদ্ধ বন্দীদের সংখ্যা দেখে মুগ্ধ হয়েছিল যারা পরিষ্কারভাবে দাবি করেছিল যে তাদের বন্দী জীবন নির্যাতন, ব্যাধি, অপুষ্টি ও নির্জন অবরুদ্ধতায় পূর্ণ থাকার দরুর মানসিকভাবে অসাধারণ কষ্টকর হলেও তদুপরি বন্দীত্বের অভিজ্ঞতাকে ক্রমবৃদ্ধির এক অভিজ্ঞতা হিসেবে দেখে তা থেকে তারা লাভবান হয়েছিল।[1]

তবে “দুঃখনক আশাবাদের” পক্ষে সবচেয়ে শক্তিশালী বিতর্ক সেগুলিই যাদের ল্যাটিন ভাষায় argumenta ad hominem বা বিতর্কের পরিবর্তে বরং প্রতিপক্ষ ব্যক্তির চরিত্র, আগ্রহ বা অনুভূতির সুযোগ নেওয়াকে বোঝায় । লগোথেরাপি মতে উদহারণ হিসেবে “মানবাত্মার অদম্য শক্তি’র জেরি লং তার এক জীবন্ত সাক্ষ্য।[2] টেক্সারকানা গ্যাজেট পত্রিকার উদ্বৃতি দিয়ে বলতে হয় “জেরি লং এক ডাইভিং দুর্ঘটনার পর থেকে তার ঘাড় থেকে নিচে অবশ হয়ে আছেন যা তার সকল চার প্রত্যঙ্গকে আক্রান্ত করে তিন বছর আগে। দুর্ঘটনা হওয়ার সময় তার বয়স ছিল ১৭। আজকে টাইপ করার জন্য লং মাউথ স্টিক বা মুখ-কাঠি ব্যবহার করতে পারে। বিশেষ টেলিফোনের মাধ্যমে তিনি দু’টি কমিউনিটি কলেজ কোর্সে অংশগ্রহন করেন। ইন্টারকম বা আন্তযোগাযোগব্যবস্থা লংকে শ্রেণীকক্ষের আলোচনা শুনতে ও তাতে অংশগ্রহন করার সুযোগ করে দেয়। তিনি পড়ার মাঝে, টেলিভিশন দেখায় এবং লেখালেখিতে তার সময়ক ব্যয় করেন”। আর তার কাছ থেকে গ্রহন করা এক চিঠিতে তিনি লিখেন: “আমি আমার জীবনকে অর্থ আর উদ্দেশ্যে ভরপুর হিসেবে দেখি। যে মনোভাব আমি সেই ভয়াবহ দিনে গ্রহন করেছিলাম তা সারা জীবনের জন্য আমার ব্যক্তিগত মতবাদ হয়ে উঠে: আমি আমার ঘাড় ভেঙ্গেছি, কিন্তু তা আমাকে ভাঙ্গেনি। আমি সম্প্রতি কলেজে আমার প্রথম মনস্তাত্ত্বিক কোর্সে ভর্তি হয়েছি। আমি বিশ্বাস করি যে আমার অচলাবস্থা অন্যকে সাহায্য করার জন্য কেবল আমার সামর্থকেই বৃদ্ধি করবে। আমি জানি যে যন্ত্রনাভোগ করেছি তা ব্যতীত, আমি যে মানসিক বিকাশ অর্জন করেছি তা কখনও সম্ভব হতো না”।

এটা বলা কি আবশ্যক যে জীবনের অর্থ আবিষ্কারের জন্য যন্ত্রনাভোগ অপরিহার্য? কোনো ভাবেই না। আমি কেবল জোর দিয়ে বলতে চাই যে যন্ত্রনাভোগ সত্ত্বেও জীবনের অর্থ পাওয়া যায়, যদি, যেমনটি এই বইয়ের ‍দ্বিতীয় অংশে উল্লেখ করা হয়েছে, যদি সেই যন্ত্রনাভোগ হয়ে উঠে অপরিহার্য। যদি তা অপরিহার্য হয়ে উঠে, তাহলে এর কারণ অপসারণই হলো অর্থবহ কাজ, কারণ অপ্রয়োজনীয় যন্ত্রনাভোগ বীরত্বের চেয়ে হয়ে উঠে মর্ষকামীমূলক। যদি, অন্য অর্থে, কোনো ব্যক্তি তার যন্ত্রনার কারণ পরিবর্তন করতে  না পারে, তবুও সে যন্ত্রনার প্রতি তার মনোভাব নির্বাচন করতে পারে।[3] লং তার ঘাড় ভেঙ্গে ফেলার সিদ্ধান্ত নেননি, বরং তিনি তার উপর যা ঘটেছে তার দ্বারা নিজেকে ভাঙ্গতে না দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন।

আমরা যেমনটি লক্ষ্য করি, অগ্রাধিকার থাকে আমাদের যন্ত্রনার কারণ হওয়া অবস্থার সৃজনশীলভাবে পরিবর্তনের সাথে। কিন্তু “কিভাবে যন্ত্রনাভোগ করতে হয় জানা”র সাথে থাকে উৎকৃষ্টতা, যদি প্রয়োজন হয়। আর এমন গবেষণামুলক প্রমানও আছে যে – আক্ষরিকভাবে – যার সম্পর্কে “রাস্তার মানুষটি”র কাছেও একই মতামত রয়েছে। অস্ট্রিয়ার জনমত জরিপে অংশগ্রহনকারী ব্যক্তিরা সম্প্রতি প্রকাশ করে যে সাক্ষাৎকার নেওয়া অধিকাংশ মানুষ যাদেরকে মানুষ মর্যাদার সর্বোচ্চ স্থানে বসিয়েছে তারা কেউই মহান শিল্পি বা বিজ্ঞানী ছিলেন না, ছিলেন না কোনো মহান রাষ্ট্রনায়ক বা মহান কোনো ক্রিয়া ব্যক্তিত্ব, বরং যারা তাদের উচ্চ শিরে কঠিন নিয়তিকে নিয়ন্ত্রন করেছিল তাদেরই সম্মানে উচ্চ স্থানে বসানো হয়েছিল।

দুঃজনক ত্রয়ীর ‍দ্বিতীয় দিকে ফিরলে, যেমন অপরাধবোধ, আমি ধর্মতত্ত্বীয় ধারণা থেকে প্রস্থান করতে চাই যা সবসমই আমাকে মুগ্ধ করে আসছিল। আমি যাকে mysterium iniquitatis বলা হয় তার দিকে নির্দশ করবো, যার মানে হলো, আমি যেমনটি লক্ষ্য করি, যে কোনো অপরাধ চুড়ান্ত বিশ্লেষণে অবর্ণনীয় থেকে যায় কারণ একে পূর্নাঙ্গভাবে জৈবিক, মনস্তাত্ত্বিক বা সমাজতাত্ত্বিক উপাদানে সনাক্ত করা যায় না। কারো অপরাধকে পূর্নাঙ্গভাবে ব্যাখ্যা করাটা হবে তার অপরাধকে ব্যাখ্যা করার এবং তার মাঝে এক মুক্ত আর দায়বদ্ধ মানুষ না দেখার কিন্তু তাকে মেরামতযোগ্য এক যন্ত্র হিসেবে দেখার সমতুল্য। এমনকি অপরাধীরাও নিজেরা এই আচরণকে ঘৃণা করে এবং তাদের কর্মের জন্য দায়বদ্ধ হওয়াকে শ্রেয় মনে করে। যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয়ের কারাগারে তার কারাদণ্ড ভোগ করা একজন অপরাধীর কাছ থেকে আমি একটি চিঠি পেয়েছিলাম যাতে সে আক্ষেপ করেছিল যে, “নিজেকে ব্যাখ্যা করার জন্য একজন অপরাধীর কখনও সুযোগ থাকে না। নির্বাচন করার জন্য তার কাছে বহুবিধ অজুহাত উপস্থাপন করা হতো। সমাজকে দোষারোপ করা হয় এবং অনেক ঘটনায় দোষ দেওয়া হয় ভোক্তভুগীকে”। অধিকন্তু, আমি যখন কালিফুর্নিয়ার স্যান কুয়েন্টিন কারাগারে বন্দীদের উদ্দেশে বক্তৃতা দিয়েছিলাম, তখন আমি তাদের বলেছিলাম যে, “আপনারাও আমার মতো মানুষ, আর তদুপরি অপরাধী হওয়ার জন্য অপরাধ সংঘটনে আপনারা মুক্ত ছিলেন। এখন, যদিও, আপনারা অপরাধবোধের উর্ধে উঠে, নিজেদের উর্ধে বিকশিত হওয়ার মাধ্যমে, ভালোর জন্য পরিবর্তীত হয়ে তাকে অতিক্রম করার জন্য দায়বদ্ধ”। তারা মনে হয় বুঝতে পেরেছিল।[4] এবং এক সাবেক কারাবন্দী, ফ্রাঙ্ক ই. ডব্লিউ থেকে আমি একটি চিরকুট পেয়েছিলাম যাতে সে বলেছিল যে “সাবেক-অপরাধীদের জন্য একটি লগোথেরাপি দল শুরু করেছি। আমাদের আসল দলের সহকর্মিদের শক্তির মাধ্যমে আমরা ২৭ জন শক্তিশালী ও নতুন আগন্তুকরা জেলখানার বাইরে কাটাচ্ছি। কেবল একজন ফিরে গেছে- আর সে এখন মুক্ত। [5]

সমষ্টিগত অপরাধবোধ’র বেলায়, আমি ব্যক্তিগতভাবে বিশ্বাস করি যে কাউকে অন্য জনের বা ব্যক্তির সমষ্টির আচরণের জন্য দায়ী করা সম্পুর্ণভাবে অন্যায়। দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধের শেষে, জনসম্মুখে সমষ্টিগত অপরাধবোধ ধারণার বিরুদ্ধে তর্ক করতে আমি ক্লান্ত হয়নি।[6] মাঝে মধ্যে, যদিও, মানুষকে তাদের কুসংস্কার থেকে পৃথক করতে প্রচুর শিক্ষকসুলভ কৌশলের প্রয়োজন হয়। একজন আমেরিকান মহিলা এক সময় ভর্ত্সনার সাথে আমার মুখোমুখি হয়, “আপনি কি করে এখনও এ্যাডল্ফ হিটলারের জার্মান ভাষায় বই লিখতে পারেন?” প্রতিত্তোরে, আমি তাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম তার রান্না ঘরো ছুরি ছিল কি না, আর যখন সে উত্তর দিলো যে তার ছুরি ছিলো, তখন আমি হতাশ আর বিস্মিত হওয়ার ভান করে বিস্ময়ের সাথে বলেছিলাম, “আপনি কিভাবে সে ছুরিকে এখনও ব্যবহার করছেন যা ব্যবহার করে খুনিরা বহু ভোক্তভুগীকে ছুরিকাঘাত করেছিল ও হত্যা করেছিল?” তখন সে জার্মান ভাষায় আমার বই লেখা নিয়ে আপত্তি করা থামিয়ে দেয়।

দুঃখজনক ত্রয়ীর তৃতীয় দিক মৃত্যু সম্পর্কে। কিন্তু তা জীবনকেও সম্পর্কযুক্ত করে, কারণ যে কোনো সময় জীবন গঠিত হয় এমন প্রতিটি মুহুর্ত ক্ষয় হয়ে যাচ্ছে, আর সে মুহুর্তটি কখনও পুনরাবৃত্তি হবে না। আর তারপরও এই ক্ষনস্থায়ীত্ব কি এক স্মৃতিচিহ্ন নয় যা আমাদের জীবনের প্রতিটি মুহুর্তের সম্ভাব্য সর্বোত্ত ব্যবহারে আমাদের চ্যালেঞ্জ করে? অবশ্যই, এবং তাই আমার অত্যাবশ্যক কাজ: “বেঁচে থাকুন যেন আপনি ইতিমধ্যেই দ্বিতীয় বারের মতো জীবন-যাপন করছেন এবং আপনি যেমন এখন ভুলভাবে আচরণ করতে যাচ্ছেন ঠিক একই আচরণ যেন আপনি প্রথমবার করেছিলেন”।

বস্তুত, যথাযথভাবে পদক্ষেপ নেওয়ার সুযোগ, কোনো অর্থ পূর্ণ করার সম্ভাবনা আমাদের জীবনের অপরিবর্তনীয়তার দ্বারা প্রভাবিত। কিন্তু সম্ভাবনা সমূহও স্বতন্ত্রভাবে প্রভাবিত। কারণ যখনই আমরা কোনো সুযোগ ব্যবহার করেছি এবং সম্ভাব্য অর্থ’কে বাস্তবায়িত করেছি, তা আমরা একবারের জন্যেই করেছি। আমরা তাকে অতীতে সংরক্ষণ করেছি যেখানে তাকে নিরাপদভাবে সরবরাহ করা হয়েছে আর গচ্ছিত রাখা হয়েছে। অতীতের কাছে কোনো কিছুই অপূরণীয়ভাবে হারিয়ে যায় না, বরং বৈপরিতভাবে, সবকিছুই অপরিবর্তনীয়ভাবে সংরক্ষিত ও সঞ্চিয়ীত। নিঃসন্দেহে, মানুষ ক্ষণস্থায়ীত্বের কেবল খড়ের মাঠ দেখতে প্রবণ কিন্তু, অতীতের পূর্ণ শস্যভাণ্ডার যার ভেতর তারা তাদের জীবনের শস্য আহরণ করেছে তাকে উপেক্ষা করে এবং ভুলে যায়: কৃত কর্ম, কৃত প্রেম, আর অবশেষে, সাহস আর মর্যাদার সাথে তারা যে যন্ত্রনা পার করে এসেছে।

এখান থেকে কেউ লক্ষ্য করে থাকবে যে বয়স্ক মানুষের প্রতি করুণা করার কোনো কারণ নেই। তার বদলে, যুবক লোকদের উচিৎ তাদের ঈর্ষা করা। এটি সত্যি যে বসয়স্ক মানুষের ভবিষ্যতে কোনো সুযোগ নেই, নেই কোনো সম্ভাবনা। কিন্তু তাদের তার চেয়েও বেশি কিছু রয়েছে। ভবিষ্যতের সম্ভাবনার বদলে, তাদের রয়েছে অতীতের বাস্তবতা- যে সম্ভাবনা মসূহকে তারা বাস্তবায়িত করেছিল, যে অর্থ’কে তারা পূর্ণ করেছিল, যে মূল্যবোধকে তারা অনুধাবন করেছিল- আর কোনো কিছু এবং কেউই এসব সম্পদকে তাদের অতীত থেকে অপসারণ করতে পারে না।

যন্ত্রনাভোগের মধ্যে জীবনের অর্থ খুজে পাওয়ার সম্ভাবনা বিবেচনা করলে, জীবনের অর্থ আসলে শর্তহীন, অন্তত সম্ভাবনীয়রূপে। যাইহোক, সেই শর্তহীন অর্থকে প্রত্যেক মানুষের শর্তহীন মূল্যবোধের দ্বারা সমান্তরাল করা হয়েছে। এটি হলো সেই অর্থ যা মানুষের আত্ম-মর্যাদার অমোচনীয় গুনাগুনের নিশ্চয়তা দেয়। ঠিক যেভাবে জীবন যেকোনো পরিস্থিতিতে, এমনকি সবচেয়ে সংকটময় পরিস্থিতিতেও, সম্ভাবনীয়রূপে অর্থপূর্ণ রয়ে যায়, ঠিক সেভাবেই প্রতিটি মানুষের মূল্যবোধও তার সাথে অবস্থান করে, আর তা তার অতীতের বাস্তবায়িত মূল্যবোধের উপর নির্ভর করেই হয়ে থাকে, এবং তা বর্তমানে কেউ তার প্রয়োজনীয়তা বজায় রাখতে পারলো কি পারলো না তার  মুখাপেক্ষি নয়।

আরও নির্দষ্টিভাবে বলতে গেলে, জীবনের এই অর্থপূর্ণতা স্বভাবতই সমাজের কল্যাণের কার্যকারিতার ভিত্তিতে সজ্ঞায়িত। কিন্তু আজকের সমাজকে অর্জন স্বার্থ দ্বারা বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত করা হয়, আর ফলশ্রুতিতে সমাজ সফল আর সুখি ব্যক্তিদেরই বন্দনা করে, বিশেষ করে, সমাজ যুবকদের বন্দনা করে। ফলতঃ সমাজ ভিন্ন মতের, ভিন্ন ধারার মানুষদের মূল্যবোধকে উপেক্ষা করে, আর তার মাধ্যমে আত্ম-সম্মানবোধে মূল্যবান হওয়া এবং কার্যকারিতার বোধে মূল্যবান হওয়ার মধ্যে সুস্পষ্ট ভিন্নতাকে দুর্বোধ্য করে তোলো। কেউ যদি এই ভিন্নতা সম্পর্কে অবগত না হয়ে থাকে আর যদি ভেবে থাকে যে কোনো ব্যক্তির মূল্যবোধ বর্তমানে তার কার্যকারিতা বা উপযোগিতা থেকে আবির্ভূত হয়, তাহলে, বিশ্বাস করুন, সে হিটলারের কর্মসূচি অনুযায়ী ইউথেনেইযিয়া বা যন্ত্রণাহীন মৃত্যুর জন্য অনুনয় না করার জন্য ব্যক্তিগত অসঙ্গতির কাছে ঋণী, তা বলতে হলে, যারা সামাজিক উপযোগীতা বা কার্যকারিতা হারিয়েছে তাদের “করুণা” মৃত্যু বা  বিনা যন্ত্রণায় মৃত্যু, হতে পারে বৃদ্ধ বয়সের দরুন, দুরারোগ্য অসুস্থতা, মানসিক অবক্ষয়, অথবা যে কোনো শারীরিক অক্ষমতা। 

মানুষের মর্যাদাকে উপযোগিতা বা কার্যকারিতার সাথে বিভ্রান্ত করা ধারণাগত বিভ্রান্তি থেকে সৃষ্টি হয় যাকে পালাক্রমে বহু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আর অনেক বিশ্লেষণনির্ভর শয্যায় সঞ্চারিত হওয়া সমসাময়িক নাস্তিবাদে সনাক্ত করা যেতে পারে। এমনকি প্রশিক্ষণ বিশ্লেষণের পারিপার্শ্বিকতায় এরকম এক অনুশাসন সংঘটিত হতে পারে। নাস্তিবাদ কোনো কিছুরই অস্তিত্ব নাই বলে বিতর্ক করে না, বরং তা সবকিছুকেই অর্থহীন বলে মতামত দেয়। এবং “বিজ্ঞ অর্থহীনতা”র কথা প্রচারের সময় জর্জ এ. সার্জেন্ট ঠিকই বেলছিলেন। তিনি নিজেও একজন থেরাপিষ্টের কথা স্মরণ করেন যে তাকে বলেছিলেন, “জর্জ, আপনাকে বুঝতে হবে পৃথিবীটায় একটা উপহাস। এখানে কোনো ন্যয়বিচার নাই, সবকিছুই যেন এলোমেলো। কেবল যখনই আপনি তা অনুধাবন করতে পারবেন তখন আপনি বুঝবেন নিজেকে একনিষ্ঠতার সাথে নেওয়াটা কতোটা বোকাটে ব্যাপার। বিশ্বভ্রহ্মাণ্ডে কোনো মহৎ উদ্দেশ্য নাই। কেবল তাই। আজ আপনি কিভাবে আচরণ করবেন সে সম্পর্কে যে সিদ্ধান্ত নেবেন তাতে কোনো বিশেষ অর্থ নেই”।[7]

এরকম এক সমালোচনাকে সাধারণীকরণ করা উচিৎ হবে না। নীতিগতভাবে, প্রশিক্ষণ অপরিহার্য, কিন্তু যদি তাই হয়ে থাকে, তাহলে নৈরাশ্যবাদে সংক্রমিত করার চেয়ে থেরাপিষ্টদের নাস্তিবাদের বিরুদ্ধে প্রশিক্ষাণার্থীদের প্রতিষেধক প্রদানকে তাদের কাজ হিসেবে দেখা উচিৎ যা তাদের নিজস্ব নাস্তিবাদের বিরুদ্ধে এক প্রতিরক্ষা কৌশল।

লগোথেরাপিষ্টরা এমনকি অন্যান্য ধারার সাইকোথেরাপি কর্তৃক নির্ধারিত কিছু প্রশিক্ষণ আর লাইসেন্সিং প্রয়োজনীয়তা মেনে চলতে পারে। অন্য অর্থে, কেউ হয়তো হায়েনার সাথে গর্জন করতে পারে, যদি দরকার পড়ে, কিন্তু তা করার সময় আমি অনুরোধ করবো কাউকে হায়েনার বেশে ভেড়া হওয়ার জন্য। মানুষের মৌলিক ধারনার প্রতি অসত্য হওয়ার কোনো দরকার নেই এবং জীবন দর্শনের নীতি লগোথেরাপিতে অন্তর্নিহিত। এরকম আনুগত্য বজায় রাখার কষ্টসাধ্য নয় কারণ অস্ট্রিয়ার মনঃচিকিৎসক এলিযাবেথ এস. লুকাস বলেন, সাইকোথেরাপির ইতিহাস জুড়ে লগোথিরাপির মতো কোনো ধারা ছিল না”।[8] লগোথেরাপির প্রথম বিশ্ব সম্মেলনে (স্যান ডিয়েগো, কালিফোর্নিয়া, নভেম্বর, ৬-৮, ১৯৮০) আমি কেবল সাইকোথেরাপির পুণঃমানবিকরণ সম্পর্কে তর্ক করিনি বরং আমি যাকে the degurufication of logotherapy   বা লগোথেরাপির গুরুমুক্তকরণ সম্পর্কেও তর্ক করেছি। আমার আগ্রহ তোতা পাখি বংশবিস্তারে নিহিত নয় যারা “তাদের প্রভুর কথা” অনুশীলন করে, কিন্তু “স্বাধীন আর উদ্ভাবনীশক্তি সম্পন্ন, প্রতিভাবান, আর সৃজনশীলদের কাছে  আলোক মশাল হস্তান্ত করাই আমার আগ্রহ।

সিগমুণ্ড ফ্রয়ড এক সময় জোর দিয়ে বলেছিলেন, “কেউ বেশ কয়েকজন সবচেয়ে বৈচিত্র্যময় মানুষদের অভিন্নভাবে প্রবল আকাঙ্ক্ষার কাছে প্রকাশ করার প্রচেষ্টা করুক। অপরিহার্য তাড়নার প্রবল আকাঙ্ক্ষা বৃদ্ধির সাথে সাথে সকল স্বতন্ত্র ভিন্নতা মলিন হয়ে যাবে, আর তাদের বদলে অশান্ত অভিলাষের অভিন্ন অভিব্যক্তি প্রকাশিত হবে”। ঈশ্বর বাঁচিয়েছেন, সিগমুণ্ড ফ্রয়ড বন্দী শিবিরকে ভেতর থেকে বুঝতে পারেন নি। তার রোগীরা ভিক্টোরিয়ান সংস্কৃতির ধারায় আড়ম্বরপূর্ণভাবে সজ্জিত পালঙ্কে শুয়ে থাকতো, আশউইৎযের নোংরায় নয়। সেখানে “স্বতন্ত্র ভিন্নতা” “মলিন” হয়নি তবে, তার বিপরীতে, মানুষ আরও অধিক হারে বৈচিত্র হয়ে উঠেছিল; লোকেরা নিজেদের মুখোশ উন্মোচন করেছিল, শুকর আর সাধু উভয়েই। আর আজকে আপনাকে সেইন্ট বা “সাধু” শব্দটি ব্যবহার করতে ‍দ্বিধাবোধের দরকার নেই: পোল্যাণ্ডের সাধু ম্যক্সিমিলিয়ান কলবে’র কথা ভাবুন যাকে অনাহারে রাখা হয়েছিল আর অবশেষে আশউইৎযের শিবিরে কার্বোলিক এসিড ইঞ্জেকশন দিয়ে হত্যা করা হয়েছিল আর যাকে ১৯৮৩ সালে সেইন্ট বা সাধু উপাধিতে ভুষিত করা হয়েছিল।

নিয়ম নিয়মবহির্ভূত উদাহরণ আনার কারণে, আপনার হয়তো আমাকে দোষারোপ করার প্রবণতা থাকতে পারে। ‍স্পিনোযার নীতিশাস্ত্র মতে, “but everything great is just as difficult to realize as it is rare to find” (কিন্তু প্রতিটি মহান জিনিস খুজে পাওয়া যেমন দুষ্কর তেমনি অনুধাবন করাও কঠিন)। আপনি অবশ্য প্রশ্ন করতে পারেন “সাধু’র প্রতি নির্দেশ আদৌ দরকার ছিল কিনা। মানুষ হিসেবে নির্দেশ করাই কি যতেষ্ট হতো না? এটা সত্যি যে তারা সংখ্যালঘু মানুষ। তারচেয়েও, তারা সবসময়ই সংখ্যালঘু হিসেবে রয়ে যাবে। আর তবুও আমি সেই সংখ্যালঘুতে যোগ দেওয়াকে বড় প্রতিবন্ধকতা বা চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখি। কারণ পৃথিবী মন্দ অবস্থায়, কিন্তু সব কিছু আরও মন্দ হয়ে উঠবে যদি না আমরা প্রত্যেকে সর্বোত্তম কাজটি করি।

তাই, আসুন সচেতন হয়-দ্বিমুখীভাবে সচেতন:
অশউইৎযের পর থেকে আমরা জানি মানুষের পক্ষে কি করা সম্ভব।
আর হিরোশীমার পর থেকে জানি কি ঝুঁকিতে রয়েছে।


[1] W. H. Sledge, J. A. Boydstun and A. J. Rabe, “Self-Concept Changes Related to War Captivity,” Arch. Gen. Psychiatry, 37 (1980), pp. 430-443. 8

[2] “মানবাত্মার অদম্য শক্তি” বা The Defiant Power of the Human Spirit” ছিল ন ১৯৮৩’তে বিশ্ব তৃতীয় লগোথেরাপি সম্মেলন কর্তৃক উপস্থাপিত গবেষনার শিরোনাম । 

[3] পোল্যান্ডের এক কার্ডিওলজিষ্ট এর দেওয়া অস্ট্রিয়ান টেলিভিশনে শুনা এক সাক্ষাৎকারের কথা আমি ভুলতে পারবো না, যিনি দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধের সময় ওয়ারসো বস্তি বিদ্রোহ সংঘটিত করতে সাহায্য করেছিলেন। “কী বীরত্বপূর্ণ কাজ” তিনি বিস্ময়ে প্রতিবেদক বলেন। “শুনেন”, শান্তভাবে ডাক্তার সাহেব উত্তর দিলেন, “গুলি হাতে নেওয়া আর গুলি ছুড়া কোনো মহান জিনিস নয়; কিন্তু যদি SS সদস্যরা তোমাদের গ্যাস চেম্বারে নিয়ে যায় বা নিয়ে যায় কোনো গণ কবরে তোমাদের প্রাণ নাশের জন্য, আর তাতে আত্ম-মর্যাদার সাথে পথ অনুসরণ করা ছাড়া তোমাদের করার কিছুই থাকে না, দেখো, আমি তাকেই বীরত্ব বলি”। মনোভাবগত বীরত্ব, বলতে গেলে।

[4] আরও দেখুন Joseph B. Fabry, The Pursuit of Meaning, New York, Harper and Row, 1980.

[5] Cf. Viktor E. Frankl, The Unheard Cry for Meaning, New York, Simon and Schuster, 1978, pp. 42-43.

[6] আরও দেখুন Viktor E. Frankl, Psychotherapy and Existentialism, New York, Simon and Schuster, 1967.

[7] “Transference and Countertransference in Logotherapy,” The International Forum for Logotherapy, Vol. 5, No. 2 (Fall/Winter 1982), pp. 115-18.

[8] লগোথেরাপিকে সাইকোথেরাপিতে আগ্রহীদের উপর চাপিয়ে দেওয়া হয় না। এটি প্রাচ্যের বাজারের সাথে তুল্য নয় বরং এটিকে এক সুপার মার্কেটেরে সাথে তুলনা করা যায়। বাজারের বেলায় ক্রেতাকে কোনো কিছুর কেনার জন্য প্ররোচিত করতে হয়। সুপার মার্কেটের বেলায় ক্রেতাকে ভিবিন্ন জিনিস দেখানো হয়, এবং প্রস্তাব করা হয় যেখান থেকে সে যেটাকে ব্যবহারযোগ্য আর মূল্যবান মনে করে সেটাই বেছে নেবে।

লেখক পরিচিতি

Victor Frankl, Author of Man's Search for meaning
Victor Frankl

ভিক্টর ফ্রাঙ্কল ছিলেন ইউনিভার্সিটি অভ ভিয়েনা মেডিকেল স্কুল এর স্নায়ু-তত্ত্ব ও মনোচিকিৎসার প্রফেসর এবং ইউনাইটেড স্টেইট ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির লগোথেরাপির বিশিষ্ট প্রফেসর। তিনি হলেন তৃতীয় ভিয়েনিস স্কুল অব সাইকোথেরাপি’র স্কুল অভ লগোথেরাপির প্রতিষ্ঠাতা (ফ্রয়ডের psychoanalysis এবং এডলারের individual psychology বা স্বতন্ত্র মনস্তত্ত্বের পর)। ১৯০৫ খ্রিষ্টাব্দে জন্মগ্রহণ করে, ড. ফ্রাঙ্কল ভিয়েনা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডক্টর অভ মেডিসিন ও ডক্টর অভ ফিলসফি লাভ করেন। দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধের সময় তিনি তিন বছর অশউইৎযের, ডাক্সাও এবং অন্যান্য বন্দী শিবিরে কাটান। ড. ফ্রাঙ্কল ১৯২৪ খ্রিষ্টাব্দে INTERNATIONAL JOURNAL OF PSYCHOANALYSIS এ প্রথম প্রকাশ করেছিলেন এবং তখন থেকে তিনি সাতাশটি বই প্রকাশ করেন যা জাপানি ও চীনা ভাষা সহ অন্যান্য ভাষায় অনুদিত হয়। তিনি ছিলেন হার্ভার্ড, প্যান্সিলভানিয়া ডুকেইন বিশ্ববিদ্যালয় ও সাউদার্ন মেথোডিস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিজিটিং প্রফেসর। শিকাগোর লয়োলা বিশ্ববিদ্যালয়, এজক্লিফ কলেজ, রকফোর্ড ও মাউন্ট মেরি কলেজ সহ ব্রাজিল, ভেনেযোয়েইলা এবং দক্ষিণ আফ্রিকার বিশ্ববিদ্যালয় সমূহ থেকে তাকে অনারারী ডিগ্রি প্রদান করা হয়। বিশ্বজুড়ে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি ছিলেন এক আমন্ত্রিত ল্যাকচারার এবং কেবল যুক্তরাষ্ট্রতেই তিনি বায়ান্ন-বার ল্যাকচার সম্পর্কিত ভ্রমণ করেন। তিনি ছিলেন অস্ট্রিয়ান মেডিকেল সোসাইটি অভ সাইকোথেরাপির প্রেসিডেন্ট ও অস্ট্রিয়ান একাডেমী অব সায়েন্সের অনারারী সদস্য।

সমাপ্ত

০৩/০১/২০২৩, প্রবীণ।

Inquiry_all

Doing the right things by the right living with the right people in the right manner.

Post a Comment

Previous Post Next Post